নাতি-নাতনিকে নিজের কাছে আনতে চান বাবুল আক্তারের শ্বশুর

মিতুর বাবা জেরায় বলেছেন, বাবুল যে ‘খুনের ছক’ আঁটছিলেন, তা এক বছর আগেই জেনেছিলেন তিনি।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2023, 02:40 PM
Updated : 16 May 2023, 02:40 PM

মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যার মামলার শুনানিতে তার দুই সন্তানকে নিজের জিম্মায় আনার আরজি বিচারককে জানালেন শিশু দুটির নানা মোশারফ হোসেন।

মঙ্গলবার চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে মামলার শুনানিতে এই আরজি জানান তিনি।

মিতুর হত্যার মামলায় তার স্বামী বাবুল গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে শিশু দুটি তাদের দাদা-দাদির বাড়িতে রয়েছে। আগের দিনের শুনানিতে আসামির কাঠগড়ায় থাকা বাবার সঙ্গে কথাও বলেছিল তারা।

শিশু দুটিকে মিতুর মা-বাবার জিম্মায় দিতে ২ মে আদালতে আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ।

মঙ্গলবার সে আবেদনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী পিপি আবদুর রশিদ বলেন, “যেহেতু আসামির (বাবুল) কাছে সাক্ষী (মিতুর ছেলে) আছে।

“ঘটনার পর তারা নানা-নানীর সাথে নানার বাড়িতেই ছিল। তাই আমরা আবেদন করেছি। তাদের এখন দেখার কেউ নেই। ছেলেমেয়েরা অপুষ্টিতে ভুগছে।”

এসময় সাক্ষী মোশাররফ আদালতের উদ্দেশে বলেন, “তাদের (নাতি-নাতনি) দাদি নেই। দাদা হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। দুই চাচা দুই জেলায় থাকেন। তাদের কে দেখছে?”

তখন আসামি বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “সন্তানরা দাদার হেফাজতে আছে। হাই কোর্টে উনারা (মোশাররফ) জিম্মা চেয়েছিলেন। আদালত বলেছে, দাদার কাছে থাকবে।

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ বলেন, “আইও চেষ্টা করেও (মিতুর ছেলের) সাথে কথা বলতে পারেনি। তারাই (বাবুলের পরিবার) হাই কোর্টে যায়। তখন উচ্চ আদালত কীভাবে জবানবন্দি নিতে হবে, সে নির্দেশনা দেয়।

“আমি বহু বছর নাতি-নাতনির দেখা না পেয়ে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বিবাদিদের হাজির হতে বলেছিল। তারা আর আদালতে হাজির হয়নি।”

এরপর বাবুলের আইনজীবী বলেন, “সন্তানদের দাদা পারিবারিক আদালতে সন্তানের জিম্মা বিষয়ে মামলা করেছে। সেটা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।”

তখন বিচারক বলেন, অন্যান্য আদালতে এ বিষয়ে একাধিক আবেদন অনিষ্পন্ন থাকায় এই আবেদনের বিষয়ে পরবর্তীতে শুনানি হবে।

Also Read: আদালত কক্ষে সন্তানদের সঙ্গে বাবুল আক্তারের আবেগপূর্ণ মিলন

Also Read: মিতু হত্যা: বাদী বাবুল আক্তার যেভাবে আসামি

খুনের ‘ছক আঁটার খবরও পেয়েছিলেন’ মিতুর বাবা

সাত বছর আগে মিতু খুন হওয়ার পর জামাতা বাবুলের পক্ষেই কথা বলেছিলেন মোশাররফ। তবে পিবিআইর তদন্তে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল জড়িত বলে চিহ্নিত হওয়ার পর জামাতাকে আসামি করে মামলা করেছিলেন তিনি।

আইনি নানা জটিলতায় এখন বাবুল বাদী হয়ে করা প্রথম মামলাতেই তার বিচার চলছে। সেই মামলায় সাক্ষ্য দিতে দাঁড়িয়ে মোশাররফ বলছেন, বাবুল এই খুনের ছক যে আঁটছিলেন, তা তারও এক বছর আগে শুনেছিলেন তিনি।

গত ২ মে আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে মোশাররফ বলেছিলেন, “বাবুল আক্তার চট্টগ্রামে ডিবি অফিসে কর্মরত অবস্থায় মুসাকে ডেকে মিতু হত্যার নির্দেশনা দেয়। তাছাড়া দু-তিনবার মেট্রোপলিটন হাসপাতালের গলিতে মুসাকে ডেকে নিয়ে মিতু হত্যার বিষয়ে আলোচনা করেন।

“বাবুল আক্তার মিশনে সুদান যাওয়ার অনুমতি পেলে, সুদানে যাওয়ার আগে মুসাকে হত্যার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে বাসার আশেপাশে রেকি করতে বলে। এও বলে, বাবুল যে এ বিষয়ে সম্পৃক্ত তা যেন কেউ জানতে না পারে।”

মঙ্গলবার তৃতীয় দিনের মতো মিতুর বাবা মামলার প্রথম সাক্ষী মোশাররফকে জেরা করেন আসামি বাবুল আক্তারের আইনজীবীরা।

বিষয়টি উল্লেখ করে মঙ্গলবার বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন জেরায় প্রশ্ন করেন, “এই পরিকল্পনার কথা কখন, কার কাছ থেকে শুনেছেন? মোবাইলে নাকি সরাসরি জেনেছেন? কোন ফোন নম্বর থেকে বলেছে?”

জবাবে মোশাররফ বলেন, “মিতু হত্যার পূর্বে শুনেছি। আনুমানিক এক বছর পূর্বে। টেলিফোনেও শুনেছি, কে বলেছে স্মরণ নেই। এবং সশরীরেও শুনেছি, মিতু বলেছে। তারিখ স্মরণে নেই। তবে ২০১৫ সালের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে। (মিতু) ফোনে নিজের ব্যক্তিগত নম্বর থেকে বলেছে।”

এরপর বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিনের প্রশ্ন ছিল, “শোনার পর আপনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, থানা-পুলিশ, আদালত বা কোথাও লিখিত কোনো অভিযোগ করেছিলেন?”

উত্তরে মোশাররফ হোসেন বলেন, “লিখিত অভিযোগ করিনি। মৌখিকভাবে বাবুলের পরিবারকে জানিয়েছি। প্রশাসনিকভাবেও মুখে জানাই।”

আসামি মুছার সঙ্গে বাবুলের হত্যা পরিকল্পনা সংক্রান্ত কোনো ছবি বা দালিলিক প্রমাণ আছে কি না- জানতে চাইলে মোশাররফ বলেন, “এ মুহূর্তে নেই।”

১ জুনের ঘটনা ও মিতুর লেখা নিয়ে জেরা

আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে মোশাররফ বলেছিলেন, খুনের চার দিন আগে ২০১৬ সালের ১ জুন আসামিরা মিতুকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। সেদিন মিতু ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে দ্রুত বাসায় ফেরায় আসামিরা সফল হয়নি।

বিষয়টি উল্লেখ করে বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন প্রশ্ন করেন, “এসব কথা আপনি মিতু থেকে শোনেন?”

জবাবে মোশাররফ বলেন, “না, মিতুর থেকে শুনিনি। এ কথা আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে এবং আইও (তদন্তকারী কর্মকর্তা) থেকে শুনি।”

কোন আসামি এবং কোন আইও’র কাছ থেকে এ বিষয়ে শোনেন- জানতে চাওয়া হলে মোশাররফ বলেন, “সম্ভবত আসামি আনোয়ার ও ওয়াসিম ২৬ জুন তারিখে যে জবানবন্দি দিয়েছিল, সেটা থেকে জানি। কামরুজ্জামানসহ পরবর্তী আইওদের থেকে শুনেছি।”

বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন প্রশ্ন করেন, “এসব জবানবন্দি আসামিরা জবানবন্দি দেওয়ার কতদিন পর জানেন?” মোশাররফ বলেন, তিনি ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তা জানতে পারেন।

২০১৬ সালের ১ জুনের ঘটনাটি মিতু কখনও বলেছিলেন কি না- প্রশ্ন করা হলে মোশাররফ বলেন, “মিতু বলেনি।”

বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন প্রশ্ন করেন, “আপনি মিতুর কাছে আসা এসএমএস লিখে রেখে যাওয়ার কথা বলেছেন। এগুলো মিতুর লেখা কি না সেটা, এক্সপার্ট দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল? মিতুর অন্য কোনো হাতের লেখার নমুনা আইওকে দিয়েছিলেন?”

জবাবে মোশাররফ বলেন, “মিতুর লেখা আমি চিনি। শনাক্ত করেছি। এক্সপার্ট দ্বারা পরীক্ষা হয়েছে কি না, জানি না। মিতুর অন্য হাতের লেখার নমুনা আইওকে দিয়েছি।”

এরপর আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “মিতুর নামে যে লেখা চিরকূট, সেগুলো আপনার কাছে ছিল না। এগুলো বাবুলকে আসামি করতে পিবিআই অফিসে সৃষ্টি করা, আপনার থেকে জব্দ করে মর্মে ২০২১ সালের ১২ মে স্বাক্ষর নেয় মাত্র?”

জবাবে মোশাররফ বলেন, “এটা সত্য নয়।”

আইনজীবী কফিল বলেন, “সেগুলো মিতুর লেখা নয় বলেই পুলিশ ও আপনি মিলে হাতের লেখা এক্সপার্টের কাছে দেননি? মিতুর কাছ থেকে বাবুলের দুটি বই পাওয়া। বইয়ে লেখা কখন কখন তারা (এনজিও কর্মী বিদেশি নাগরিক নারীর সাথে) দেখা করা এসব বাবুল ও ওই নারীর হস্তাক্ষরে লেখা আছে। এসব আপনি আগে বলেননি ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে পিবিআইর শেখানো মতে পরে বলেছেন?”

জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, “এটা সত্য নয়।”

Also Read: মিতু হত্যায় স্বামী বাবুল আক্তারের বিচার শুরুর আদেশ

বিদেশি নারী এনজিওকর্মীকে নিয়ে জেরা

সাক্ষ্যে মোশাররফ বলেছিলেন, পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল কক্সবাজারে কর্মরত অবস্থায় বিদেশি এক নারী এনজিওকর্মীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, সেই কারণে স্ত্রী মিতুকে হত্যা করেন।

মামলার আলামত হিসেব জব্দ ‘তালিবান’ ও ‘দ্য বেস্ট কেপ্ট সিক্রেট’ নামের দুটি বই ছাড়া ওই বিদেশি নারীর হস্তাক্ষর আরও কোথা দেখেছেন কি না, জানতে চান বাবুলের আইনজীবী।

জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, “না। বইতে দেখেছি।”

জেরার জবাবে মোশাররফ জানান, তিনি ওই বিদেশি নারীকে একবার দেখেছিলেন। তবে ওই নারী ও তার সন্তানের উপস্থিতির বিষয়ে কোনো দালিলিক তথ্য বা ছবি আছে কিনা প্রশ্ন করা হলে মোশাররফ বলেন, “আমার কাছে নেই।”

Also Read: পরকীয়া জেনে যাওয়ায় মিতুকে খুন করান স্বামী বাবুল: পিবিআই

Also Read: বাবুলের পরকীয়ার জেরে টাকা দিয়ে খুন, প্রথম সাক্ষ্যে অভিযোগ মিতুর বাবার

বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন প্রশ্ন করেন, “ওই নারীর কক্সবাজারে কর্মকালীন বাবুল আক্তার কতদিন সেখানে ছিলেন?” উত্তরে মোশাররফ বলেন, “বাবুল ৭-৮ মাস সেখানে ছিল। আর ওই নারী ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত কক্সবাজারে ছিল।”

এরপর বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “ওই নারী কক্সবাজার থাকাকালে বাবুল সেখানে ছিলেন মাত্র ২৮দিন।”

এছাড়া মোশাররফ হোসেনের সাক্ষ্যে আদালতে বলা মিতু-বাবুলের পারিবারিক কলহ, মিতুকে হত্যায় বাবুলের ‘পরিকল্পনা’, মিশনে সুদানে যাওয়ার আগে মুছার সঙ্গে ‘বৈঠক ও নির্দেশনা’, মিশন থেকে ছুটিতে এসে বারবার ‘তাগাদা’, চায়নায় প্রশিক্ষণে থাকাকালে মিতুকে হত্যার ‘নির্দেশনা’, বাসা বদলের সময় মিতুকে হত্যার ‘পরিকল্পনা’ বিষয়ে দেওয়া বক্তব্য নিয়ে জেরা করেন বাবুলের আইনজীবী।

এসব বিষয়ে মোশাররফ হোসেন আগে ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে এবং পরে ২০২১ সালের ১২ মে করা মামলায় উল্লেখ করেন কিনা তা জানতে চাওয়া হয়।

জবাবে মোশাররফ বলেন, “এসব বিষয়ে আইওদের বলেছি। তারা কী লিখেছে জানি না। তবে আমার মামলার এজাহারে উল্লেখ করিনি।”

Also Read: বিদেশি নারীর উপহারের বইয়ে হাতের লেখা ‘মিলে যাচ্ছে’ বাবুলের সঙ্গে