দেশের গ্যাস না তুলে আমদানিনির্ভর হয়ে যাওয়ার সমালোচনার উত্তরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এক সময় গ্যাস থাকলেও গত দেড় দশকে তার অনেকটাই খরচ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ বিজনেস সামিট-২০২৩ এর দ্বিতীয় দিন রোববার ‘স্ট্র্যাটেজিক অ্যাপ্রোচ ফর এনার্জি সিকিউরিটি টু এটেইন সাসটেইনেবল গ্রোথ’ শীর্ষক আলোচনায় একথা বলেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিডা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এই সম্মেলন আয়োজন করেছে।
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেনের সঞ্চালনায় আলোচনার এই পর্বে সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান, জেনারেল ইলেক্ট্রনিক্স (জিই) দক্ষিণ এশিয়ার সিইও দীপেশ নন্দ, ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান বক্তব্য রাখেন।
ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আলমগীর বলেন, “গত ১৪ বছরে দেশে গ্যাস আবিষ্কারের জন্য কোনো ড্রিলিং হয়নি। মাটির নিচে ডলার পড়ে আছে তারপরও আমরা ডলারের জন্য হাহাকার করছি।”
বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ বাড়ানোর দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় কোম্পানিগুলোর শক্তিশালী না হলে, বিদেশি কোম্পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে কোনো উন্নয়ন টেকসই হবে না।
সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির দিকটি দেখিয়ে বলেন, “এটা সম্ভব হয়েছে সরকারের সদিচ্ছা ও নীতি সহায়তার কারণে।
“জ্বালানি নিরাপত্তা এখন সারা বিশ্বের প্রধান উদ্বেগের বিষয়। জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য বাংলাদেশের উচিৎ নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান কাজে মনোযোগ দেওয়া।”
সম্ভব হলে কয়লার উৎপাদনও বাড়াতে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপালের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করা যায় বলেও মত দেন তিনি।
ব্যবসায়ীদের আলোচনা শুনে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল বলেন, ২০০৯ সালে গ্যাসের দৈনিক সরবরাহ ছিল ১৬০০ এমএমসিএফডি। এখন সেটা ২৩০০ এমএমসিএফডিতে উন্নীত হয়েছে। প্রায় এক হাজার এমএমসিএফডি গ্যাস উৎপাদন বেড়েছে গত ১০ বছরে।
“ব্যবসায়ীরা মনে হয় এবিষয়ে আপডেট ডাটা রাখেন না। বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে যে খবর বের হয়েছিল সেটা ছিল ২০০১ সালের। তখন গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন ছিল ১২০০ এমএমসিএফডি। বাংলাদেশ তখন গ্যাসের উপর ভাসছিল। এতদিনে সেগুলো খরচ হয়ে গেছে।”
এই খরচের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে দেশে ব্যাপক শিল্পায়ন হয়েছে। এই সময় গ্যাসের ব্যবহারও বেড়েছে। সুতরাং পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই।
বঙ্গোপসারে গ্যাস অনুসন্ধান প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “বঙ্গোপসাগরে গ্যাস থাকার বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত নই। এতদিন গ্যাসের দাম কম থাকায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়নি। এখন কেউ কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছে।”
সরকার শতভাগ বিদ্যুতায়নের পর এবার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহকে লক্ষ্য হিসাবে নিয়েছে বলে জানান তিনি।
নসরুল বলেন, “২০১০ সালের সরকার সবার জন্য বিদ্যুতের যে লক্ষ্য ঠিক করেছিল ২০২২ সালে এসে শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশ এত দ্রুত সময়ের মধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি।
“এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। সরকার যত দ্রুত সম্ভব সুলভ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করবে। তবে কোভিড ও পরবর্তীতে ইউক্রেইন যুদ্ধ এখন জ্বালানির বাজারে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে, সেকারণে দাম নিয়েও একটা অস্থিরতা চলছে।”
উৎপাদনে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যুক্ত করতে সরকারের উদ্যোগ শতভাগ বিদ্যুতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মন্তব্য করেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সরকার যে নীতিমালা প্রণয়ন করল, তখনই বেসরকারি খাত দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনে এগিয়ে আসল। এমনকি শেল, শেভরন, আদানির মতো বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে এসেছে।”
জ্বালানি ও বিদ্যুত খাতের ব্যবসায় ভ্যাট-ট্যাক্স নিয়ে আপত্তি তুললে তিনি বলেন, “ভ্যাট-ট্যাক্স নিয়ে কথা বলা খুবই অপ্রাসঙ্গিক। ব্যবসা করবেন, টাকা কামাবেন, কিন্তু ট্যাক্স দেবেন না, এটা হতে পারে না।”
আলোচনায় মূল প্রবন্ধে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিদ্যুৎ খাতের নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা সবুজ জ্বালানি বাড়ানোর জন্য সরকার চেষ্টা করছে। এই খাতেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ চাচ্ছে সরকার। বিশেষ করে বায়ু শক্তি থেকে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেতে বঙ্গোপসাগারের উপকূলে প্রকল্প স্থাপন প্রক্রিয়াধীন।
শ্রীলঙ্কা হতে চাই না বলেই: বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী
সরকার দেশের অর্থনীতিকে হুমকিতে ফেলতে চায় না বলেই গ্যাস-বিদ্যুতের ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের জানিয়েছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।
বিজনেস সামিটের দ্বিতীয় দিনে গার্মেন্টস খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় ও করণীয় শীর্ষক এক পর্বে তিনি বলেন, “আমরা শ্রীলংকা হতে চাই না। গ্যাস-বিদ্যুতে আর কত ভর্তুকি দেওয়া যাবে। আমরা টিকে থাকতে চাই। কিছুদিনের মধ্যেই গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। বিদ্যুতের সরবরাহও নিরবচ্ছিন্ন হবে।”
অনুষ্ঠানে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিজিএমইএ ও এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, বিটিএমএ পরিচালক আজিজুর আর চৌধুরী, বিজিএমইএর পরিচালিক আসিফ আশরাফ, ওয়ালমার্টের সিনিয়র ডিরেক্টর শ্রী দেবী কালাভাকোনালো বক্তব্য রাখেন।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী বলেন, “শিল্প-কারখানায় কয়েকদিনের মধ্যেই গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে৷ সরকার এলএমজি আমদানি করছে। বিদ্যুৎ আমদানি করছে। শিল্প-কারখানায় গ্যাস বিদ্যুতের সংকট দ্রুতই কেটে যাবে।”
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে বিটিএমএর পরিচালক আজিজুর আর চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি আমদানির পর যে হারে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে বাস্তবতার সঙ্গে তার মিল নেই। এবিষয়টি সরকারের পুনর্বিবেচনা করা উচিৎ।
দেশের পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধির পেছনে টেক্সটাইল শিল্প সমান্তরালভাবে অবদান রাখছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই খাতে এখন এফডিআই প্রয়োজন, জয়েন ভেঞ্চারের উদ্যোগ প্রয়োজন, উন্নত টেকনলজিতে বিনিয়োগ প্রয়োজন।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে এখন আর কোনো সস্তা শ্রম নেই। রানা প্লাজা ধসের পর নীতিমালা সংশোধন করে শ্রমিকের মজুরি নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট হচ্ছে। পাঁচ বছর পর পর বেতন পরিস্থিতি মূল্যায়ন হচ্ছে। আবার কোনো দক্ষ শ্রমিক চাইলে নিজের ইচ্ছে মতো বেতন বাড়ানোর চাপ দিতে পারেন।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বাংলাদেশ এখন আর শুধু কম মূল্যের পোশাকে সীমাবদ্ধ নেই। এখন ১০০ ডলার এফওবির পোশাকও এই দেশে তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ডেনিম পণ্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশ এখন পোশাক খাতে বিনিয়োগের আদর্শ জায়গা। আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বের এক নম্বর স্থান দখল করতে পারবে।