মোখা’র চোখ রাঙানিতেও ভয় নেই চারু বালাদের

সবশেষ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ক্ষয়ক্ষতির কথা মাথায় রেখে অনেকেই জালসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নিরাপদে রাখতে ব্যস্ত সকাল থেকেই।

মিন্টু চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2023, 05:09 PM
Updated : 13 May 2023, 05:09 PM

চট্টগ্রামের আকমল আলী রোডের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন সমুদ্র উপকূলের জেলে পাড়ার বাসিন্দা চারুবালা জলদাস প্রতিদিনের মতো ছোট জাল নিয়ে বেরিয়েছেন মাছ ধরতে। উপকূল জুড়ে ধেয়ে আসা প্রবল ঘূর্নিঝড় মোখার সতর্কতা তাকে ছুঁতে পারেনি।

শনিবার বিকালে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন জেলে পাড়ায় কথা হয় পঞ্চাশোর্ধ এ নারীর সঙ্গে। হাতে জাল ও কোমরে গোঁজা ছোট ঝাঁকা নিয়ে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় কখন আসবে ঠিক নেই, কিন্তু পেট তো আর বসে থাকবে না। মাছ ধরে বাজারে যেতে হবে, বিক্রির পরই চুলার আগুন জ্বলবে।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় চারু বালা বলেন, এ বয়সে অনেক ঘূর্ণিঝড় দেখেছি। সাগর দেখলেই আমরা বুঝতে পারি কী হতে পারে। যখন আসবে তখন দেখা যাবে। মোখা, ফোখাতে… আমাদের মতো গরীবদের কিছুই হয় না! এ কথা বলে উপকূল সংলগ্ন ঘেরে জাল ফেলতে চলে যান তিনি।

প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা’র আট নম্বর সতর্কবার্তা এবং প্রশাসনের তোড়জোড়ের মধ্যেও নগরীর হালিশহর আকমল আলী রোডের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন জেলে পাড়ার বাসিন্দাদের কেউ কেউ এখনও তাদের বসতি ছেড়ে যাননি।

শনিবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলে পরিবারের সদস্যরা তাদের মাছ ধরার ছোট-বড় জাল এবং অন্যান্য সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখলেও এখনও বসতঘর ছাড়েননি।

শ’ দুয়েক পরিবারের এ জেলে পল্লীর বাসিন্দাদের অর্ধেকের মতো পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বড় রাস্তার ওপারে অস্থায়ী সাইক্লোন সেন্টারে গেছেন। আবার অনেকেই নারী-শিশুদের নিয়ে হালিশহর আনন্দবাজার ও আশেপাশের এলাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

তবে ওইসব পরিবারের বেশির ভাগ পুরুষ সদস্য নিজেদের মালামাল পাহারা দেওয়ার জন্য রয়ে গেছেন। রাতে ঝড়ের তীব্রতা বাড়লে উপকূলের ঘর ছাড়বেন বলে জানান তারা।

তবে ২০২২ সালের অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ক্ষয়ক্ষতির কথা মাথায় রেখে তাদের অনেকেই মাছ ধরার জাল, শোলা এবং অন্যান্য সরঞ্জাম নিরাপদে রাখার কাজে ব্যস্ত।

Also Read: সুপার সাইক্লোন ‘হচ্ছে না’ মোখা

Also Read: চট্টগ্রামের ৬ উপজেলার আড়াই লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে নেওয়ার প্রস্তুতি

ওই ঝড়ের জলোচ্ছ্বাসে আকমল আলী ঘাট এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে উন্মুক্ত সাগর তীরে বসবাসকারী কয়েকশ জেলে পরিবার সর্বস্ব হারিয়েছিল। তাদের ঘর তছনছ হওয়ার পাশাপাশি মাছ ধরার জালও পানিতে ভেসে গিয়েছিল।

এমন অভিজ্ঞতা মাথায় রেখেই জেলে পাড়ার আরেক বাসিন্দা জনি জলদাস বলেন, আমাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এ জেলে পাড়ায়। এমনিতেই আমরা সবসময় ঝুঁকিতে থাকি। ঘূর্ণিঝড় আসবে বলছে। আমরা সাবধান হয়ে মাছ ধরার নৌকা, টং জালসহ অন্যান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছি।

তিনি বলেন, ঘরের মহিলা, বাচ্চাদের হালিশহর আনন্দ গলি পকেট গেইট এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। ঘরে অনেক মালামাল আছে। সে কারণে এখনও যেতে পারছি না। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে চলে যাব।

প্রশাসনের মাইকিং, আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাবার জন্য তোড়জোড়ের পরও জেলে পাড়ায় শিশু সন্তান নিয়ে রয়ে গেছেন সীমা দাশ।

তিনি বলেন, নিজের ঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে কিভাবে যাব? আমাদের ঘরের নিরাপত্তা কে দেবে? দুর্যোগ নিয়েই আমাদের থাকতে হয়।

২০২২ সালের সিত্রাংয়ের ক্ষয়ক্ষতি স্মরণে এনে অপর বাসিন্দা অবলা দাশ বলেন, গেল বারে ঘূর্ণিঝড়ে বসতঘরসহ সহায় সম্বল সবকিছুই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ঘর পাহারা দেওয়ার জন্য পুরুষরা থাকবে। আমরা আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাব।

অপর জেলে অভি জলদাস বলেন, গতবার আমি সর্বস্ব হারিয়েছি। আমার মাছ ধরার সাতটি টং জাল হারিয়েছি। কিন্তু প্রশাসন বা কারও কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাইনি। এবারে এখানকার জেলেরা সতর্ক হলেও অনেকেই এখনও ঘর ছেড়ে যাচ্ছেন না।

শুক্রবার থেকে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, রেড ক্রিসেন্ট ও পুলিশের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য মাইকিং এবং আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন শুক্রবার রাতে আকমল আলী রোড, পতেঙ্গা ও রাণী রাসমনি ঘাটের জেলে পাড়াগুলো থেকে তিন হাজারের মতো লোককে সরিয়ে নেয় বলে জানায়।

এ কাজে নিয়োজিত আনসার ব্যাটালিয়ান সদস্য আনোয়ার জানান, রাত থেকেই অনেককেই সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু দিনের বেলা আবার কেউ কেউ ফিরে এসেছে। নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র রেখে যাওয়ায় হয়তো তারা ফিরেছে। তাদের সরাতে কাজ চলছে।

রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবক সাকির হোসেন জানান, অনুরোধের পরও ৬০ থেকে ৭০টি পরিবারের লোকজন এখনও রয়ে গেছে। তারা তাদের মালামালের নিরাপত্তার কথা বলে থেকে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসন তাদের মালামালের নিরাপত্তা নেবে বললেও তারা আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছেন না।

তবে উপকূলীয় এলাকা থেকে অনেককেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসনের এনডিসি তৌহিদুল ইসলাম বলেন, যারা সেখানে রয়ে গেছেন তাদেরকেও নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন-

Also Read: ‘ঘূর্ণিঝড়ের আগে সাগর দেখতে এসেছি’

Also Read: ঝড়ের আগে চট্টগ্রাম বন্দরে বন্ধ হল সব কাজ

Also Read: ধসের শঙ্কায় চট্টগ্রামে পাহাড় থেকে সরানো হচ্ছে লোকজনকে

Also Read: মোখা: নিরাপদ আশ্রয়ে চট্টগ্রামের জেলেপল্লীর ৩ হাজার বাসিন্দা