আরেক সাক্ষী সরওয়ার আলমকে মঙ্গলবার জেরা করা হয়েছে।
Published : 18 Jul 2023, 09:00 PM
চট্টগ্রামে মাহমুদা আক্তার মিতু খুন হওয়ার তিন দিনের মাথায় তার স্বামী বাবুল আক্তারের বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদারের কথায় তার এক কর্মচারী তিন লাখ টাকা পাঠিয়েছিলেন তিনজনকে, যাদের দুজন এ মামলার আসামি।
মঙ্গলবার চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে এ তথ্য জানান সেই কর্মচারী মোখলেসুর রহমান ইরাদ।
তিনি ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলায় বাবুলের ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল ইসলামের ‘মাল্টিয়ার প্রিন্ট অ্যান্ড প্যাক’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন।
সাইফুল ও ইরাদ দুজনই ২০২১ সালে আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে কয়েকটি মোবাইল নম্বরে টাকা পাঠানোর কথা বলেছিলেন, সে কথা পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনেও এসেছিল।
মঙ্গলবার আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে মোখলেসুর রহমান ইরাদ বলেন, “২০১৬ সালের ৫ মে কোম্পানির এমডি সাইফুল ইসলাম স্যার আমাকে অ্যাকাউন্টস থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে বাবুল আক্তার স্যারের সাথে কথা বলতে বলেন।
“তিনি বলেন, ‘বাবুল আক্তার স্যারের প্রমোশন হয়েছে। যেখানে মিষ্টি পৌঁছাতে বলে, সেখানে পৌঁছাবে।’ উনার ফোন নম্বর দেন। আমি বাবুল স্যারকে ফোন দিই। তিনি আমাকে ৬ কেজি মিষ্টি, ২ কেজি করে আলাদা আলাদা তিন রকম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের পাশে উনার বোনের বাসায় দিয়ে আসতে বলেন। ওই প্রথম আমি বাবুল আক্তার স্যারকে ফোন দিই।”
বাবুল আক্তারের সাথে সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়ে ইরাদ বলেন, “২০১৬ সালের ৫ জুন মিতু ভাবি মার্ডারের দুদিন পর সাইফুল স্যার আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাবুল আক্তার স্যারের শ্বশুরবাড়ি বনশ্রীর মেরাদিয়া ভুঁইয়া পাড়া, সেখানে যায়। সেখানে বিকাল ৩টা পর্যন্ত অবস্থান করি। দুপুরের খাওয়া দাওয়া ওখানে করি।
“ইতোমধ্যে বাবুল স্যারের ছেলে-মেয়ে মাহির ও তাবাসসুমের সাথে সেলফি তুলি। সেটা আমার ফেসবুকে আপলোড করি। পরে আনুমানিক তিনটা বাজে, এমডি সাইফুল স্যার আমাকে দ্রুত অফিসে যেতে বলেন। আমি মোহাম্মদপুর বছিলায় আমাদের অফিসের অ্যাকাউন্টেন্ট মামুনের কাছ থেকে তিন লক্ষ টাকা গ্রহণ করি।”
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ইরাদ বলেন, “এরপর সাইফুল স্যারকে ফোন দিই, টাকাটা কী করব? তখন সাইফুল স্যার বলেন, তুমি তো বাবুল স্যারের বোনের বাসা চিনই। সেখানে টাকাটা পৌঁছে দিয়ে আসো। টাকাটা বাবুল আক্তার স্যারের বোনের বাসায় দিয়ে আমি অফিসে চলে আসি।
“পরে আর সাইফুল স্যারকে আনতে বাবুল আক্তারের শ্বশুরবাড়িতে যাইনি। ওইদিন রাত ১০টার দিকে সাইফুল স্যারকে আদদ্বীন হাসপাতাল থেকে নিয়ে উনার বাসায় পৌঁছে দিয়ে কর্মদিবস শেষ করি।”
ইরাদ সাক্ষ্যে জানান, পরদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে সাইফুল আবার তাকে ফোন দিয়ে আবদুল্লাহ আল মামুন নামের একজনের ফোন নম্বর দেয়।
“আগের দিনের ওই তিন লক্ষ টাকা বাবুল আক্তার স্যারের বোনের বাসা থেকে নিতে বলেন। টাকাটা যখন রিসিভ করি তখন বাবুল আক্তার স্যারের বাবাও সেখানে ছিলেন। টাকাটার সাথে দুটো মোবাইল নম্বরও পাই। নামসহ। আনোয়ার এবং ওয়াসিম।”
ওই মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম এবং আনোয়ার হোসেন এখন মিতু হত্যা মামলার আসামি।
ইরাদ বলেন, “এরপর সাইফুল স্যারকে আবার ফোন দিই। উনি আমাকে ওই তিনটা নম্বরে এক লক্ষ করে মোট তিন লক্ষ টাকা বিকাশ করতে বলে। তিনটাই বিকাশ পারসেনাল, গ্রামীণ নম্বর।
“আমি আবুল কালাম আজাদ স্যারের (বাবুল আক্তারের ভগ্নিপতি) বাসার দোতলা থেকে নেমে আসতেই, নিচে বাবুল আক্তারের বাবা বলেন ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ বললাম, বাবুল স্যারের টাকা বিকাশ করব। তিনি আমার সাথে যেতে চাইলেন। আমি উনার সাথে সেলফি তুললাম এবং ফেসবুকে তখনই সেটা আপলোড করলাম।”
ইরাদ বলেন, “পরবর্তীতে অফিসের মোটর সাইকেল নিয়ে আমি ও বাবুল স্যারের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে গাউছুল আজম মার্কেটের নিচতলায় বিকাশের দোকানে যাই। এ সময় বাবুল স্যারের বাবা বলেন, ‘আমি বাইরে থাকি তুমি যাও’।
মিতু হত্যায় স্বামী বাবুল আক্তারের বিচার শুরুর আদেশ
মিতু হত্যা: বাদী বাবুল আক্তার যেভাবে আসামি
“আমি ওখান থেকে ২ লক্ষ ৩০ হাজার টাকার মত সেন্ড করতে পারি। তারপর আমি বাবুল আক্তারের বাবাকে বাবুল স্যারের বোনের বাসায় রেখে অফিসে চলে যাই। এরপর সাইফুল স্যারকে জানাই, ৭০ হাজার টাকা বাকি আছে। তখন আমাদের অফিসের পাশের রিপন টেলিকম থেকে ৭০ হাজার টাকা রাত ৯টার পাঠাই।”
আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে ইরাদ বলেন, “দীর্ঘদিন পরে ২০২১ সালের ২২ মে আমাকে পিবিআই পাবনা অফিস থেকে ফোন দেয়। ২৪ মে আমি পিবিআই অফিসে যাই। তারা একটি কাগজ দিয়ে চট্টগ্রাম পিবিআই অফিসে আসতে বলে।
“পিবিআই কর্মকর্তারা বলেন, টাকা লেনদেনের বিষয়টি তদন্তে উঠে এসেছে। তোমাকে চট্টগ্রাম যেতে হবে। তুমি একা একা যাবে, আমাদের সাথে চলো। আমি, বাড়িতে ফোন করে তাদের সাথে রওনা হই। ঢাকা আসার পর গাড়ি চেঞ্জ হয়, অন্য গাড়িতে আমি উঠি। তখন পিবিআইর লোকজন চেঞ্জ হয়।
“তারা বিকাশের দোকানগুলো চিনিয়ে দিতে বলে। দোকানগুলো চিনিয়ে দিই সে রাতে। তারপরে আমাকে আবার বলে যেখান থেকে টাকা নিয়ে এসেছো, সেটা দেখিয়ে দাও। সেটা ছিল বাবুল আক্তারের বোনের বাসা। পরে আমাকে চট্টগ্রামের পাহাড়তলি পিবিআই অফিসে নিয়ে যায়, তখন রাত ৪টা।”
ইরাদ বলেন, “চট্টগ্রামের পিবিআই অফিসের পঞ্চম তলার একটি কক্ষে বিশ্রাম নেওয়ার পর সেদিন (২৫ মে ২০২১) সকাল ৯টার দিকে পিবিআইর একজন অফিসার সন্তোষ চাকমা আমার বিবরণ শোনেন। পরে আমার ছবিগুলো মোবাইলে পায়। তখন ফোনটা জব্দ করে।
“জব্দ তালিকার একটি কপি আমাকে দেয়। সন্তোষ স্যার আমাকে দুপুর ২টার দিকে কোর্টে নিয়ে আসে। ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের কাছে আমি জবানবন্দি দিই। উনি লিখে নেন। পরে পিবিআইর অফিসার আমাকে ঈশ্বরদীর বাসে তুলে দেন।”
পরে সাক্ষী ইরাদকে জেরা করেন বাবুলের আইনজীবী কামরুল ইসলাম সাজ্জাদ ও কফিল উদ্দিন।
জেরায় প্রশ্নের জবাবে ইরাদ জানান, মিতু হত্যার দুদিন পর বাবুলের শ্বশুরের বাসাতেই প্রথম ও শেষবার তিনি বাবুল আক্তারকে দেখেছিলেন।
নিজের মামলাতেই গ্রেপ্তার বাবুল আক্তার
মিতু হত্যা: বাবুল আক্তারের মামলায় তার বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র
পাবনা থেকে চট্টগ্রাম পিবিআই অফিস পর্যন্ত কীভাবে আসেন সে বিষয়ে আইনজীবী কফিল উদ্দিনের একাধিক প্রশ্নের জবাবে ইরাদ বলেন, “পিবিআইর যে গাড়িতে পাবনা থেকে ঢাকা আসি- সেটাতে তিন জন পুলিশ ছিল। সেদিন সন্ধ্যার দিকে গুলশানে পৌঁছালে গাড়ি বদল করি।
“তারপর যে দোকানগুলো থেকে বিকাশ করি সেখানে যাই। রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। সেটাও পিবিআইর গাড়িতে। সে গাড়িতে চারজন পুলিশ ছিল।”
জেরায় বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন প্রশ্ন করেন, “বাবুলের বোনের বাসায় টাকা দিয়েছেন সেটা পুলিশকে, ম্যাজিস্ট্রেটকে এবং আজকেও বলেছেন৷ টাকা কার হাতে দিয়েছেন সেটা কখনো বলেননি।” জবাবে ইরাদ বলেন, ‘বলেছি, উনার ভগ্নিপতির হাতে দিয়েছি’।”
নিজের অফিস থেকে এমডি সাইফুলের কথায় তিন লাখ টাকা তুললেও এ সংক্রান্ত কোনো রশিদ, রিকুইজিশন স্লিপ বা টাকা হস্তান্তরের কোনো রশিদ নেননি বলে জেরার জবাবে জানান ইরাদ।
কোন দিন তিনটি মোবাইল নম্বরে টাকা পাঠিয়েছিলেন প্রশ্নের জবাবে তাও সুনির্দিষ্ট ভাবে জানাতে পারেননি ইরাদ। যে তিনটি নম্বরে টাকা পাঠিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন, তার মধ্যে শুধু আবদুল্লাহ আল মামুন নামের এক ব্যক্তির ফোন নম্বর তার জব্দ হওয়া ফোনে আছে বলে জানান ইরাদ।
তিনি বলেন, “ওয়াসিম ও আনোয়ারের নম্বর স্লিপে ছিল। সেটা বিকাশের দোকানে দিছিলাম ফেরত নিইনি।”
এর আগে দুপুরে এই মামলায় আরেক সাক্ষী সরওয়ার আলমকে জেরা করেন বাবুলের আইনজীবী।
আগের দিন সোমবার আদালতে সাক্ষ্য দেন নিরাপত্তাকর্মী সরওয়ার, যিনি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করা ভারতীয় নারীর কক্সবাজারের বাসায় কাজ করতেন।
একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার হয়ে ওই ভবনে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছিলন সরওয়ার। মঙ্গলবার তাকে জেরা করেন বাবুলের আইনজীবীরা।
২০১৬ সালে মিতু খুন হওয়ার পর তার স্বামী বাবুলই এ মামলা করেছিলেন। নানা নাটকীয়তা শেষে পিবিআইর তদন্তের পর এখন তিনিই এই মামলার আসামি।
এ মামলার বাকি আসামিরা হলেন- মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, এহতেশামুল হক ভোলা, শাহজাহান মিয়া, কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা ও খায়রুল ইসলাম।
চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত এই সাত আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।