“বাবা এখন মুখে কিছুই বলছে না। শুধু একবার কথা বলেছিল,” ধরা গলায় বললেন আহত এক কর্মীর ছেলে।
Published : 05 Mar 2023, 01:49 AM
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বেসরকারি সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে হতাহতদের বেশির ভাগই কোম্পানিটির কর্মী; যাদের খোঁজে হাসপাতালে এসে দুসংবাদ শুনে অসহায় হয়ে পড়েছেন স্বজনরা।
হঠাৎ বিস্ফোরণে প্রিয়জন হারিয়ে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা হতবিহ্বল হয়ে গেছেন, আহতদের চিন্তায় মুষড়ে পড়েছেন অন্যরা। বেশির ভাগ পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিই আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন যন্ত্রণায়। বিকাল থেকে হাসপাতালজুড়ে স্বজন হারানোদের আহাজারি আর আহতদের গোঙানিতে চারিদিক ভারি হয়ে উঠেছে।
শনিবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বিকট শব্দে শিল্পে ব্যবহারের জন্য অক্সিজেন উৎপাদনকারী এ প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ছয়জন নিহত এবং ২৫ জন আহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক।
শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে সোনাইছড়ি ইউনিয়নে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে ওই প্ল্যান্টে বিকট বিস্ফোরণের পর থেকেই শুরু হয় হতাহতদের নিয়ে দৌড়ঝাঁপ।
৪টা ৫৫ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট সেখানে পৌঁছায়। পরে আরও আটটি ইউনিট সেখানে যোগ দেয়। সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
বিস্ফোরণে পুরো প্ল্যান্টটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; আশেপাশের এলাকার বড় অংশজুড়েই ধ্বংসচিহ্ন রেখে গেছে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণ। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বিকট বিস্ফোরণে অনেকের দেহের বিভিন্ন অংশ উড়ে যেতে দেখেছেন তারা।
তিন মেয়ে নিয়ে কোথায় যাবেন রাশেদা
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে গাড়িচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন মোহাম্মদ ফরিদ (৩৬)। ফৌজদারহাট বাংলাবাজার এলাকায় তিন মেয়ে ও স্ত্রী রাশেদা আক্তারকে নিয়ে ছিল ফরিদের সংসার।
বিকালে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন পেয়ে ভাই আজম খানকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ছুটে আসেন রাশেদা।
আজম খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুপুরে ১২টার দিকে আমাকে ফোন করেছিল দুলাভাই। উনার একটা গরু হারিয়ে গেছে গতকাল (শুক্রবার)। আজকে চাকরি থেকে গিয়ে আমাকে নিয়ে গরুটা খুঁজতে যাবে বলেছিল।
“বিকালে একজন ফোন করে আমাদের মেডিকেলে আসতে বলে। এসে দেখি দুলাভাই মারা গেছে। উনি ১৩ হাজার টাকার মত বেতন পেতেন। অনেক কষ্টে সংসার চলত। এখন কী হবে জানি না।”
হাসপাতালে স্বামীর মরদেহ দেখতে পেয়ে বিলাপ করতে করতে রাশেদা বলেন, “আমার ছোট ছোট তিনটা মেয়ে। এখন মেয়েদের কীভাবে মানুষ করব। কোথায় যাব?”
নিহত মো. শামসুল আলম (৬৫) ছিলেন ঘটনাস্থল সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে প্রায় ৫০০ গজ দূরে একটা লাকড়ির দোকানে। বিস্ফোরণে সেখানে উড়ে এসে পড়া লোহার টুকরো চাপায় তিনি মারা যান।
তার বড় ভাই ওবায়দুর মোস্তফা জানান, “ঘটনাস্থল থেকে ৫০০ গজ দূরে একটা লাকড়ির দোকানে শামসুল বসেছিলেন।
“২৫০ থেকে ৩০০ কেজি ওজনের একটা টুকরা দোকানের উপর এসে পড়ে। তার চাপায় ওনার প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ হয়। মেডিকেলে আনার পরও অনেক রক্ত গেছে।”
তিনি জানান, শামসুল আলমের তিন মেয়ে ও দুই ছেলে ছিল। বছর তিনেক আগে তার এক ছেলে মারা যায়। আরেক ছেলে রায়হান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে।
বিস্ফোরণে নিহত অন্যরা হলেন- নেত্রকোণা জেলার কমলাকান্দা থানার ছোট মনগড়া গ্রামের রতন লখরেট (৪৫), নোয়াখালী জেলার সুধারাম থানার অলিপুর গ্রামের আবদুল কাদের (৫০) ও লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগরের বাসিন্দা সালাউদ্দিন (৩৫)। নিহত অন্য একজনের নাম-ঠিকানা কিছুই জানা যায়নি।
বিকট শব্দে বিস্ফোরণ, ছিটকে পড়ে মাথায় আঘাত
চমেক হাসপাতালের অর্থপেডিক ওয়ার্ডে শয্যায় চিকিৎসাধীন আহত আব্দুল মোতালেব (৫২) ওই প্ল্যান্টে কাজ করেন ১০ বছর ধরে।
দুই কন্যা সন্তানের জনক মোতালেবের মাথায় ১১টি সেলাই পড়েছে। ঘাড় থেকে কোমর পর্যন্ত অংশে ভীষণ ব্যথা পেয়েছেন।
তার স্বজন মো. ইউসুফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মোতালেব আমাদের বলেছে সে কাজ করার সময় হঠাৎ সিলিন্ডার উড়ে এসে তার গায়ে পড়ে। তারপর সে মাটিতে পড়ে যায়। ডাক্তার বলেছে এক্সরে করার পর বুঝতে পারবে কী হয়েছে।”
পাশের শয্যায় মাথা ও হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে আছেন মজিবুর রহমান (৫০)। তিনি সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করেন।
তার ছেলে মো. আরমান বলেন, “বাবা ২টার সময় ডিউটিতে গিয়েছিল। রাত ১০টা পর্যন্ত বাবার ডিউটি। বাবা এখন মুখে কিছুই বলছে না। শুধু একবার কথা বলেছিল।”
বিস্ফোরণের সময় পাশ্ববর্তী একটি প্রতিষ্ঠানের গেটে ট্রাক এন্ট্রি করাচ্ছিলেন চালকের সহকারি রাকিব। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাড়ে চারটার যখন আজান দিচ্ছে সেসময় আমি পাশের কারখানার গেইটে দাঁড়িয়ে গাড়ির এন্ট্রি করছিলাম।
“হঠাৎ বিরাট একটা শব্দ শুনি। তখন রাস্তায় বসে যাই। তারপর একটু হুশ হতেই দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে অন্য পাশে চলে যাই। তখন দেখি সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে ধোঁয়া উড়ছে।”
বিস্ফোরণে আহত রিপন মারাক চার বছর ধরে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের মেনইটেইনেন্স বিভাগে কাজ করেন মেকানিক হিসেবে।
তিনি বলেন, “ফ্যাক্টরির ভিতরে মেইনেটেইনেন্স বিভাগ থেকে অক্সিজেন প্ল্যান্টের যাচ্ছিলাম। এরমধ্যে হঠাৎ বিকট শব্দ হয়। তারপর সব অন্ধকার। তখন কয়েক মিনিট কিছু মনে নেই। তারপর আস্তে আস্তে চোখে দেখতে শুরু করি।”
এরপর নিজের বিভাগে গিয়ে দেখেন তার অরেক সহকর্মী নারায়ন ধরও মাটিতে পড়ে আছেন। সেখান থেকে তাদের চমেকে নিয়ে আসা হয়। পিঠে আঘাত নিয়ে হাসপাতালে আছেন রিপন।
বিস্ফোরণে আহতদের মধ্যে ১৮ জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন- ফোরকান আলী (৩৩), নুর হোসেন (৩০), আব্দুল মোতালেব (৫২), মো. আরাফাত (২২), মাকসুদুল আলম (৩০), মো. ওসমান (৪৫), মো. সোলায়মান (৪০), মো. রিপন (৪০), মো. আজাদ, রিপন মারাক (৬০), প্রবেশ (৪০), নারায়ন ধর (৬০), ফেন্সী (২৬), মো. জাহেদ (৩০), মুজিবুল হক (৪৫), রোজি বেগম (২৪) ও নাসিম শাহরিয়ার (২৬)।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আহতদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা গুরুতর। এছাড়া চারজনের মাথায় আঘাত আছে। আটজনের সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। দুয়েকজন চোখে ও কানে আঘাত পেয়েছেন।
“তাদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব কিছু করা হবে।”