কর্ণফুলী নদীর ব্রিজঘাট এলাকায় নৌকা ভিড়িয়ে অলস আড্ডা দিচ্ছেন ১০ থেকে ১৫ জন বিভিন্ন বয়সী সাম্পান মাঝি। ঘাটে মাঝি ছাড়া আর লোক আছেন গোটা চারেক, তারা পারাপারের যাত্রী নন- এসেছেন নদী তীরে বেড়াতে।
Published : 05 Jul 2021, 03:54 PM
ঘাটে যেতেই প্রশ্ন কোথায় যাবেন? আবার কারও জিজ্ঞাসা ঘুরতে যাব কিনা। ‘রিজার্ভ’ গেলে বেশি টাকা লাগবে না। গলার সুরেই বোঝা গেল যাত্রীদের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষার রয়েছেন তারা।
অথচ সময় যখন স্বাভাবিক ছিল এই ঘাটেই একবার যাত্রী নিয়ে নৌকা ভেড়ানোর পর চা খাওয়ার সময়ও হত না মাঝিদের, আড্ডা তো দূরের কথা।
“দ্রুতই ১০ থেকে ১৫ জন উঠে বসতেন সাম্পানে, যাত্রীরাই গন্তব্যে যেতে দিতেন তাড়া,” হতাশ কণ্ঠে বললেন আইয়ূব খান নামের মাঝবয়সী এক মাঝি।
করোনাভাইরাস মহামারীতে এমনিতেই দিনকাল ভালো যাচ্ছে না তাদের। আর এবার কঠোর লকডাউনের যাত্রী খরা তীব্র।
রোববার বিকালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী তীর সংলগ্ন ব্রিজঘাট ও সদরঘাট উভয় জায়গাতেই দেখা মিলেছে এমন অভিন্ন চিত্রের। ঘাটে যাত্রীর অপেক্ষায় বসে আছেন সাম্পান মাঝিরা।
সরকারি বিধিনিষেধে ঘর থেকে বের হতে যতই মানা করা হোক না কেন, নৌকা না ভাসালে ভাত জুটবে না মাঝিদের পরিবারে বলেই ঘাটে আসতে বাধ্য হওয়ার কথা জানালেন আইয়ূব খান নামে এক সাম্পান মাঝির সাথে।
ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সচরাচর ব্যস্ত থাকা ব্রিজঘাটের চিত্রই পাল্টে গেছে লকডাউনে। মাঝিরা ঘাটে যাত্রী নামিয়ে বসে আছেন কয়েক ঘন্টা ধরে।
আইয়ূব খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে যেখানে দৈনিক আট থেকে ১০টা খেপ (যাত্রী পারাপার) হত, তা এখন দুটি হতেও কষ্ট হচ্ছে। আগে একবার যাত্রী নিয়ে আসলে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যেই সিরিয়াল পেতাম। এখন চার ঘন্টা বসে থেকেও পাচ্ছি না।”
আগে প্রতিদিন গড়ে ১১ থেকে ১২’শ টাকা আয় হলেও এখন দুইশ টাকা আয় করাও অনেক কষ্টের হয়ে গেছে, যোগ করেন তিনি।
তার কথা টেনে নিয়ে আরেক মাঝি মোহাম্মদ হোসেন বলেন, “এখন যা আয় হয় তাতে নৌকার তেল কেনা আর চা-নাস্তা করতেই শেষ হয়ে যায়। ঘরে গিয়ে চাল কিনলে ডাল কেনা যায় না, ডাল নিলে সবজি কেনা যায় না।
সকাল সাড়ে ১১টায় ঘাটে যাত্রী নামিয়েছেন। এরপর বেলা সাড়ে চারটা পর্যন্ত তিনি সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষায় আছেন। তার আগে আরও তিনটি নৌকা আছে, এরপরই তিনি যাত্রী তুলতে পারবেন, ধরা গলায় বললেন জাকির হোসেন নামে আরেক মাঝি।
তিনি বলেন, “যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে ঘর চালাতে কষ্ট হচ্ছে। সন্তানকে পড়ানোর শিক্ষকের বেতনও দিতে পারছি না।”
করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আয় রোজগার কমে গেলেও সরকারিভাবে সহায়তা না পাওয়ার আক্ষেপও আছে তার।
কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশনের হিসাবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইজারাভুক্ত নগরীর ১৬টি ঘাটে অন্তত তিন হাজার মাঝি আছেন।
ফেডারেশনের সভাপতি এসএম পেয়ার আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাসের সংক্রমণকালীন পরিস্থিতিতে খুবই করুণ অবস্থায় আছে সাম্পান মাঝিরা। বর্তমানে তাদের আয় রোজগার একেবারেই কমে গেছে।
“এছাড়াও তারা বিভিন্ন এনজিও থেকে নেওয়া ঋণে জর্জরিত হয়ে আছেন। লকডাউনে ঋণ আদায় বন্ধ থাকলেও সে টাকা পরে পরিশোধ করতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু রোজগারতো কমে গেছে।”
এসময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে সহায়তা পেলেও সরকারি কোনো সহায়তা পাননি বলে দাবি করেন পেয়ার আলী।
এদিকে সদরঘাটে কিছু যাত্রীর দেখা পাওয়া গেলেও মাঝিদের আক্ষেপ আগে যেখানে মিনিট বিশেক অপেক্ষা করলেই নৌকা পূর্ণ হয়ে যেত, সেখানে সামাজিক দূরত্ব মানার নির্দেশনা অনুযায়ী পাঁচ জন যাত্রী পেতেই কয়েক ঘন্টা লেগে যাচ্ছে।
আয় চারগুণ কমে দুই থেকে তিন’শ টাকায় নেমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু খরচ তো বেড়ে গেছে। এক কেজি চাল কিনতেই লাগে অনেক টাকা। সেখানে অন্যান্য বাজার কিভাবে হবে?”
তার মতই হতাশা নিয়ে নূরউদ্দিন নামের আরেক মাঝি বললেন, "সাম্পান ঠিক করতে একটি এনজিও থেকে গত বছর ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। তার পরেই শুরু হয় লকডাউন।
“ওইবার লকডাউনেতো অনেক সময় ঘাটেও আসতে পারিনি, পুলিশ কোস্ট গার্ড তাড়া করত। কিন্তু ঘরের খরচ তো বন্ধ থাকেনি।”
ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ থাকলেও ওই টাকা পরবর্তীতে পরিশোধ করতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সাপ্তাহিক এক হাজার ৬৫০ টাকা কিস্তি পরিশোধের জন্য পরিচিতদের কাছ থেকে আবার ঋণ নিতে হয়েছে। আবার ঋণের মধ্যে পড়ে গেছি।”
মাঝে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আয় রোজগার বাড়লেও নতুন এই লকডাউনে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এই অবস্থা কতদিন চলবে সেটিই তাদের দুশ্চিন্তা।