সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের অফিস সহকারী ফোরকান কারখানার ভিতরে থাকা এবাদতখানায় নামাজ পড়ে বের হওয়া মাত্র বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনতে পান। দেখেন, ওই ভবনের সব কাচ ভেঙে গেছে। মাথা ও শরীরে ঢুকে গেছে কাচের টুকরো।
৩৫ বছর বয়সী ফোরকান এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে চিতিৎসাধীন। রোববার দুপুরে হাসপাতালের বিছুনায় শুয়ে আগের দিনের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার বিবরণ দিচ্ছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, “বিস্ফোরণের পর কানে কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। চারপাশে দেখি শুধু ধুলা-ধোয়া আর থাই গ্লাসের টুকরা। আমার মাথা কেটে রক্ত পরছিল। কোথায় বিস্ফোরণ হয়েছে, সেটা বুঝতে পারিনি।”
ফোরকানের ধারণা, ঘটনার সময় প্ল্যান্টের কর্মচারী-শ্রমিক ও ট্রাকের চালক-সহকারী মিলিয়ে ৮০ থেকে ৯০ জন সেখানে ছিলেন।
শিল্পে ব্যবহৃত অক্সিজেন প্রস্তুতকারী কারখানাটিতে শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বিস্ফোরণের পর আগুন লেগে যায়। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেই আগুন নিয়ন্ত্রণ আনেন।
ওই ঘটনায় ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ২৪ জন। তাদের মধ্যে ১৯ জন এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান রোববার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আহতদের মধ্যে দুজন আইসিইউতে আছেন। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা বেশ খারাপ। বাকিদের অবস্থা মোটামুটি স্টেবল। গতকাল তিনজনের অপারেশন হয়। আজ দুজনের ওটি হচ্ছে। একজনের চোখে আঘাত আছে। উনাকে ঢাকা পাঠাব। বাকিদের চিকিৎসা এখানে সম্ভব।
“আহতদের বেশিরভাগ ক্ষত নিয়ে আসেন। বিএম ডিপোর ঘটনায় আহতদের তুলনায় এবারের আহতদের আঘাতের মাত্রা বেশি। লৌহ জাতীয় বস্তু বিস্ফোরণের কারণে ক্ষত, তাই আঘাতের মাত্রা বেশি। ইনজুরি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা গতকাল থেকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।”
এ হাসপাতাল চিকিৎসাধীন কয়েকজন জানালেন, বিস্ফোরণের পর সবকিছু দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকতে ও আগুন জ্বলতে দেখেছেন। তবে প্ল্যান্টের কোন অংশে কীভাবে বিস্ফোরণ হয়েছে, সে বিষয়ে তারা কিছু বলতে পারছেন না।
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের মেইনটেইন্স ইনচার্জ বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়ার বাসিন্দা নারায়ণ ধর (৬০) জানান, শনিবার বিকাল ৫টায় তার শিফট শেষ হওয়ার কথা ছিল।
“একটু আগে আমার কাজ শেষ হওয়ায় আমি কারখানার ভিতরে থাকা লেদ মেশিনের ওয়ার্কশপে গিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। উপর থেকে টিনের চালা আমার উপর ভেঙে পড়ে। কাঁধের উপর কোত্থেকে একটা লোহার এঙ্গেল এসে পড়ে। তখনই অজ্ঞান হয়ে যাই। হাসপাতালে আনার পর আমার জ্ঞান ফেরে।”
নারায়ণ বলেন, “মাথায় ও কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা। এখনও উঠে বসতে পারছি না। ঘটনার সময় মূল প্ল্যান্টে ৮-১০ জন ছিল। সব মিলে পুরো কারখানায় ৫০ জনের মত লোক থাকতে পারে। তবে ঠিক কোথায় বিস্ফোরণটা হয়, সেটা বলতে করতে পারছি না।”
প্ল্যান্টের সহকারী ইলেক্ট্রিশিয়ান নোয়াখালীর মো. জাহেদ (৩২) জানান, বিস্ফোরণের সময় তিনি স্টোর রুমে ছিলেন। মাথায় কাচ ভেঙে পড়ায় তিনি মাথায়, পেটে ও হাতে আঘাত পেয়েছেন।
“প্ল্যান্টেই বিস্ফোরণ সেটা টের পেয়েছি, কিন্তু কোন অংশ থেকে হয়েছে সেটা বুঝে উঠতে পারি নাই।”
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের যে ভবনটি বিস্ফোরণে ভেঙে পড়েছে, তার পাশের ভবনটিতে শনিবার কাজ করছিলেন ইলেক্ট্রিশিয়ান জসিম উদ্দিন (৩৫)।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিরাট শব্দ পাই। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভবনের কাচ, জানালা সব ভেঙে পড়ে। এরপর আর জানি না। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কারা যেন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে।”
২৪ বছর ধরে ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আবদুল মোতালেব (৪৫)। তিনি সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের উৎপাদন বিভাগে কর্মচারী।
কোমরে আঘাত ও মাথায় সেলাই নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আবদুল মোতালেব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্ল্যান্টের ভিতর তখন ১০ জন কাজ করছিল। তীব্র শব্দে সব কেঁপে ওঠার পর কোনো রকমে বেরিয়ে এসে বাইরে দেখি আগুন জ্বলছে। মাথায় হাত দিয়ে দেখি সেখান থেকে রক্ত পরছে। আশেপাশে সবকিছু দুমড়ে মুচড়ে গেছে...।”
আরও পড়ুন: