কারখানায় থাকা অক্সিজেনের ট্যাংক থেকে বিস্ফোরণ বলে ফায়ার সার্ভিসকে ধারণা দিয়েছেন স্থানীয়রা।
Published : 05 Mar 2023, 12:48 AM
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় নেমে সরু পথ ধরে আধা কিলোমিটার যেতেই চোখে পড়ে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট। ওই সরু সড়কের দুই পাশে আছে ৮-১০টি স্টিল রি-রোলিং মিল, তেলের রিফাইনারিসহ বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানা, আছে বসতবাড়িও।
শনিবার বিকালে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর এলাকাটি রূপ নিয়েছে ধ্বংসস্তূপে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আশপাশের কারখানা, বসতবাড়ি। বিস্ফোরণ বুকে কাঁপন ধরিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের, এতদিনে এসে তারা অনুধাবন করতে পেরেছেন মৃত্যুঝুঁকির কথা।
এ দিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে সোনাইছড়ি ইউনিয়নে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে শিল্পের ব্যবহারের জন্য অক্সিজেন উৎপাদনকারী 'সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে' বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় রাত পর্যন্ত ছয়জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন অন্তত ২০ জন।
রাতের মত উদ্ধার কাজ শেষ করা হয়েছে রাত আটটার দিকে। সকাল থেকে আবার উদ্ধারে নামার কথা জানিয়েছেন আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আব্দুল মালেক।
বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল, কারখানাটি পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। লোহার বেড়া আটকে রাখার অ্যাঙ্গেলগুলো পর্যন্ত বেঁকে গেছে।
প্ল্যান্ট প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সিলিন্ডার, লোহার টুকরো, ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যাওয়া তিনটি ট্রাক। কারখানা থেকে ৫০-৬০ গজ দূরে গিয়ে পড়ে রয়েছে লোহার টুকরো। শুধু তাই নয়, প্রায় ৫০০ গজ দূরে ছিটকে পড়া লোহার টুকরোর আঘাতে একজনের প্রাণহানিও হয়েছে।
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের ঠিক বিপরীতে স্থানীয় ‘লেদু কন্ট্রাক্টরের’ দোতলা পাকা বাড়ি, ডান পাশে ‘হারুন সাহেবের’ মালিকানাধীন এইচ স্টিল মিল, ৫০ গজ দূরে ‘হারুন সাহেবের’ই আরেক কোম্পানি রুবাইয়া ভেজিটেবল ওয়েল কারখানা।
বিস্ফোরণের ফলে লেদু কন্ট্রাক্টরের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটু দূরে রুবাইয়া তেল কারখানার দোতলা পাকা শেড ক্ষতির মুখে পড়েছে, উড়ে গেছে টিন, স্টিল শিট।
স্থানীয়রা জানালেন, আশপাশের আরও অন্তত ৭-৮টি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্ঘটনার পর সেসব কারখানার কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
আধ কিলোমিটার দূরের সাফা স্টিল রি-রোলিং মিলের কর্মচারী অরেশ ত্রিপুরা জানালেন, ঘটনার সময় তিনি নিজের কারখানায় কাজ করছিলেন। বিকট বিস্ফোরণে তাদের অফিসের জানালার কাঁচ, মিটারের কাঁচ ভেঙে গেছে। পুরো কারখানা কেঁপে ওঠে।
কদমরসুল এলাকার মোসলেম উদ্দীন ভেবেছিলেন- ভূমিকম্প হচ্ছে, সে কারণে ঘর ছেড়ে বাইরে বের হন। তারপরই আগুন ও ধোঁয়া দেখতে পাওয়ার কথা জানালেন তিনি।
স্থানীয় নুরুল আলম বহু বছর ধরে ওই এলাকায় নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কর্মরত আছেন। বিস্ফোরণে বুক কেঁপে উঠেছেন তার। নুরুল এতদিনে বুঝেছেন ঝুঁকিটা কোথায়।
তার কথায়, “এই ঘনবসতিপুর্ণ এলাকায় একটির সাথে আরেকটি গায়ে গা লাগিয়ে কারখানা গড়ে উঠেছে। বসতবাড়িও আছে অনেক। এখানে জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই।”
দুর্ঘটনাকবলিত প্ল্যান্টটিতে উৎপাদন করা হয় অক্সি-এসিটিলিন গ্যাস। এটি মূলত শিল্পে ব্যবহার করা অক্সিজেনের প্ল্যান্ট। অক্সি-এসিটিলিন গ্যাসের শিখা দিয়ে লোহার পাত কাটা হয়। একই সঙ্গে রি রোলিং মিলে লোহা গলাতে ব্যবহার করা হয়।
আশপাশের জাহাজভাঙা শিল্প ও স্টিল রি-রোলিং মিলে ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করা হয় সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে।
এ কোম্পানির মালিকানাধীন শিল্পগ্রুপের জাহাজ ভাঙা শিল্প ও রি রোলিং মিলও রয়েছে।
জাহাজভাঙা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শফি কারখানাটি গড়ে তোলেন বলে জানালেন স্থানীয়রা।
তার মৃত্যুর পর তার তিন ছেলে মামুন উদ্দীন, আশরাফ উদ্দীন ও পারভেজ উদ্দীন কোম্পানিটি চালাচ্ছেন।
মামুন উদ্দীন এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সীতাকুণ্ডের জাহানাবাদে এস ট্রেডিং নামে তাদের শিপইয়ার্ড রয়েছে। বানু বাজার এলাকায় সীমা স্টিল রি-রোলিং মিল নামে তাদের মালিকানাধীন আরেকটি কারখানা রয়েছে।
ঘটনার পর মোবাইল ফোনে মামুন উদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলছেন, তারাও ঘটনাস্থলে গিয়ে মালিকপক্ষের কাউকে দেখতে পাননি।
জেলা প্রশাসক বলেন, “আমরা মালিকদের ট্রেস করার চেষ্টা করছি। আমরা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীও কাউকেই ঘটনাস্থলে পাইনি।
“এখানে সিলিন্ডার রিফিল করা হত। ঘটনা কী কারণে, সেটা এখনই বলা যাবে না। তদন্তে কমিটি করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কারণ নির্ণয় করা যাবে।”
অক্সিজেন ট্যাংক থেকে বিস্ফোরণ, ধারণা ফায়ার সার্ভিসের
বিস্ফোরণের ঘটনা ঠিক কী কারণে ঘটেছে তা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারাও। তবে সেখানকার অক্সিজেন ট্যাংক থেকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।
ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে অক্সিজেনের দুটি বড় ট্যাংক ছিল। সেগুলোই বিস্ফোরিত হয়েছে বলে স্থানীয়রা ধারণা দিয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আব্দুল মালেক বলেন, “আমরা দুর্ঘটনাস্থলে অনেক সিলিন্ডার দেখেছি। অনেক সময় সিলিন্ডার পরীক্ষা হয় না। বিস্ফোরণের অনেক কারণ থাকতে পারে। তদন্তে বোঝা যাবে। তবে সিলিন্ডার থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে মনে করছি।“
কারখানাটিতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “বিস্ফোরণ ঘটার পর সেখানে যে অবস্থা… নিরাপত্তা পর্যাপ্ত ছিল কি না তা বোঝার উপায় নেই।”
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা মালেক বলেন, “আমরা বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটে বিস্ফোরণের সংবাদ পাই। দ্রুত ঘটনাস্থলে কুমিরা ফায়ার স্টেশনের দুটি গাড়ি গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে।
“ফায়ার সার্ভিসের তিনটি স্টেশনের নয়টি গাড়ি সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে এবং সাড়ে ৬ টার দিকে সম্পূর্ণ নির্বাপণ করে।”
বিস্ফোরণের সময় কারখানায় কতজন কাজ করছিলেন তাও স্পষ্ট নয়।
শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাদিরা নূর বলছেন, “যতটুকু জেনেছি এক শিফটে ৫০ জন কাজ করত। বিস্ফোরণের সময় চারজন সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার (রিফুয়েলিংয়ের) কাজ করছিলেন। অন্য শ্রমিকেরা লোড আনলোডসহ অন্যান্য কাজে ছিলেন।”
স্থানীয়রা জানান, এই কারখানায় ২৪ ঘণ্টায় তিন পালায় কাজ হত।
সীমা প্ল্যান্টেরই একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুপুর ২টায় তিনি ডিউটি শেষ করে যান। এক শিফটে সেখানে ১০ জন কাজ করে।
ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে কমিটিও। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর মো. তৌহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল এলাকার সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।”
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসানকে। কমিটির সদস্যরা হলেন সীতাকুণ্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন, সীতাকুণ্ড থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ, জেলা পুলিশ সুপারের একজন প্রতিনিধি, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিপ্তরের প্রতিনিধি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রতিনিধি এবং বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রতিনিধি।
কমিটি পাঁচ কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে জানান এনডিসি তৌহিদুল ইসলাম।