একাধিক আইনজীবী বলেছেন, বহিরাগতরা আদালতের বিষয়ে সম্পৃক্ত হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং চট্টগ্রাম বারের ঐতিহ্য নষ্ট হয়েছে।
Published : 04 Feb 2025, 09:08 PM
ভোট গ্রহণের ছয়দিন আগে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন আয়োজনে গঠিত নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করেছে।
চট্টগ্রামে জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন পরিচালনার জন্য গঠিত ৫ সদস্যের নির্বাচন কমিশন তাদের পদত্যাগপত্রে বিভিন্নভাবে ‘হেনস্তা, ভয়ভীতি ও হুমকির সম্মুখীন’ হওয়ার কথা বলেছেন।
নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করায় আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি সমিতির নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হচ্ছে না। ওইদিনই সমিতির বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ‘নজিরবিহীন’ উল্লেখ করে আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলছেন, গঠনতন্ত্র অনুসারে এখন সাধারণ সভা করে ৫ সদস্যের অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হবে। অ্যাডহক কমিটি দুই মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করবে।
যা বলা হয়েছে পদত্যাগপত্রে
মঙ্গলবার আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবরে দেওয়া পদত্যাগের চিঠিতে নির্বাচন বলা হয়েছে, “বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুকূল না থাকা স্বত্ত্বেও আমরা অত্যন্ত আশাবাদ ও উৎসাহ নিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলাম।
“আজ আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ একটি দরখাস্ত দিয়ে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগের প্রস্তাব করে। অপরদিকে ঐক্য পরিষদ বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সমর্থক আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের মনোনয়ন বাতিলের জন্য আবেদন করে।”
এ দুটি আবেদনই সমিতির গঠনতন্ত্র বর্হিভূত উল্লেখ করে পদত্যাগপত্রে বলা হয়, “নির্বাচন কমিশন চায় না সমিতির কোনো সদস্য পুলিশ, সেনাবাহিনী অথবা অন্য কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হেনস্তার শিকার হয়। এবং আইনজীবী সমিতি ও আইনজীবী সমিতির কোনো সদস্যের ঐতিহ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।”
পদত্যাগপত্রে নির্বাচন কমিশন বলেছে, “উভয়পক্ষের পারস্পরিক অবস্থান নির্বাচনের প্রতিকূল হওয়ায় এবং নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে বিভিন্নভাবে হেনস্তা, ভয়ভীতি ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
“এমতাবস্থায় আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন সুষ্ঠু পরিবেশে সম্পন্ন করার কোনো সুযোগ বা পরিবেশ বিদ্যমান নেই বিধায় নির্বাচন কমিশন সর্বসম্মতভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে অপারগতা প্রকাশ করে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।”
জানতে চাইলে মুখ্য পদত্যাগী কমিশনের নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোলায়মান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের যা বক্তব্য এবং কী কারণে আমরা পদত্যাগ করেছি তা লিখিতভাবে সমিতিকে আমরা জানিয়েছি। এছাড়াও অনেক বিষয় আছে, যার সবকিছু এখন বলা সম্ভব নয়।”
পাল্টাপাল্টি দোষারোপ
এদিকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতাকারী দুই পক্ষ এই পরিস্থিতির জন্য একে অপরকে দুষছে। পাশাপাশি ‘বহিরাগতরা’ আদালত অঙ্গনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সম্পৃক্ত হওয়ায় এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন সাধারণ আইনজীবীরা।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন আয়োজনের জন্য ২৬ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু ৫ সদস্যের ওই কমিটিতে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ আছে এমন অভিযোগ উঠে। পরে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা হয়। এরপর আরও দু’বার নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। সবশেষ ১৪ জানুয়ারি মোহাম্মদ সোলায়মানকে প্রধান করে চতুর্থবারের মত নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়।
এরমধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। বাছাই শেষে ২১ পদে ৪০ জন প্রার্থী চূড়ান্ত হয়। তারা সবাই ভোটের জন্য প্রচারও চালাচ্ছিলেন পুরোদমে।
এবারের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা আইনজীবী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এবং আওয়ামীপন্থি ও সমমনারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। যদিও অতীতে আওয়ামীপন্থিরা আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিতেন।
এর মধ্যে গত ২৬ জানুয়ারি আদালত প্রাঙ্গণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার এবং তারা যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন সেই দাবি জানানো হয়।
বিএনপি-জামায়াতপন্থিদের প্যানেল আইনজীবী ঐক্য পরিষদ থেকে সভাপতি প্রার্থী আবদুস সাত্তার বলেন, “এক মাস ধরে পেশাগত কাজের ক্ষতি করে আমরা প্রচার চালাচ্ছি। আওয়ামী আইনজীবীরা ভোটের দিন সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইছে, অথচ আমরা তাদের প্রচারণায় কোনো বাধা দিইনি।
“তারা নিজেরা প্রচার করেছে, তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। আবার তারাই সেনাবাহিনী চেয়ে দরখাস্ত দিয়েছে। আমরা বাধা দিলে তো তারা নমিনেশনও দাখিল করতে পারত না। প্রচারের শেষ পর্যায়ে নির্বাচন ভণ্ডুল হওয়া খুব দুঃখজনক।”
অন্যদিকে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের পক্ষে এবারের নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মুহম্মদ ফখরউদ্দিন জাবেদ বলেন, “এবার সমন্বয় পরিষদ কোন নির্বাচন করছে না। আমরা স্বতন্ত্র প্রার্থী। আমাদের নির্বাচন করতে দিবে না বলে আদালত অঙ্গনে মিছিল মিটিং হয়েছে। নির্বাচন বানচালের হুমকিও ইতিপূর্বে দেওয়া হয়েছে।
“এমন পরিস্থিতিতে আমরা শুধু বলেছি, ভোটগ্রহণের দিন যাতে বাইরের কেউ আসতে না পারে সেজন্য আইডি কার্ড দেখে শুধু সমিতির সদস্যদের অংশগ্রহণে নির্বাচন করার জন্য। এটাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।”
নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের ভিতরে গিয়ে তাদের চাপ দেওয়া হছে। তাই তারা পদত্যাগ করেছেন।”
এই অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে ঐক্য পরিষদের সভাপতি প্রার্থী আবদুস সাত্তার বলেন, “স্বৈরাচারের দোসরদের বিরুদ্ধে সাধারণ আইনজীবীরা মিছিল করেছে। আমরা প্রচারণায় কোনো বাধা দিইনি।”
নির্বাচন আয়োজন করবে অ্যাডহক কমিটি
নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ ও পরবর্তী করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “নির্বাচন কমিশনের সকল সদস্য পদত্যাগ করেছেন। একারণে এখন আর ভোটগ্রহণ সম্ভব নয়।
“গঠনতন্ত্র অনুসারে অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হবে সমিতির সাধারণ সভায়। হয়ত ১১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ সভা করা হবে। অ্যাডহক কমিটি ২ মাসের মধ্যে নির্বাচন করবে। এটাই আমাদের গঠনতন্ত্রে আছে। নির্বাচন আয়োজনে আমাদের সব চেষ্টা ছিল। চারবার আমরা নির্বাচন কমিশন গঠন করেছি। আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না।”
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ১৩২ বছরের ইতিহাসে এমন নজির নেই জানিয়ে একাধিক আইনজীবী বলেছেন, বহিরাগতরা আদালত অঙ্গনের বিষয়ে সম্পৃক্ত হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং চট্টগ্রাম বারের ঐতিহ্য নষ্ট হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “সবমিলিয়েই আমাদের ঐতিহ্য নষ্ট হয়েছে। মার্চ ফর জাস্টিসে আমাদেরই কিছু আইনজীবী হামলা করেছিলেন। ৪ অগাস্ট লাঠি নিয়ে কিছু আইনজীবী গিয়েছিলেন। আমরাই ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারিনি।
“যারা সেদিন এসব কাজে সম্পৃক্ত ছিল তাদের সরকার তো এখন ক্ষমতায় নেই। নির্যাতিতরা বলছেন তারা প্রতিশোধ নিবেন। এখন যখন বলছি, ঐতিহ্য রক্ষা করতে তখন এক পক্ষ বলছে জুলাই আন্দোলনে হামলার সময় ঐতিহ্য কোথায় ছিল? নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা কেউ সচেষ্ট নই।”
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির বর্তমান কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ১৩টি পদে আছেন বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদের নেতারা।
গত বছর হওয়া সমিতির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ ৭টি পদে জয়ী হয়েছিল। আর একটি পদে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন।