বুড়িগঙ্গায় এই ব্যবসার পত্তন হওয়ার অর্ধশতাব্দী পরও হোটেলগুলো টিকে আছে। তবে গত বছর করোনাভাইরাস মহামারী দেখা দেওয়ার পর শুরু ব্যবসায় ভাটার টান শুরু। এরপর কয়েক মাস আগে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে হোটেলগুলোর জায়গা পরিবর্তন।
এক সময় সদরঘাটের পূর্ব পাশে ছিল হোটেলগুলো, এদের সবশেষ অবস্থান ছিল ওয়াইজ ঘাটে। ফলে লঞ্চ থেকে নেমেই যাত্রীরা সরাসরি হোটেলে চলে যেতে পারতেন।
ওয়াইজ ঘাটে নির্মাণকাজ চলার কারণে আট-নয় মাস আগে হোটেলগুলো সরিয়ে দেওয়া হয় বাবুবাজার সেতুর পশ্চিমে মিটফোর্ড হাসপাতাল সংলগ্ন ঘাটে। সেখানে কোনো যাত্রীবাহী লঞ্চ না থামায় বিপাকে পড়েছেন হোটেল ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, আগের তিনভাগের এক ভাগ বোর্ডার পাওয়া যাচ্ছে। যে আয় হচ্ছে তাতে হোটেলের আনুষাঙ্গিক খরচ, কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার পর নিজেদের সংসার চালানোই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একই জায়গায় আরও পাঁচটি ভাসমান হোটেল রয়েছে। এগুলো বুড়িগঙ্গা বোর্ডিং, শরীয়তপুর বোর্ডিং, উজালা বোর্ডিং; বাকি দুটোর নাম নেই। যেগুলো ১৯৭৬ সালের পরে নির্মিত। প্রতিটিতে রয়েছে ২৫ থেকে ৩০টির মতো কেবিন। প্রতিটি কেবিনে রয়েছে বিদ্যুতের ব্যবস্থা, লাইট ও ফ্যান। রয়েছে রাতযাপনের মতো বিছানাপত্র। যদিও এগুলো এখন তেমন মানসম্মত নয়।
কেমন চলছে?
করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে ভাসমান এই হোটেলগুলোতে বোর্ডার একবারেই কম বলে নিজেদের সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়ার কথা জানিয়েছেন মালিক-কর্মচারীরা।
ফরিদপুর মুসলিম হোটেলের কর্ণধার গোলাম মোস্তফা মিয়া বলেন, “শুধু করোনাভাইরাস নয়, আগে আমাদের এই বোর্ডিংগুলো ছিল ওয়াইজ ঘাটে। ওই ঘাটে কাজ চলার কারণে আমাদের মিটফোর্ড ঘাটের পাশে নিয়ে আসা হয়েছে। যার কারণে লঞ্চ থেকে যাত্রীরা নেমে সরাসরি আমাদের এখানে আসতে চায় না।
“তাছাড়া করোনাভাইসের কারণে নিয়মিত বর্ডার ছাড়া খুব কম বর্ডার আসে। আগের তুলনায় বর্ডার তিনভাগের এক ভাগ; অবস্থা খুব খারাপ। কারেন্ট বিল দিতেই সমস্যা হয়ে যায়। নিজেরা চলতে কষ্ট হয়, কর্মচারীদের বিল দিতে কষ্ট হয়।”
হিসাব করে প্রতি সপ্তাহে আয়ের টাকা পরিবারের লোকজনের কাছে পৌঁছে দেন পিন্টু। তবে রোজগার কমে যাওয়ার কথা বলেন তিনিও।
“আমি আরেকজন কর্মচারীকে নিয়ে বোর্ডিং চালাই। বর্তমানে যে অবস্থা, চলাই মুশকিল। মালিকের বাড়িতে টাকা পাঠানো তো দূরের কথা, নানা বিল দিয়ে আমাদের চলাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“বর্ডার এখন আগের তিনভাগের এক ভাগও হয় না। আমার এখানে ৪২টি সিটের মধ্যে এখন সাতটিতে বোর্ডার আছে।”
একই অবস্থা অন্য ভাসমান হোটেলগুলোরও।
স্বল্প আয়ের মানুষের ভরসা
প্রায় ৩৬ বছর ধরে ফরিদপুর মুসলিম হোটেলের সঙ্গে আছেন গোলাম মোস্তফা মিয়া। তার মামা আব্দুস সাত্তার ছিলেন এর মালিক। এক সময় গোলাম মোস্তফা কর্মচারী হিসেবে কাজ করলেও সাত বছর ধরে তিনিই মালিক।
রাত ১২টা পর্যন্ত এ হোটেলগুলোতে প্রবেশ করা যায় ও পরদিন সকাল ১১টার মধ্যে ছেড়ে দিতে হয়। ৪০ টাকায় লোকাল রুম, ৮০ টাকায় সিঙ্গেল কেবিন ও ১০০ টাকায় ডাবল কেবিনের ব্যবস্থা রয়েছে।
পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে এসে শাহাদাত হোসেন লঞ্চ থেকে নেমেই চলে আসেন ফরিদপুর মুসলিম হোটেলে।
শাহাদাত বলেন, “এখানে ১০০ টাকা দিয়ে কেবিন নিয়েছি। এর চেয়ে কম খরচে আর কোথায় পাব। ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করতে কয়েকদিন লাগবে, তাই কম টাকায় থাকতে এসেছি এখানে।”
ফরিদপুর মুসলিম হোটেলের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছেন ৬৮ বছর বয়সী জুলহাস মিয়া। তিনি প্রায় ৩৫ বছর ধরে এই হোটেলে থাকেন। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের পালং থানার বিনোদপুর চরের কান্দি গ্রামে।
“এখানে আমি বহু বছর ধরে থাকি, প্রায় ৩০/৪০ বছরে ধরে। এরশাদ সরকার ক্ষমতায় আসার বছর দুয়েক পর থেকে রেগুলার থাকি। এখন থাকার জন্য দিই ৪০ টাকা। তারপরও এ হোটেলের মায়া ছাড়তে পারি না।”
বরিশাল বোর্ডিংয়ের পাশেই উমা উজালা বোর্ডিংয়ের প্রায় সাত-আট বছর ধরে নিয়মিত রাতযাপন করেন ভ্যানচালক নয়ন শিকদার। ভোলার বোরহানউদ্দিনের বাসিন্দা নয়ন দিনে ভ্যান চালিয়ে রাতে এই হোটেলে থাকেন।
নয়ন বলেন, “৪০ টাকা ভাড়া দেই। পাঁচ বছর আগে ভাড়া ছিল ৩৫ টাকা, বাইরে খাই। আয় কম তাই এখানে থাকি। আমার এখানেই ভালো লাগে।”
বরিশাল থেকে আসা আসলাম উঠেছেন শরীয়তপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ে। ১০০ টাকার কেবিনে উঠেছেন তিনিও।
তিনি জানান, বিভিন্ন কাজে প্রায়ই ঢাকায় আসতে হলে এখানেই রাতযাপন করেন তিনি।