মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আড়তদাররা ‘সিন্ডিকেট’ করে চামড়ার দরপতন ঘটিয়েছেন। তবে পাইকাররা তা মানতে নারাজ।
Published : 20 Jun 2024, 11:35 PM
চট্টগ্রামে এবছর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার সামান্য বেশি কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আড়তদাররা।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন জানান, তারা এবার সাড়ে তিন লাখ পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন। সেখানে বুধবার পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ ৬১ হাজার পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন।
মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আড়তদাররা ‘সিন্ডিকেট’ করে চামড়ার দরপতন ঘটিয়েছেন। তবে পাইকাররা তা মানতে নারাজ। তাদের ভাষ্য, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা না জেনে বুঝে অতিরিক্ত দামে চামড়া কিনেছেন, সে কারণে লোকসানে পড়েছেন।
বাংলাদেশে কাঁচা চামড়ার যে চাহিদা, তার ৮০-৯০ শতাংশ পূরণ হয় কোরবানির ঈদে জবাই করা পশু থেকে। ফলে এটাই চামড়া সংগ্রহের মৌসুম।
কোরবানির দিন ও তার পরে আরও দুই দিনসহ মোট তিন দিন কোরবানির পশু জবাই করেন মুসলামনরা। বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে সেসব পশুর চামড়া কিনে নেন মৌসুমী ব্যবসায়ী বা ফড়িয়ারা। বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসার লোকজনও সেসব চামড়া দান হিসেবে সংগ্রহ করেন।
পরে সেগুলো বিক্রি করা হয় পাইকার বা আড়তদারদের কাছে। আড়তদাররা সেই চামড়া কিছুটা প্রক্রিয়াজাত করে ট্যানারিগুলোর কাছে বিক্রি করে।
আড়তদার সমিতির নেতা মুসলিম উদ্দিন বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চট্টগ্রামে মোট ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯৫০ পশুর চামড়া সংগ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে গরুর চামড়া ২ লাখ ৯৭ হাজার ১৫০টি, মহিষের ১২ হাজার ২০০টি এবং ছাগলের চামড়া ৫১ হাজার ৬০০টি।
“গত বছরের চেয়ে এ বছর আমাদের সংগ্রহ হয়েছে বেশি। কোরবানির তিন দিন পর্যন্ত এসব চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণের পর এবার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করা হবে।”
সরকার ট্যানারি ব্যবসায়ীদের জন্য যে দর বেঁধে দিয়েছিল, তাতে এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৫৫ থেকে ৬০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় কেনার কথা তাদের।
সেই হিসাবে ঢাকায় এক লাখ টাকা দামের একটি গরুর চামড়া যদি ২০ বর্গফুট হয়, তখন ওই গরুর চামড়ার দাম হবে ১২০০ টাকা, ঢাকার বাইরে হবে ১০০০ টাকা।
এছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা দরে বিক্রি হবে ট্যানারিতে, আর বকরির চামড়ার দর প্রতি বর্গফুট ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা।
মৌসুমি বিক্রেতাদের অভিযোগ
‘ন্যায্য দাম’ না পাওয়ার অজুহাতে ২০১৯ সালে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা সড়কে দেন রাখে কোরবানির পশুর চামড়া। তাতে বিপুল পরিমাণ চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। এর পরের বছর মহামারী ও লোকসানের শঙ্কায় কোরবানিকেন্দ্রিক মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সেভাবে মাঠে ছিলেন না।
২০২১ সালে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীর দেখা মিললেও তারা আড়তদারদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমেই চামড়া কিনেছিলেন। তবে গত দুই বছর গাউসিয়া কমিটি চামড়া সংগ্রহ করায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দাপট ছিল না।
এবছর গাউসিয়া কমিটির সদস্যরা চামড়া সংগ্রহ করলেও কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী আর ফড়িয়ার দেখা মিলেছে ঈদের দিন।
মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী হাবিব মোল্লার অভিযোগ, এবছর ‘সিন্ডিকেট’ করে আড়তদাররা চামড়ার দরপতন ঘটিয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এবছর তিনি ১৪০টি চামড়া কিনেছেন গড়ে ৬৫০ টাকা দরে। কিন্তু সেগুলো কিছু বিক্রি করেছেন ৩৮০ টাকা করে, বাকিগুলো ১০০ টাকা দরে বিক্রি করতে ‘বাধ্য’ হয়েছেন।
“বিকালের পর থেকে কোনো আড়তদার আর আসেনি। রাতে ফেনী থেকে একজন এসে আমাদের চামড়াগুলো ১০০ টাকা করে কিনেছে। সেগুলো আমরা বাধ্য হয়ে বিক্রি করেছি। অনেকেই চামড়া বিক্রি না করে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল।”
হাবিব মোল্লার ভাষ্য, গত ১৪ বছর ধরে তিনি মৌসুমি এ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। গতবছর লাভ হয়েছিল মাত্র আট হাজার টাকা। এবার ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা।
দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত আগ্রাবাদ চৌমুহুনী এলাকার বাসিন্দা মো. ইয়াছিন। তার সঙ্গে কাজ করেন মো. সাগির। কোরবানির দিন তিনি চামড়া সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন।
সাগির বলেন, এবছর তারা ৫০০-৬০০ টাকা করে মোট ৩০০ চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। পরে সেগুলো সাড়ে তিনশ টাকা করে বিক্রি করতে হয়েছে।
“এ বছর যারা চামড়া ব্যবসা করতে নেমেছে, তারা সবাই লোকসানে পড়েছে। বাধ্য হয়ে অনেকে চামড়া ফেলে চলে গেছে।”
রাস্তায় চামড়া ফেলে যাওয়ার বিষয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মোরশেদুল ইসলামের কথায়।
তিনি বলেন, “বিবিরহাট এলাকায় ও আগ্রাবাদ চৌমুহুনী এলাকায় আমাদের কর্মীরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে গিয়ে কিছু চামড়া রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় পেয়েছে। যেগুলো নষ্ট হয়ে গেছিল। তবে সবমিলিয়ে এর পরিমাণ তিন থেকে চার হাজারের বেশি না।”
আড়তদারদের অস্বীকার
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, “আমরা নায্য দামেই চামড়া সংগ্রহ করেছি। আমাদের যতটুকু ধারণ ক্ষমতা বরং তারা চেয়ে বেশি চামড়া আমরা কিনেছি।
“বর্তমানে চট্টগ্রামে আড়তদারের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ জন। তাদের অনেকের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকার পরও চামড়া সংগ্রহ করেছেন। আমাদেরকে প্রশাসন থেকে বারবার বলা হয়েছে যাতে চামড়া নষ্ট না হয়। সেজন্য আমরা অনেকেই অতিরিক্ত চামড়া সংগ্রহ করেছি।”
মুসলিম উদ্দিনের ভাষ্য, চামড়ার সরকার নির্ধারিত যে মূল্য থাকে, সেই দরে ট্যানারি মালিকরা আড়তদারদের কাছ থেকে কেনে। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সেটা না বুঝে তাদের ‘ইচ্ছেমত’ দামে চামড়া কিনেছেন। পরে আড়তে বিক্রি করতে গিয়ে চাহিদামত দাম না পাওয়ায় অভিযোগ তুলছেন।
“যারা পরিস্থিতি বোঝে তারা লোকসানে পড়েনি। আর যারা না বুঝে চামড়ার দাম ধরে, তারাই লোকসানে পড়েছে। তাদের এ দায়তো আমরা নিতে পারি না।”
মুসলিম বলেন, ট্যানারি মালিকরা চামড়া কেনেন ফুট হিসেবে।তার মধ্যে ১৫ ফুটের কম চামড়া ট্যানারি মালিকরা নিতে চায় না। আবার যারা নেয়, তারা সেগুলোর দাম ধরে ২০০/৩০০ টাকা করে।
সমিতির সহ-সভাপতি আব্দুল কাদের বলেন, “বর্তমান আবহাওয়াটা চামড়া সংরক্ষণের অনূকূলে ছিল না। বেশি গরম। কাঁচা চামড়া ৫/৬ ঘণ্টার মধ্যেই লবণ দিয়ে রাখতে হয়।
“কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়ার মান, ফুট না বুঝেই চামড়া কিনে ফেলে। অতিরিক্ত লাভের আশায় তারা দাম ধরে রাখে। ফলে তাদের চামড়া এক পর্যায়ে নষ্ট হয়ে যায়। সেগুলো আড়তদাররা আর কেনে না।”
আব্দুল কাদেরের দাবি, ঈদের দিন বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তারা আকারভেদে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে চামড়া কিনেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।
“কিন্তু অনেকেই অতিরিক্ত লাভের আশায় সেসময় বিক্রি না করে ধরে রেখেছিল। যার কারণে সেগুলো এক পর্যায়ে এসে নষ্ট হয়ে গেছে। পরে বাধ্য হয়ে রাতে সেগুলো তাদের আরও কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে। যেটা আড়তদারদেরও ক্ষতি।
নজরদারির দাবি
আড়তদার সমিতির নেতা কাদের বলেন, “কোরবানির ঈদের আগে বাণিজ্য মন্ত্রনালয় চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু বিক্রির সময় ট্যানারি মালিকরা কীভাবে চামড়া কিনছে সেটার নজরদারি করে না। আমাদের দাবি থাকবে সরকার যেন নজরদারি বাড়ায়।”
কাদেরের দাবি, একটি চামড়া সংগ্রহের পর সংরক্ষণ করে ঢাকায় ট্যানারির কাছে বিক্রি পর্যন্ত ৪৯৮ টাকা খরচ হয়। যদি ট্যানারি মালিকরা চামড়াগুলো চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে যায়, তাহলে পাইকারদের খরচ পড়বে ৩০০ টাকার মধ্যে।
“তাছাড়া বেশির ভাগ সময় ট্যানারি মালিকরা আমাদের কাছ থেকে চামড়া কেনেন বাকিতে। সেই টাকা আদায় করা আমাদের অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। টাকা আদায় করতে না পেরে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।”
পুরনো খবর
সাড়ে ৩ লাখ কোরবানির চামড়া কেনার লক্ষ্য চট্টগ্রামের আড়তদারদের