চট্টগ্রামে মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকাণ্ডের প্রথম মামলা যেখানে গিয়ে থমকে গিয়েছিল, তদন্তের নাটকীয় দিক বদলে তার স্বামী বাবুল আক্তারকে আসামি করে দায়ের করা মামলাতেও সেই একই প্রশ্ন সামনে আসছে আবার।
Published : 13 May 2021, 10:39 PM
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের ঘনিষ্ঠ ‘সোর্স’ কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা কোথায়- তা জানতে চান তার স্ত্রী পান্না আক্তার।
এখন বাবুল আক্তার নিজেই তার স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পর মুছার অন্তর্ধান রহস্য নতুন করে সামনে আসছে।
পান্না বলছেন, এতদিন পরিবার ও তার দুই সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি ‘কিছু বলেননি’। কিন্তু এখন তিনি তার স্বামীর হদিস চান।
বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মিতু হত্যাকাণ্ডের পর আমার স্বামীকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ নেই, অথচ পুলিশের হিসাবে সে এখনো ‘নিখোঁজ‘।
“আমার স্বামী যদি অপরাধ করে থাকে তাহলে তাকে ধরা হোক, বিচার করা হোক। কিন্তু তার কোনো খোঁজ নেই। বাবুল আক্তারকে যদি এতদিন পরে এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা যায়, তাহলে আমার স্বামীর কেন খোঁজ পাব না?”
এ মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনও (পিবিআই) বলছে, মুছার সন্ধান পাওয়ার বিষয়ে তারা ‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব’ দিচ্ছে।
পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদরদপ্তরে যোগ দিতে ওই সময় ঢাকায় ছিলেন বাবুল। হত্যাকাণ্ডের পর চট্টগ্রামে ফিরে পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে তিনি মামলা দায়ের করেন।
ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য শুরুতে জঙ্গিদের সন্দেহ করা হলেও ২৬ জুন মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম ও মো. আনোয়ার নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের পর তদন্তকারীরা বলেছিলেন খুনিরা ‘পেশাদার অপরাধী’।
ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ভিডিও দেখে পুলিশ যাদের চিহ্নিত করেছিল, তাদের একজন হলেন বাবুলের ‘সোর্স’ মুছা। আদালতে ওয়াসিমের দেওয়া জবানদন্দিতেও মুছার নাম এসেছিল।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুছাই সেদিন মিতুকে হত্যার নেতৃত্ব দেন। কিন্তু মুছার খোঁজ না মেলায় হত্যার কারণ উদঘাটন করতে পারেননি গোয়েন্দারা। মামলার তদন্ত প্রতিবেদনও আর আদালতে জমা পড়েনি।
এরপর বাবুলের করা মামলাটিতে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। আর বাবুলের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন পাঁচলাইশ থানায় নিজের জামাতাকে প্রধান আসামি করে আটজনের নামে নতুন একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
সেই মামলায় বাবুলকে আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ডেও পেয়েছে পিবিআই। তদন্তকারীরা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের ‘মোটিভ’ তারা জানার চেষ্টা করছেন।
নতুন এ মামলায় বাবুলের ‘সোর্স’ মুছাকে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় নাম থাকা মুছার বড়ভাই সাইফুল আলম শিকদার সাক্কুকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
পুলিশ মুছাকে ‘পলাতক’ বললেও তার স্ত্রী পান্নার দাবি, ২০১৬ সালের ২২ জুন সকালে বন্দরনগরীর কাঠগড় এলাকার একটি বাসা থেকে তার স্বামীকে ‘পুলিশই’ তুলে নিয়ে যায়।
পান্না আক্তার বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার স্বামীকে পুলিশ নিয়ে গেছে এটা সত্য কথা। আমার সামনেই নিয়ে গেছে। এরপর থেকেই আর কোনো খোঁজ নেই তার। এতদিন পরিবার, সন্তান এবং প্রশাসনের চাপে হয়রানির ভয়ে কিছু বলিনি। মুছা ছিল বাবুল আক্তারের সবচেয়ে বড় সোর্স। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, এখন আমি মুছার সন্ধান চাই।”
তিনি বলেন, “আমি স্বামীকে হারাইছি, আমার দুই সন্তান তার বাবাকে হারাইছে। আমি এখন আর এসব বিষয় লুকায়ে রাখব না। এতদিন কীভাবে দিন পার করছি কাউকে বোঝাতে পারব না।”
১৬ ও ১৪ বছর বয়েসী দুই ছেলেকে নিয়ে পান্না আক্তার এখন থাকেন রাঙ্গুনিয়ার রানীরহাট এলাকায় গ্রামের বাড়িতে।
তিনি জানালেন, এক সময় সৌদি আরবে ছিলেন তার স্বামী। ২০০২ সালে দেশে ফিরে বালু সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেন। তখনই পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার ‘সখ্য’ গড়ে ওঠে।
২০০৩ সালে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুর আক্তারের সাথে পরিচয় হওয়ার পর মুছা তার ‘সোর্স’ হিসেবে কাজ শুরু করে বলে পান্নার ভাষ্য।
তিনি দাবি করেন, ২০১৬ সালের ৫ জুন মিতু হত্যাকাণ্ডের দিন সকালে মুছা তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাকলিয়া এলাকার কালামিয়া বাজারের বাসাতেই ছিলেন। বাবুল আক্তারের স্ত্রীর হত্যাকাণ্ডের খবর তারা জানতে পারেন টেলিভিশনের খবর দেখে।
“ওই বাসায় থাকার সময় আমার স্বামী আদালতে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ঠিক করেছিল, ২২ জুন আদালতে যাবে। কিন্তু ওইদিন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে পুলিশ এসে মুছাকে তুলে নিয়ে যায়। তখন থেকে তার আর কোনো সন্ধান নাই।”
সেদিন মুছাকে ‘তুলে নেওয়ার’ সময় তার ভাই সাইফুল আলম শিকদার সাক্কুও পুলিশের সঙ্গে ছিলেন বলে ২০১৬ সালের ৪ জুলাই করা সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিলেন পান্না আক্তার।
তখন পুলিশ দাবি করেছিল, মুছাকে ধরা যায়নি বরং তার দেশত্যাগ ঠেকাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিমান ও স্থলবন্দরে বার্তা দেওয়া হয়েছে। এখনও পুলিশের সেই বক্তব্য বদলায়নি।
মিতু হত্যার সঙ্গে মুছার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে কী জানেন- এমন প্রশ্নে পান্না বলেন, “আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু সে কখনো খোলাসা করে কিছু বলেনি। তবে পুলিশ তুলে নিয়ে যাবার আগে একবার ফোনে বলতে শুনেছি... ‘আমি সমস্যায় পড়ে গেছি। আপনার কথায় বিশ্বাস করে কাজ করেছি। আমার পরিবারের কিছু হলে মুখ খুলতে বাধ্য হব স্যার’।
“২০০৩ সাল থেকে আমার স্বামী বাবুল আক্তারের বিশ্বস্ত সোর্স ছিল। বাবুল সাহেবের যত কাজ, প্রায় সব কিছুর পেছনে মুছার ভূমিকা ছিল। বাবুলের সাথে মুছার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তিনি বিদেশে গেলেও আমার স্বামীর সাথে যোগাযোগ রাখতেন।”
পান্না আক্তার বলেন, “আমার স্বামীর খোঁজ পেলে হয়ত অনেক কিছুই জানা যাবে। আমি তার খোঁজ চাই।
মুছা এখন কোথায়, সেই প্রশ্নের উত্তর মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআইয়ের কাছেও নেই।
পান্নার বক্তব্যের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, “মুছাকে গ্রেপ্তার করাটা আমাদের টপ প্রায়োরিটি। তাকে পাওয়া গেলে অনেক কিছু খোলাসা হয়ে যাবে।”