বাবুলের করা মামলাতেই চলছে সাবেক এ পুলিশ সুপারের বিচার।
Published : 18 May 2023, 10:03 PM
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে বাবুলের আইনজীবীর জেরার জবাবে এ তথ্য জানান মোশাররফ।
বৃহস্পতিবার চতুর্থ দিনের মত মোশাররফকে জেরা করেন বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন। দিনের কার্যক্রম শেষে ২২ মে মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেন বিচারক।
বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন প্রশ্ন করেন, “আইও সন্তোষ কুমার চাকমা কখন আপনাকে বলেন যে- তিনি তদন্তের শেষ পর্যায়ে, বাবুল আক্তারসহ আসামিদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ পেয়েছেন?”
জবাবে মোশাররফ বলেন, “আনুমানিক মে মাসের ৪-৫ তারিখ (২০২১ সালে)।”
কফিল বলেন, “তখন তিনি এটাও বলে যে, বাবুলের মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দিবে। আপনি (মোশাররফ) মামলা করবেন বাদী হয়ে?”
উত্তরে মোশাররফ বলেন, “আইও আমাকে বলেনি; আমি নিজে বলেছি- পুলিশ বাদী না হলে আমি বাদী হব।”
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় সড়কে খুন হন মিতু। হত্যাকাণ্ডের পর নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে বাবুল আক্তার নিজেই মামলা করেছিলেন।
শুরুতে মেয়ে জামাইয়ের পক্ষে বললেও কিছুদিন পর অবস্থান বদলান বাবুল আক্তারের শ্বশুর পুলিশের সাবেক পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন।
তদন্ত করতে গিয়ে খোদ বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়ে ২০২১ সালের ১২ মে মাসে ওই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল পিবিআই। ওই দিনই চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে আট জনের নামে হত্যা মামলা করেন মিতুর বাবা মোশাররফ।
তবে আদালতের নির্দেশে সেই মামলার সমাপ্তি ঘটে এবং বাবুলের মামলাটিই পুনরুজ্জীবিত হয়। এ বছরের ৯ এপ্রিল প্রথম সাক্ষী মিতুর বাবা মোশাররফের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাবুলসহ সাত আসামির বিচার শুরু হয়।
বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন প্রশ্ন করেন, “এ মামলায় বাবুল আক্তারকে জড়ানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ১০ মে কৌশলে চট্টগ্রাম পিবিআই অফিসে মামলার বিষয়ে আলোচনার কথা বলে ডেকে এনে তাকে আটক করে?”
উত্তরে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ বলেন, এ বিষয়ে তার জানা নেই।
আইনজীবী কফিল জেরা করতে থাকেন- “২০২১ সালের ১০ মে থেকে ১৭ মে পর্যন্ত বাবুলকে পিবিআই অফিসে আটকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করে বানোয়াট বইপত্রে আপনাদের প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু কথা লিখিয়ে নেন?”
উত্তরে মিতুর বাবা বলেন, “নির্যাতন সংক্রান্তে কোনো কিছু আমার জানা নেই। ইহা সত্য নয়৷”
এরপর আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “বাবুলকে যখন সেখানে রেখে নির্যাতন করা হয়, তখন প্রত্যেক তারিখে আপনি তার আশেপাশে ছিলেন?”
মোশাররফ বলেন, “আমি আশেপাশে ছিলাম না।”
আইনজীবী কফিল বলেন, “২০২১ সালের ১১ মে থেকে ১৭ মে প্রতিদিন আপনি চট্টগ্রাম পিবিআই অফিসে গেছেন? কোন দিন কয়টায় গিয়েছেন? কতক্ষণ ছিলেন?”
উত্তরে মোশাররফ বলেন, “গিয়েছি। মামলার খোঁজ খবর নিতে। আইও’র সাথে কথা বলতে। প্রতিদিন বিকালের দিকে গিয়েছি৷ ২-৩ ঘণ্টা করে ছিলাম।”
বাবুলের আইনজীবী কফিল বলেন, “ওই কয়দিন কি বাবুল পিবিআই অফিসে ছিল?”
জবাবে মোশাররফ বলেন, “রিমান্ডে ছিল, আইওর কাছ থেকে জেনেছি।”
আইনজীবী বলেন, “বাবুলকে গ্রেপ্তারের সময় আপনি ছিলেন। কখন গ্রেপ্তার করা হয়? আপনার মামলার আগে না পরে?”
উত্তরে মোশাররফ বলেন, “আমি ছিলাম না। কখন গ্রেপ্তার করা হয়, তা জানি না।”
দুই বছর আগে মিতুর বাবা যখন থানায় মামলা করছিলেন, পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা তখন চট্টগ্রামের আদালতে যান ২০১৬ সালে বাবুল আক্তারের করা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে।
আইনজীবী কফিল প্রশ্ন করেন, “২০২১ সালের ১১ মে রাতে অত্যন্ত অস্বাভাবিকভাবে অফিস বন্ধ থাকাকালে সাক্ষ্য স্মারকলিপি অনুমোদন নেওয়া হয়। পরদিন ১২ মে সকাল আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট (বাবুলের করা মামলায়) দিয়ে ফেলে।”
জবাবে মোশাররফ বলেন, “আমার জানা নেই।”
আইনজীবী কফিল জেরায় বলেন, “বাবুলের করা মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট (চূড়ান্ত প্রতিবেদন) দেওয়ার বিষয়টি কখন, কোথায়, কার কাছ থেকে জানতে পারেন?
জবাবে মোশাররফ বলেন, “২০২১ সালের ১২ মে তারিখে দুপুরে আইও’র কাছ থেকে মোবাইলে জেনেছি। আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে।”
বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “সাক্ষ্যে বলেছেন, ওই কদিন আপনি চট্টগ্রামে আত্মীয়র বাসায় ছিলেন। চট্টগ্রামে থাকেন আপনার এমন একজন আত্মীয়র নাম বলেন?”
মোশাররফ বলেন, “নিরাপত্তার স্বার্থে আমি কারও নাম বলব না।”
এরপর আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “চট্টগ্রামে আপনার কোনো আত্মীয় নেই। সেসময় আপনি পিবিআই অফিসে ছিলেন, তা গোপন করতে এখন তথ্য দিচ্ছেন না।”
উত্তরে মোশাররফ বলেন, “ইহা সত্য নয়।”
বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন জেরায় মোশাররফের কাছে জানতে চান, “আইও সন্তোষ কুমার চাকমা কখন তদন্তের দায়িত্ব পান; কখন আপনি ও আপনার স্ত্রী তার কাছে জবানবন্দি দেন?
জবাবে মোশাররফ বলেন, “সম্ভবত ২০২০ সালের শেষে বা ২০২১ সালের শুরুতে। জবানবন্দি দেওয়ার তারিখ স্মরণ নেই।
আইনজীবী কফিল উদ্দিন প্রশ্ন করেন, “তদন্তভার পাওয়ার কতদিন পর ওই জবানবন্দি কখন কোথায় বসে দিয়েছিলেন?
মোশাররফ বলেন, “তিনি দায়িত্ব নেয়ার আনুমানিক ৩-৪ মাস পরে, আমি একবার চট্টগ্রামে এসেছি। আইও সন্তোষ কুমার চাকমা আমার ঢাকার বাসায়ও কয়েকবার গিয়েছেন। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় কথা বলি। কোন কথা থেকে জবানবন্দি নিয়েছেন, জানি না।”
মোশাররফের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, বিদেশি সংস্থার হয়ে কক্সবাজারের কর্মরত ভারতীয় এক নারীর সঙ্গে ‘পরকীয়ার’ জেরে বাবুল আক্তারের পরিকল্পনাতে মিতুকে হত্যা করে অন্য আসামিরা।
কফিল উদ্দিন জেরায় বলেন, “আইও সন্তোষ কুমার চাকমাকে দেওয়া জবানবন্দিতে বাবুল ও বিদেশি নাগরিক নারী এনজিও কর্মীকে জড়িয়ে কোনো বক্তব্য দেননি?”
জবাবে মোশাররফ বলেন, “সত্য নয়।”
এরপর আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “আইও সন্তোষ কুমার চাকমাকে উদ্ধৃত করে আপনি যা বলেছেন, তা মিথ্যা? কারণ সন্তোষ কুমার তখন হাইকোর্টে মামলার যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়, তাতে বাবুলকে জড়িয়ে কিছু বলেননি।”
জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, “ইহা সত্য নয়।”
আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “তখন পর্যন্ত বাবুলের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য প্রমাণ ছিল না? বাবুলকে এ মামলায় জড়ানোর পরিকল্পনা শুরু হয় পিবিআই হেডকোয়ার্টারে ২০২১ সালের ৯ মে। সেখানে আইও সন্তোষ কুমার ও আপনি উপস্থিত ছিলেন?
জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, “সত্য নহে।”
আইনজীবী কফিল উদ্দিন জেরায় মোশাররফকে বলেন, “আপনার সাথে ঢাকা থেকে আনা সাক্ষী মামুন ও সাইফুলকে দিয়ে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্যপূর্ণ ডকুমেন্ট সৃষ্টি করা হয় এবং সেসবের আলোকে আদালতে ২০২১ সালের ১১ মে তারিখে তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়? তাদের কাছ থেকে সাক্ষ্য নেয়ার পরই বাবুলকে মামলায় জড়াতে বই, চিরকুট সহ প্রমাণাদি সৃষ্টি করা হয়?”
উত্তরে মোশাররফ হোসেন বলেন, “এসব সত্য নয়।”
মোশাররফ হোসেন তার সাক্ষ্যে যেসব বিষয়ে কথা বলেছিলেন, সেগুলোর বিষয়ে বৃহস্পতিবার প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা জেরা করেন বাবুলের আইনজীবী।
সবশেষ মিতু হত্যার পর বিভিন্ন টেলিভিশনে মোশাররফ হোসেনের দেয়া সাক্ষাৎকারের রেকর্ড দেখিয়ে বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন জানতে চান, তখন বাবুলের পক্ষে মোশাররফ বক্তব্য দিয়েছিলেন কি না?
বিচারক এ বিষয়ে জেরার জন্য সোমবার দিন ঠিক করেন।
নাতি-নাতনিকে নিজের কাছে আনতে চান বাবুল আক্তারের শ্বশুর
আদালত কক্ষে সন্তানদের সঙ্গে বাবুল আক্তারের আবেগপূর্ণ মিলন