“অধিকতর সুফল পেতে হলে আঞ্চলিক ব্যবহারের জন্য গভীর সমুদ্রবন্দরটি খুলে দিতে হবে,” বলেন অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম।
Published : 11 Nov 2023, 11:04 PM
চ্যানেল উদ্বোধন হল। নির্মাণ কাজও শুরু হতে চলেছে প্রথম টার্মিনালের। এর মাধ্যমে তিন বছরের মাথায় গভীর সমুদ্রবন্দরের যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ।
কক্সবাজারের মাতারবাড়ীর এ গভীর সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের সমুদ্র বাণিজ্যের নতুন পথ যেমন হতে যাচ্ছে, তেমনই এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সমুদ্র বাণিজ্যের আঞ্চলিক কেন্দ্র হবে বলেও স্বপ্ন বুনছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, গভীর সমুদ্রবন্দরের পুরো সুফল পেতে হলে এর আঞ্চলিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
শনিবার মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন সেই গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল উদ্বোধন ও বন্দরের প্রথম টার্মিনালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “নেপাল, ভুটান, ভারত তারাও কিন্তু আমাদের এ বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। পাশাপাশি আরও দেশ।
“আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে ডিপসি পোর্ট কার্যকর করতে পারব। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এই গভীর সমুদ্রবন্দর।”
সমুদ্র বাণিজ্যের নতুন পথ
প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো চট্টগ্রাম বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৮৮৭ সালে। ১৩৬ বছর পুরনো এ বন্দর বাংলাদেশের সমুদ্র বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। দেশের আমদানি রপ্তানির সিংহভাগ হয় এ বন্দর দিয়ে।
তবে বন্দরটির চ্যানেলের গভীরতা কম থাকায় সেখানে মাদার ভেসেল হিসেবে পরিচিত বড় আকারের জাহাজ ভিড়তে পারে না। প্রধান এ বন্দরে বর্তমানে ৩০-৩৫ টন পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ এবং ২৫০০-৩০০০ টিইইউএস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনারকে একক সমতুল্য ধরে) ধারণ ক্ষমতার কন্টেইনার জাহাজ চলতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মো. সোহায়েল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দরে এক লাখ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার কার্গো জাহাজ এবং ৮-১০ হাজার (টিইইউএস) কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতার মাদার ভেসেল আসতে পারবে।
শনিবার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে হলেও এটাকে আমরা আলাদা একটা আইন করে, আলাদা কর্তৃপক্ষ করে দেব, যাতে ডিপ সি পোর্ট হিসেবে একটা আইন করে দিব। সম্পূর্ণরূপে ডিপ সি পোর্ট যাতে হয় সেই পদক্ষেপ নেব- সে চিন্তাভাবনা আছে।
“আমি সত্যিই আনন্দিত যে, এ চ্যানেলটা ড্রেজিং করার পর এর ড্রাফট এত বেশি এবং এখানে এত বড় জায়গা যে এখান থেকে সরাসরি ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারব। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ভিড়িয়ে লাইটারিংয়ের মাধ্যমে মালপত্র বন্দরে নেয়, সেখানে সময়ও বেশি লাগে। মাতারবাড়ী বন্দর চালু হয়ে গেলে, আমার মনে হয় ভবিষ্যতে এমন সুদিন আসবে। সরাসরি বিশ্বের যেকোনো জায়গায় বড় বড় জাহাজ চলে যাবে। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।”
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মো. সোহায়েল বলেন, “বিগত ৫ হাজার বছরের নৌ ইতিহাসে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে বহু সমুদ্র বন্দরের অভুত্থান ঘটলেও গভীর সমুদ্র বন্দরের যাত্রা এই প্রথম। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প দুটি ধাপে সম্পন্ন হবে। আগামী ২০২৬ সালে এর পূর্ণাঙ্গ অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হবে।”
তিনি জানান, ১৬ মিটার গভীরতার এই বন্দরে পণ্যবাহী বড় মাদার ভেসেল ভিড়তে পারবে। ফলে পণ্য পরিবহন ব্যয় কমবে প্রায় ১৫ শতাংশ। অচিরেই এই বন্দর পরিণত হবে আন্তর্জাতিক হাব পোর্টে, যা দেশের জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে ২-৩ শতাংশ ভূমিকা রাখবে।
এখন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রপ্তানি পণ্য সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও কলম্বোতে নিয়ে মাদার ভেসেলে তোলা হয়। এতে সময় যেমন বেশি লাগে, তেমনই খরচাও বেড়ে যায়। গভীর সমুদ্রবন্দর হলে সেসব পণ্য সরাসারি মাতারবাড়ী থেকে মাদার ভেসেলে করে বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে চলে যাবে।
আঞ্চলিক কেন্দ্রের হাতছানি
বাংলাদেশের পাশাপাশি মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরটি আশেপাশের দেশগুলোর জন্য ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলেই এর সর্বোচ্চ সুফল মিলবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক এ সভাপতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গভীর সমুদ্রবন্দর অত্যন্ত ভালো একটি প্রকল্প। শুধু বাংলাদেশ ব্যবহার করলে আমরা এর পুরো সুফল পাব না। এর অধিকতর সুফল পেতে হলে আঞ্চলিক ব্যবহারের জন্য গভীর সমুদ্রবন্দরটি খুলে দিতে হবে।
“যেমন ভারতের সেভেন সিস্টারস, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমারের কিছু অংশ এবং চীনের ইউনান প্রদেশের জন্য যদি খুলে দেওয়া যায়, তাহলে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হবে। এতে গভীর সমুদ্রবন্দরের সর্বোচ্চ ব্যবহার হবে এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি উপকৃত হবে।”
এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “বঙ্গোপসাগর গুরুত্বপূর্ণ বেশি সেই প্রাচীনকাল থেকে। ভারত সাগরের ভেতরেই বঙ্গোপসাগর। কাজেই এ চ্যানেলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে চাই।
“আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর সেখানে কর্ণফুলী নদী। সেখানে কিছু সমস্যা আছে। আমরা চাইছি, সরাসরি ডিপ সি পোর্ট হোক। ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করে এ সময় সোনাদিয়াতে এই বন্দর নির্মাণ করার প্রস্তাব এসেছিল। তবে সোনাদিয়া দ্বীপে অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, সেখানে পোর্ট করতে গেলে তা নষ্ট হয়ে যেত। যা নষ্ট করা ঠিক হবে না। সেটাকে রক্ষা করা আমার লক্ষ্য ছিল। সে কারণে মহেশখালী চলে আসি। মাতারবাড়ীতে গিয়ে করি।”
বন্দর চেয়ারম্যান সোহায়েল বলেন, “মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর শুধু সমৃদ্ধ সোনার বাংলার নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার তিন বিলিয়ন মানুষের উন্নত জীবনের অঙ্গীকার।”
এর আগে বৃহস্পতিবার পরিদর্শনে গিয়ে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন, “আশেপাশের বন্ধু প্রতীম দেশগুলো সকলেই মাতারবাড়ীর সুফল পাবে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো সকলেই আমাদের সাথে আছে। সবার সাথে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।”
১৮ হাজার কোটি টাকার বন্দর
দেশের প্রথম এবং একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের জন্য ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ২০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ইতোমধ্যে ৩৫০ মিটার প্রশস্ত ও ১৬ মিটার গভীরতার ১৪ দশমিক ৩০ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের নির্মাণ করা হয়েছে। অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের উত্তর পাশে ২ হাজার ১৫০ মিটার দীর্ঘ ও দক্ষিণ পাশে ৬৭০ মিটার ঢেউ নিরোধক বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।
প্রথম টার্মিনালে ৪৬০ মিটার কন্টেইনার জেটি এবং ৩০০ মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাস (বহুমুখী পণ্য ওঠানামার) জেটি নির্মাণ এবং কন্টেইনার ইয়ার্ডসহ সব বন্দর সুবিধা থাকবে।
প্রথম ধাপের কাজ শেষ হলে এই টার্মিনালে একসাথে চারটি জাহাজ ভিড়তে পারবে। দ্বিতীয় ফেজের কাজ শেষ হলে একসাথে ভিড়বে ৮টি জাহাজ।
এ প্রকল্পে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান। বাকি অর্থের মধ্যে সরকার দিচ্ছে ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা, পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নেওয়া প্রকল্পটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে। এর সব নকশা জাপানি বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে হয়েছে।
এ প্রকল্পের অধীনে মাতারবাড়ী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত বন্দর সংযোগ সড়ক নির্মাণে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে।
২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এ সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাপানি প্রতিষ্ঠান ‘নিপ্পন কোয়ে’র সঙ্গে চুক্তি সই হয়।
জাপানি একটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের ঠিকাদার হিসেবে চূড়ান্ত হয়েছে। এক মাসের মধ্যেই নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে বন্দর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হবে ২০২৬ সালে: নৌপ্রতিমন্ত্রী
‘ড্রাফটে’ আশেপাশের সমুদ্রবন্দরকে ছাড়িয়ে যাবে মাতারবাড়ি: চবক চেয়ারম্যান
মাতারবাড়িতে ২০২৬ সালে জাহাজ ভেড়ানোর আশা
১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকায় দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দরে সরকারের সায়
বদলে গেছে মাতারবাড়ি; মাথা তুলছে বিদ্যুৎকেন্দ্র, প্রস্তুত হচ্ছে জেটি