মিতু হত্যায় স্বামী বাবুল আক্তারের বিচার শুরুর আদেশ

২০১৬ সালে মিতু খুন হওয়ার পর তার স্বামী বাবুলই এ মামলা দায়ের করেছিলেন।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2023, 10:39 AM
Updated : 13 March 2023, 10:39 AM

চট্টগ্রামের মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যার ঘটনায় তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারসহ সাত আসামির বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছে আদালত।

চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিন সোমবার দুই পক্ষের শুনানি শেষে সাত আাসমির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর জন্য ৯ এপ্রিল দিন ঠিক করে দেন।

২০১৬ সালে মিতু খুন হওয়ার পর তার স্বামী বাবুলই এ মামলা করেছিলেন। নানা নাটকীয়তা শেষে পিবিআইর তদন্তের পর এখন তিনিই এই মামলার আসামি।

মামলার বাকি আসামিরা হলেন- মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, এহতেশামুল হক ভোলা, শাহজাহান মিয়া, কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা ও খায়রুল ইসলাম।

কারাবন্দি বাবুলকে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য এদিন বেলা ১২টার দিকে আদালতে হাজির করা হয়। হাজির করা হয় মুছা ও কালু ছাড়া বাকি চারজনকেও। কালু পলাতক, মুছা রয়েছেন নিখোঁজ। আসামিদের মধ্যে ভোলা জামিনে থাকা অবস্থায় আদালতে হাজিরা দেন।

শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ মামলার সাত আসামির মধ্যে কার বিরুদ্ধে কোন ধারায় কেন অভিযোগ গঠনের আবেদন করছেন, তা আদালতে উপস্থাপন করে।

চট্টগ্রাম মহানগর পিপি মো. আবদুর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আবেদন করেছিলাম। শুনানি শেষে আদালত সাতজন আসামির বিরুদ্ধেই অভিযোগ গঠন করেছেন।”

তিনি বলেন, “দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা করে মাহমুদা আক্তার মিতুকে হত্যা করা হয়েছিল। যখন আসামি বাবুল আক্তার ঢাকায় ছিলেন, তখন সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছিল।

“আসামি কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা, এহতেশামুল হক ভোলা ও মোতালেব মিয়া ওয়াসিমকে পূর্ব থেকে ভাড়া করে ও অস্ত্র সংগ্রহ করে এই হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন করেন প্রধান আসামি বাবুল। এরজন্য আগে বিভিন্ন সময় বৈঠক করে। পরে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তড়িঘড়ি করে নিজে মামলা করেছিল।”

Also Read: মিতু হত্যা: বাদী বাবুল আক্তার যেভাবে আসামি

Also Read: নিজের মামলাতেই গ্রেপ্তার বাবুল আক্তার

আসামি বাবুলের বিরুদ্ধে ৩০২, ২০১ এবং ১০৯ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। 

রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে বিচার কাজ পরিচালনার সুবিধায় আসামি বাবুলকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখার আদেশ দেয় আদালত।

এর আগে কাঠগড়ায় থাকা বাবুল নিজে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে না রাখার বিষয়ে বক্তব্য দেন। পরে বিচারক বলেন, “মামলার বিচার কাজের জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে এ আদেশ দেওয়া হলো। চিকিৎসা বা অন্য কোনো বিষয়ে আপনারা জেল কর্তৃপক্ষ এবং প্রয়োজনে আদালতের কাছেও পরে আবেদন করতে পারবেন।”

বাবুল আক্তারের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এই মামলার অভিযোগ থেকে বাবুল আক্তারের ডিসচার্জ (অব্যাহতি) চেয়ে আবেদন করেছিলাম। এর পক্ষে আমরা যুক্তিও উপস্থাপন করেছি। আদালত অভিযোগ গঠনের আদেশ দিয়েছেন।

“আমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত এডিসি প্রসিকিউশনের কক্ষে বাবুল আক্তারের সাথে এক ঘণ্টা কথা বলার অনুমতি দিয়েছেন। উনার সাথে আলাপের পর আমরা করণীয় ঠিক করব।”

এর আগে দুপুরে আদালতে ৪৫ মিনিটের দীর্ঘ শুনানিতে বাবুলের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “এ মামলায় অভিযোগ গঠনের জন্য সাফিসিয়েন্ট ডকুমেন্ট নেই। প্রথমত এ ঘটনায় প্রথম মামলাটির বাদি ছিলেন বাবুল আক্তার নিজে। সেটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ভিকটিমের বাবা বাদী হয়ে দ্বিতীয় আরেকটি মামলা করেন। পরে আবার দ্বিতীয় মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। আদালতের নির্দেশে প্রথম মামলায় অধিকতর তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিল।

“তাহলে মধ্যবর্তী ছয় মাস সময়ে দ্বিতীয় মামলায় সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত প্রথম মামলায় ব্যবহৃত হতে পারে না। দ্বিতীয় মামলায় দেওয়া জবানবন্দি কী করে প্রথম মামলায় আসল?”

আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “১১ জন সাক্ষী শুরুতে ২০১৭ সালে একবার আবার ২০২১ সালে দ্বিতীয়বার ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দিলেন। দুটো পরস্পর বিপরীত জবানবন্দি৷ যেমন ভিকটিমের বাবা মোশাররফ হোসেনের জবানবন্দি। প্রথমবার তিনি বলেছিলেন- মিতু বাবুলের দাম্পত্য জীবন ছিল ‘সুখের’। পরেরবার হয়ে গেল ‘তিক্ত’।

“ঘটনার পর যে ২৬ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল, তা বর্তমানে মামলার নথিতে নেই। কারণ তারা বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। ঘটনার সময় বাবুল ছিলেন ঢাকায়। মুছাকে দিয়ে হত্যা করানোর অভিযোগ আনা হয়েছে, মুছা কোথায়?”

“গায়ত্রী নামের একজনের সাথে সম্পর্কের কারণে স্ত্রী মিতুকে হত্যা করিয়েছেন বলে অভিযোগ। গায়ত্রী কোথায়? তাহলে কীভাবে বিচার করবেন?”

শুনানিতে পিপি মো. আবদুর রশিদ বলেন, “আসামিপক্ষ প্রশ্ন তুলেছেন এক ঘটনায় দ্বিতীয় মামলা নিতে পারে কি না? হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে অনেক রায় আছে দ্বিতীয় এফআইআর নিতে পারে। তবে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে প্রথম মামলার ভিত্তিতে।

“কীভাবে পরিকল্পনা ও টাকা লেনদেন করে হত্যাকাণ্ডটি ঘটান হয়, তা দীর্ঘ সময়ের তদন্তে বের হয়েছে। আসামিপক্ষ যেসব তথ্য উপস্থাপন করেছেন, তার বেশিরভাগ ট্রায়ালের বিষয়। এটা বিচারে প্রমাণ হবে। বাবুল আক্তার মামলার শুরুতে তড়িঘড়ি করে বাদী হওয়ার মূল কারণ, কেউ যাতে বুঝতে না পারে।”

Also Read: মিতু হত্যা: স্বামী বাবুল আক্তার আবার আলোচনায়

Also Read: বাবুল আক্তারকে কখনও দেখিওনি: বর্ণি

Also Read: বাবুল আক্তার ‘অত্যন্ত চতুর’: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মিতুকে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এসপি বাবুল তার কিছুদিন আগেই চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে ছিলেন। বদলি হওয়ার পর তিনি ঢাকায় কর্মস্থলে যোগ দিতে যাওয়ার পরপরই চট্টগ্রামে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।

ব্যাপকভাবে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল চট্টগ্রামে ফিরে মামলা করেন। পরে দুই সন্তানকে নিয়ে ওঠেন ঢাকায় শ্বশুরবাড়িতে। এর কয়েকমাস পর ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর নানা নাটকীয়তার মধ্যে পুলিশের চাকরি ছাড়েন বাবুল। তারপর শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আলাদা বাসায়ও ওঠেন তিনি।

প্রথমে বাবুলের পক্ষে বললেও ধীরে ধীরে জামাতা বাবুলকে নিয়ে সন্দেহের কথা বলতে শুরু করেন মিতুর বাবা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মোশাররফ হোসেন।

এদিকে সাড়ে তিন বছর তদন্ত করেও ডিবি পুলিশ কোনো কূলকিনারা করতে না পারার পর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার পায় পিবিআই। তারপর মুছাকে ঘিরে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে তদন্তকারীরা।

এরপর ২০২১ সালের মে মাসে পিবিআই জানায়, স্ত্রী মিতুকে হত্যা করা হয়েছিল বাবুল আক্তারের ‘পরিকল্পনায়’। আর এজন্য খুনিদের লোক মারফত তিন লাখ ‘টাকাও দিয়েছিলেন’ বাবুল।

পরে বাবুলের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর মিতুর বাবা আরেকটি মামলা করেন। তবে সেই মামলা আদালতে না টেকার পর বাবুলের মামলাটিই পুনরুজ্জীবিত হয়।

Also Read: মামলায় যে অভিযোগ দিলেন বাবুল আক্তারের শ্বশুর

Also Read: মিতু হত্যা: বাবুল আক্তারের মামলায় তার বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র

গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর সেই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পিবিআই। তাতে বাবুলের সঙ্গে ছয়জনকে রাখা হয় আসামির তালিকায়। এরপর গত ১০ অক্টোবর সেই অভিযোগপত্র গ্রহণ করে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত।

তারপর গত ৩১ জানুয়ারি মামলাটি বিচারের জন্য চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠান চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক জেুবন নেছা।

তার আগে গত ৩০ নভেম্বর পলাতক দুই আসামি মুছা ও কালুর বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। তারা আদালতে হাজির না হওয়ায় দুজনকে পলাতক দেখিয়ে চলবে বিচার।

ঘটনার কিছুদিন পর সংবাদ সম্মেলন করে মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার দাবি করেছিলে, মিতু হত্যার সপ্তাহখানেক পর তার স্বামীকে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে মুছার আর কোনো হদিস মেলেনি।

তবে পুলিশের পক্ষ থেকে মুছাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়।

Also Read: মিতু হত্যা রহস্যে আবার সেই প্রশ্ন, মুছা কোথায়?