আওয়ামী লীগ ও বাম ধারার আইনজীবীরা বলছেন, কয়েক দফায় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা করেও তারা ‘বাধার মুখে’ ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
Published : 10 Apr 2025, 09:53 PM
চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের নির্ধারিত দিনে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা ছাড়া অন্য কেউ ফরমই তুলতে পারেননি বলে অভিযোগ উঠেছে।
আওয়ামী লীগ ও বাম ধারার আইনজীবীরা বলছেন, কয়েক দফায় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা করেও তারা ‘বাধার মুখে’ ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
এমনকি এলডিপি সমর্থিত এবং জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালের বর্তমান পিপিও সভাপতি পদের প্রার্থী হতে ফরম নিতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ার কথা বলেছেন।
বৃহস্পতিবার দিন শেষে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ২১টি পদে মনোয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ২১টিই।
নির্বাচন কমিশন অবশ্য বলছে, কতটি ফরম বিক্রি হয়েছে তারা তা ‘জানে না’। আর নির্বাচন আয়োজনের জন্য গঠিত অ্যাডহক কমিটির প্রধানের দাবি, তারা নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের ‘খুঁজে পাচ্ছেন না’।
ফরম নিতে না পেরে আইনজীবীদের একটি পক্ষ অ্যাডহক কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। অ্যাডহক কমিটি সেই অভিযোগ নির্বাচন কমিশনকে পাঠিয়েছে বলে দাবি কমিটির আহ্বায়কের।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ১৩২ বছরের ইতিহাসে নির্বাচন ঘিরে এমন ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন ও আইন অঙ্গনেই আইনের লঙ্ঘন’ বলে বর্ণনা করেছেন একজন আইনজীবী।
আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা বলছেন, গত ১৬ বছরে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সকল মত ও পথের আইনজীবীরা অংশগ্রহণ করেছে। তখন ভোটে অংশ নিতে কাউকে বাধা দেওয়া হয়নি।
মঙ্গলবার ঘোষিত তফসিল অনুসারে বৃহস্পতিবার বেলা ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত সমিতির কার্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে ফরম বিতরণের কথা ছিল।
সে অনুসারে বিএনপি-জামায়াতপন্থি প্যানেল আইনজীবী ঐক্য পরিষদের প্রার্থীরা একে একে ফরম সংগ্রহ করেন।
আগে আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা চট্টগ্রাম বারে আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের ব্যনারে নির্বাচনে অংশ নিতেন। এবার শুরু থেকেই আওয়ামী ও সমমনারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা জানায়।
আগের তফসিলেও তারা স্বতন্ত্র হিসেবে ফরম নিয়েছিলেন। এবারও প্রার্থী হতে বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটার দিকে তারা একযোগে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে যান।
সভাপতি পদে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক আবদুর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ফরম নিতে গিয়েছিলাম। ১০ ফেব্রুয়ারি যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল তাতেও আমি সভাপতি প্রার্থী ছিলাম। আজ ফরম নিতে গিয়ে দেখি বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীরা লাইব্রেরিতে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয় দখল করে রেখেছে।
“তারা আমাদের ফরম সংগ্রহ করতে বাধা দেয়। আমরা কোনো ঝামেলায় যাইনি। ফিরে এসে অ্যাডহক কমিটিকে সব জানাই। অ্যাডহক কমিটির পরামর্শে আবারও ফরম নিতে যাই। তখনও আমাদের বাধা দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা কোনো ঝামেলায় যাইনি।”
আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের নেতা ও সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়া উদ্দিনের নেতৃত্বে তারা অ্যাডহক কমিটিকে বিষয়টি জানান। অ্যাডহক কমিটি আবারও ফরম নিতে চেষ্টা করতে বলে তাদের আশ্বস্ত করেন।
দ্বিতীয় দফায় যখন আওয়ামী ও সমমনারা ফরম নিতে যান, সেসময় লাইব্রেরির বাইরে অবস্থান নেওয়া আইনজীবীদের একটি পক্ষ ‘ফ্যাসিস্ট’ ও ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। নির্বাচন কমিশনাররা যে কক্ষে ছিলেন, তার সামনে তারা অবস্থান নিয়ে ছিলেন।
সাবেক পিপি আবদুর রশিদ বলেন, “শুধু আমাদের নয়, একজন এলডিপি করা আইনজীবীকেও তারা ফরম নিতে দেয়নি। তারা খালি পোস্টে গোল দিতে চায়।”
তিনি বলেন, “পুরো বিষয়টি জানিয়ে আমরা অ্যাডহক কমিটিকে লিখিত অভিযোগ করেছি। দেখি তারা কী ব্যবস্থা নেয়।”
সভাপতি প্রার্থী হতে ইচ্ছুক জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালের বর্তমান পিপি ও এলডিপি নেতা শাহাদাত হোসেন ফরম নিতে যান বেলা আড়াইটায়।
ঘটনার বর্ণণা দিয়ে শাহাদাত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি ফরম নিতে প্রয়োজনীয় টাকা ও কাগজপত্র নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সামনে হাজির হই। কিন্তু তারা আমাকে ফরম নিতে দেবে না। এসময় আমাকে ধাক্কা দিয়ে তারা বের করে দেয়।
“অথচ ২১টি পদে নির্বাচন কমিশন ২১টি ফরম বিক্রি করেছে। বাধাদানকারীরা বলছে, ফ্যাসিবাদের দোসরদের নির্বাচনে অংশ নিতে দেবে না। আমি তো ফ্যাসিবাদের দোসর না। আমি একজন পিপি হয়ে ফরম নিতে পারিনি। কোথায় গণতন্ত্র, কোথায় মানবাধিকার? সমিতির ইতিহাসে এরকম কোনো নজির নেই।”
শাহাদাত হোসেন যখন মনোনয়ন ফরম তুলতে যান, সেসময়ের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
তাতে দেখা যায়, শাহাদাত হোসেন নির্বাচন কমিশনের মুখ্য নির্বাচন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট তারিক আহমদকে বলছেন, তিনি সভাপতি পদে একটি ফরম নিতে আগ্রহী।
এসময় তারিক আহমদ তাকে বসতে বলেন এবং তার সাথে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখনই কয়েকজন আইনজীবী মুখ্য নির্বাচন কর্মকর্তা তারিক আহমদকে ইতিপূর্বে ফরম নেওয়া প্রার্থীদের সাথে ছবি তুলতে জোর করতে থাকেন।
তারিক আহমদ নিজের চেয়ারে বসে তাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। এক পর্যায়ে বাধাদানকারীরা শাহাদাত হোসেনকে বলেন, এখনো সময় আছে আপনি পরে ফরম তুলেন। পরে কয়েকজন এসে তাকে বাইরে নিয়ে যায়।
শাহাদাত হোসেন বলেন, “ফরম নিতে না পেরে আমি অ্যাডহক কমিটির কাছে গিয়েছিলাম। অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক ফোন করলে মুখ্য নির্বাচন কর্মকর্তা প্রথমবার কল রিসিভ করেন। পরে তিনি আর ফোন ধরেননি।”
বাধা দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করলে বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবী ঐক্য পরিষদের সভাপতি প্রার্থী অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার বলেন, “আমরা ২১ জন ফরম নিয়েছি। অন্যরা ফরম নিতে না এসেই কুৎসা রটনা করছে। তাদের সৎ সাহস নেই। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সময় যারা ছাত্র-জনতার উপর লাঠি নিয়ে হামলা করেছিল, তারাই এসব প্রচার করছে।
“জুলাই আন্দোলনের সময় কারা ছাত্রদের ওপর এখানে হামলা করেছিল তার ভিডিও ফুটেজ আছে। সাধারণ আইনজীবীরা তাদের বিপক্ষে। ফ্যাসিস্ট ছাড়া নির্বাচন করবেন বলে দাবি করেছেন সাধারণ আইনজীবীরা।”
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন কিনা–এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুস সাত্তার বলেন, “মাত্র ফরম তোলা হয়েছে। কাল বাছাই হবে। শনিবার চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে। তারপর প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে হয়ত রোববার আমাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। সেটা নির্বাচন কমিশন ভালো বলতে পারবে।”
গত ৪ ফেব্রুয়ারি আগের নির্বাচন কমিশন ‘বিভিন্নভাবে হেনস্তা, ভয়ভীতি ও হুমকির সম্মুখীন’ হওয়ার কথা বলে সমিতির নির্বাচিত কমিটির কাছে পদত্যাগপত্র দিয়েছিল।
নির্বাচন না হলেও ১০ ফেব্রুয়ারি সমিতির নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ১৬ ফেব্রুয়ারি সমিতির সাধারণ সভায় ৫ সদস্যের একটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়। পরদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি অ্যাডহক কমিটিকে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির বিধান অনুসারে ৬০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসেবে ১৬ এপ্রিল তাদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সেদিনই ভোটগ্রহণের তারিখ ধার্য করা হয় মঙ্গলবার ঘোষিত তফসিলে।
জানতে চাইলে অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক এ কে এম মকবুল কাদের চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিয়েছি। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। ফরম নিতে গিয়ে স্লোগান পাল্টা স্লোগান হয়েছে বলে শুনেছি। কেউ যদি স্লোগানে দাঁড়াতে না পারে সেটা…।”
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “কেউ ফরম না নিলে তো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতাতেই নির্বাচিত হয়।”
কতজন ফরম নিয়েছে এবং বাধার বিষয়ে কী করবেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন বলতে পারবে কতজন ফরম নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে তোমরা আমরা ফোনে পাচ্ছি না।”
ফরম না নিতে পারা প্রার্থীরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছে কিনা এবং এ বিষয়ে কমিটি ব্যবস্থা নেবে কিনা জানতে চাইলে মকবুল কাদের চৌধুরী বলেন, “তারা একটি লিখিত আপত্তি দিয়েছে। সেটা আমরা নির্বাচন কমিশনকে পাঠিয়েছি। আমাদের মেয়াদ তো ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত।
“কাউকে ফরম নিতে না দিলে সেটা নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে দেখবে। কমিশন আমাদের রিপোর্ট দিলে তারপর আমরা দেখব।”
মুখ্য নির্বাচন কর্মকর্তা তারিক আহমদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের অফিসের বাইরে কিছু ঘটলে সেটা দেখতে তো আমরা পারব না। কেউ আমার কাছে না এলে, কীভাবে ফরম দেব?”
ফরম বিক্রির সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কতজন ফরম নিয়েছেন সেটা গুনিনি এখনো। কালকে গুনে বাছাই শেষে বলতে পারব।”
আওয়ামীপন্থীদের লিখিত অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে তারিক আহমদ বলেন, “আমাকে অভিযোগ দেয়নি। উনারা কাকে অভিযোগ দিয়েছেন সেটা আমি জানি না।”
নির্বাচন নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির বিষয়ে সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়া উদ্দিন বলেন, “চট্টগ্রাম বারের ১৩২ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। আমরা ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিলাম। বহুবার বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ নানা পদে বিজয়ী হয়েছেন।
“এখানে সবাই আইনজীবী। এখানে দলীয় বিষয় নিয়ে বিরোধ কখনো ছিল না। আইনের মানুষ হওয়ায় আজকেও আমরা গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাদের চক্ষুলজ্জাও নেই। অ্যাডহক কমিটিকে অভিযোগ দিয়েছি। দেখি তারা কী ব্যবস্থা নেয়।”
সমিতির সদ্য বিদায়ী কমিটির সভাপতি নাজিম উদ্দিন বলেন, “আজ ফরম সংগ্রহকে ঘিরে কি ঘটেছে সেটা আমি বিস্তারিত জানি না। কিন্তু আশা করেছিলাম সবার অংশগ্রহণে ভোট হবে।”
পুরনো খবর-
নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ, ঝুলে গেল চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির ভোট