ঠাণ্ডার তীব্রতা আরও সপ্তাহ দুয়েক থাকলে ফসলের ক্ষতি বাড়তে পারে বলে কৃষি সংশ্লিষ্টদের শঙ্কার মধ্যেই এ মাসে আরও একটি শৈত্য প্রবাহের আভাস দিচ্ছে আবহাওয়া অফিস।
Published : 17 Jan 2024, 12:33 AM
চাঁদপুরের শাহরাস্তি এলাকার কৃষক দুলাল হোসেন প্রায় ছয় একর জমিতে ধান চাষের জন্য প্রস্তুত করেছেন বীজতলা। গত কয়েকদিনের তীব্র শীতে প্রচুর চারা নষ্ট হয়ে গেছে।
একই এলাকার আরেক কৃষক শিবলুর রহমানের চিন্তা ক্ষেতে থাকা শীতকালীন শাকসবজি নিয়ে। আলু, টমেটো, বেগুন, মসুর, লাল শাকের চাষ করেছেন তিনি। এর মধ্যে গত কয়েকদিনে আলু গাছের লতাপাতা ও কাণ্ড পচে যেতে দেখছেন তিনি।
শিবলু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আলু গাছগুলো দ্রুত বেড়ে উঠেছিল। ভেবেছিলাম ভালো ফলন হবে। এখন তো টেনশনে পড়ে গেলাম।”
চাষিদের পাশাপাশি কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শীতের সঙ্গে দীর্ঘ সময়জুড়ে কুয়াশা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছত্রাকজনিত রোগের আক্রমণ বেড়েছে। এ কারণে কোথাও বীজতলার, কোথাও ফসলের গাছ রোগাক্রান্ত হচ্ছে।
কয়েক জেলায় বয়ে যাওয়া শৈত্যপ্রবাহ ও ঠান্ডায় দেশজুড়ে জবুথবু অবস্থার মধ্যে বোরো ধান চাষিরা শীত নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন বেশি।
পৌষের শেষ ভাগ থেকে মাঘের শুরুতে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শীতের এ বিরূপ প্রভাব পড়তে দেখা গেছে ফসলেরও মাঠেও। এর মধ্যে কোথাও কোথাও বৃষ্টির আভাস কৃষকদের মধ্যে ভয় জাগাচ্ছে। সপ্তাহজুড়ে সূর্যের আলো ঠিকমত না থাকায় কুড়িগ্রাম, রংপুর, বগুড়াসহ অনেক এলাকা থেকে বীজতলা ক্ষতির মুখে পড়ার খবর এসেছে।
এখনও মাঠ পর্যায়ে বড় ধরনের ক্ষতি না হলেও এমন আবহাওয়া দীর্ঘায়িত হলে ‘ঝুঁকি’ বাড়বে বলে আশঙ্কা চাষি ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের।
মঙ্গলবার চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক সাফায়েত আহম্মদ সিদ্দিকী শীতের এমন পরিস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ে খোঁজখবর নেওয়ার তথ্য দিয়ে বলেছেন, এমন পরিবেশ ছত্রাক আক্রমণের সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ। যে কারণে কৃষককে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য এসে পৌঁছেনি জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তবে আজ থেকে কুয়াশা কেটে গেছে। এটা প্রাকৃতিক জিনিস। এটাতে আমাদের হাত নাই।”
শীতের প্রভাব আলুক্ষেতেও
ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীতে বগুড়া ও রংপুরে আলুক্ষেতের পচন রোগ ‘লেট ব্লাইট’ আক্রমণের খবর এসেছে।
নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করেও সমাধান না মেলায় বগুড়ার কৃষকদের যেখানে দিশেহারা অবস্থা, সেখানে কৃষি বিভাগ বলছে সমস্যার সমাধান মিলবে ‘রোদ উঠলে’।
সার-কীটনাশকের পাশাপাশি এ রোগ দমনে স্প্রে কিনতে ‘বাড়তি খরচ’ মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে রংপুরের কৃষকের জন্য।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বগুড়া অঞ্চলের উপ-পরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দীন ফিরোজ জানান, জেলায় গত বছর ৪৩ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছিল; এবার বেড়ে ৫৫ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে হয়েছে।
কিন্তু ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতের কারণে আলুর ক্ষেতে লেট ব্লাইট দেখা দেওয়ায় কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন, যোগ করেন তিনি।
বগুড়া প্রতিনিধি জানান, আলু উৎপাদনে বৃহত্তর অঞ্চল বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, লেট ব্লাইট রোগ ধরায় আলুর ক্ষেতের পাতা ও ডগা এরইমধ্যে পচতে শুরু করেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরেরে রংপুরের উপ-পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, “আলু ক্ষেতের জন্য সবচেয়ে বেশির শঙ্কার কারণ ঘন কুয়াশা। ঘন কুয়াশা বেশিদিন থাকলে আলুর লেট ব্লাইট হতে পারে। এ রোগ প্রতিরোধে চাষিদের নিয়মিত ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছি।”
বীজতলা ঘিরেই দুশ্চিন্তা বেশি
তীব্র শীতে বোরো বীজতলা ও আবাদ নিয়ে বেশি চিন্তায় কৃষক। কুড়িগ্রামে শীত থেকে রক্ষা পেতে অনেকে স্বচ্ছ সাদা রঙের প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখছেন বীজতলা। এমন ঠান্ডায় জমিতে চারা রোপণের সাহস পাচ্ছে সেখানকার কৃষক।
কুড়িগ্রাম সদরের ভোগডাঙার কৃষক আনিছুর রহমান বলেন, “বোরো আবাদের জন্য বীজতলার চারার পরিণত বয়স হয়েছে। কিন্তু প্রচুর ঠান্ডা ও কুয়াশার কারণে জমিতে চারা রোপণ করতে পারছি না। এদিকে বীজতলাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে প্লাস্টিক দিয়ে বীজতলা ঢেকে রেখেছি।”
একই এলাকার কৃষক মন্তাজ আলী বোরোর পাশাপাশি আলু ক্ষেত ও বীজতলায় শীতে ‘হিম ধরা’ শুরুর তথ্য দেন। বলেন, স্প্রে করেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত বলেন, “জেলায় সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা রয়েছে। ঘন কুয়াশা ও তীব্র ঠান্ডায় কৃষকদের বোরো আবাদে বিলম্বিত হচ্ছে।”
সাধারণত নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মে পর্যন্ত সময়ে দেশে বোরো ধানের মৌসুম চলে। এ জন্য বীজতলা প্রস্তুত হয় এ সময়টায়। চারার বয়স ৪০ থেকে ৪৫ দিন হলে সেগুলো তুলে মাঠে নিয়ে রোপণ করা হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (সম্প্রসারণ ও কো-অর্ডিনেশন) মো. ছাইফুল আলম বলেন, “শীতের তীব্রতা আরও সপ্তাহ দুয়েক থাকলে ঝুঁকি রয়েছে। ঠান্ডাজনিত সমস্যাটা মাথায় রেখে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্যাথলজি বিভাগের প্রধান তাহমিদ হোসেন আনসারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যদি বীজতলায় পানির পরিমাণ কম থাকে, অর্থাৎ মাটি ভেজা থাকবে কিন্তু পানিতে ডোবা থাকবে না, এইরকম একটা পরিবেশে কম তাপমাত্রায় ধানের চারা পোড়া রোগটা বেড়ে যায়। এর ফলে প্রচুর চারা নষ্ট হয়।
“এই ঠান্ডায় মাটিতে যে ‘ফিউজারিয়াম প্যাথোজেন’ থাকে-অঙ্কুর গজানোর পরপরই এর আক্রমণ হলে বীজ গজায় না। পরিবেশগতভাবে বলা হয় যে ঠান্ডায় নষ্ট হয়ে গেছে। ঠান্ডায় অনেক সময় আক্রান্ত হয়, হয়ে চারা নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু তার সঙ্গে জড়িত হল এই চারা পোড়া রোগের জীবাণু।”
জানুয়ারির এ সময় বোরো ধান, আলু, ডাল, ভুট্টা, তৈলবীজ জাতীয় ফসলসহ বেশ কিছু ফসলও চাষ হয়। শৈত্যপ্রবাহ বেশিদিন প্রবাহমান থাকলে এসব ফসল নিয়েও দুশ্চিন্তা তৈরি হতে পারে বলে জানান কৃষি সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ফারুক বিন হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শৈত্যপ্রবাহের ফলে ছত্রাকজনিত রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়। ছত্রাকগুলোর জন্য যে উপযোগী আবহাওয়া দরকার তার জন্য রাতের তাপমাত্রা ২০ থেকে ২২ ডিগ্রির নিচে থাকতে হবে। বাতাসের আদ্রতা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ হবে, পাতায় পানি জমবে শিশির থেকে বা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির জন্য।”
বীজতলায় ছত্রাকের লক্ষণ বোঝা যাবে কীভাবে
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা তাহমিদ বলেন, “যদি সদ্য গজানো চারা হয়, তাহলে মাথাটা বাদামি রঙের হয়ে যাবে। এরপর আস্তে আস্তে মরে যাবে।
“আর যদি একটু বয়সী চারা হয় (কয়েক পাতা, দুই পাতা বা তিন পাতা হয়েছে) তাহলে জায়গায়-জায়গায়, ছোপ-ছোপ হলুদাভ দাগ থাকবে। কোথাও সবুজ, কোথাও হলুদ। শেষ পর্যায়ে যখন আক্রমণ সিরিয়াস হয়ে যাবে, সে সমস্ত জায়গার চারা খাটো হয়ে যাবে, সবুজ অংশের চারা লম্বা হয়ে যাবে।”
এ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য সবচেয়ে কার্যকর হল বীজে স্প্রে করা। সেটি করা না হলেও চারা গজানোর পরে লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে স্প্রে করার পরামর্শ দেন তিনি।
এই কর্মকর্তা বলেন “নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বোত্তম উপায় হল সিড ট্রিটমেন্ট। যারা নতুন করে বীজ ফেলবে, বাজারে যে ডাইস্লেকোজল ও আজোক্সিস্ট্রাবিন গ্রুপের যে মিক্সচার পাওয়া যায়, এটা দিয়ে দেওয়া সবচেয়ে ভালো।
“যদি কেউ বীজে না দিয়ে থাকে, তাহলে চারায় লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত একই ওষুধ প্রতি লিটার পানিতে ৩ মিলিলিটার মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করে দেবে।”
শীতে অন্য ফসলে যেসব রোগ, যা করতে হবে
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ফারুক বিন হোসেন জানান, এরকম শীতে আলুতে লেট ব্লাইট নামে এক ধরনের রোগ হয়।
‘ফাইটোপথোরা ইনফেস্ট্যান্স’ নামের ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হলে আলু গাছের লতাপাতা ও কাণ্ড পচে যায়। দুই-তিনদিনের মধ্যেই মাঠের সমস্ত গাছই মরে যেতে পারে বলে তিনি জানান।
কাণ্ড পচার এ রোগ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতি লিটার পানিতে রোভরাল দুই গ্রাম মিশিয়ে তিনবার ফসলে স্প্রে করার পরামর্শ দেন তিনি।
তাপমাত্রা আরও নেমে গেলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মসুর ডাল। ‘স্কোলোরোশিয়াম রলফছি’ নামের ছত্রাকের আক্রমণে মসুর গাছ গোড়া পচা রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগের আক্রমণ হলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, না হলে মোটেই ফসল পাওয়া যাবে না।
ফারুক বিন জানান, মসুর ডালে গোড়া পচা রোগ দমনে অটোস্টির-৫০ ডাব্লিউ পি নামে ওষুধটি প্রতি লিটার পানিতে দশমিক দুই গ্রাম মিশিয়ে সাত থেকে দশদিন পরপর দুই-তিনবার গাছের গোড়া ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ছোলার ক্ষেত্রে এ রকম আবহাওয়ার জন্য ‘বট্রাইটিস গ্রে মোল্ড’ রোগ দেখা দেয়। এর ফলে ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যেই গাছের ভেতরের পাতাগুলো হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়। এ রোগের প্রতিকার হিসেবে আক্রোবেট এম জেড দুই মিলি অথবা অটোস্টিন ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সাত থেকে ১০ দিন অন্তর দুই থেকে তিন বার স্প্রে করতে হবে।
সরিষায় এ সময়ে দেখা দেয় কাণ্ড পচা রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হলে গাছ পচে মারা যায়।
এ রোগ প্রতিরোধে চারা রোপণের আগে প্রোভেক্স-২০০ এর মাধ্যমে বীজ জীবাণুমুক্ত করতে হবে। রোগ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোভরাল ২ গ্রাম প্রতি লিটারে মিশিয়ে তিনবার প্রয়োগ করতে হবে (বৃদ্ধি পর্যায়ে, ফুল ও ফল ধরার পর্যায়ে)।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন রংপুর, বগুড়া ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি]
তীব্র ঠান্ডা থেকে ফসল রক্ষায় কৃষি পরামর্শ
ঘন কুয়াশা: বোরো বীজতলা নিয়ে কৃষকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ
চুয়াডাঙ্গায় ঘন কুয়াশায় ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তায় চাষিরা
ঠান্ডায় কাহিল জনজীবন, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গা ও কিশোরগঞ্জে