সাড়ে ৩ লাখ চামড়া কেনার লক্ষ্য চট্টগ্রামের আড়তদারদের। তবে জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর বলছে, জেলায় আরও বেশি পশু কোরবানি হয়।
Published : 17 Jun 2024, 10:53 PM
কোরবানির পশুর চামড়া চট্টগ্রামের আড়তে আসতে শুরু করেছে; তবে মওসুমি ব্যবসায়ী ও ফরিয়ারা যে দামে তা বাসা-বাড়িতে গিয়ে সংগ্রহ করেছেন তা দিতে চাইছেন না আড়তদাররা।
সোমবার দুপুরের পর থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আড়তদারের প্রতিনিধি ও মওসুমি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন যানবাহনে করে চামড়া নিয়ে আসছেন আতুড়ার ডিপো এলাকায়।
তবে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ নিয়ে আগের সেই টানাটানি বা এলাকাভিত্তিক উত্তেজনা এখন আর নেই। কয়েক বছর ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পর অনেকেই মওসুমি এ ব্যবসা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। যে কারণে গত দুই বছর মওসুমি চামড়া ব্যবসায়ী বা ফড়িয়ারাদের দেখা মেলেনি। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় এ বছর স্বল্প সংখ্যায় হলেও তাদের অনেকের দেখা মিলেছে।
পাশাপাশি গত দুই বছরের মতো এবছরও বিভিন্ন এলাকা থেকে গাউসিয়া কমিটি নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে চামড়া সংগ্রহ করছে।
চট্টগ্রাম নগরীতে ঈদের দিন সকালে পশু কোরবানির পর মাদ্রাসার প্রতিনিধি, মওসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা বিভিন্ন বাসা-বাড়ি থেকে যে চামড়া সংগ্রহ করে তা দুপুর থেকে নিয়ে আসেন নগরীর আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকায়। আড়তদারের প্রতিনিধিরা সেসব চামড়া কিনে নেন। গত কয়েক বছর সেখানে মওসুমি ব্যবসায়ীদের সংখ্যা কম থাকলেও এবছর সে সংখ্যা কিছুটা বেশি দেখা গেছে।
বিকালে চৌমুহুনি মোড়ে হাবিব মোল্লা নামে এক মওসুমি ব্যবসায়ী বলেন, গত ১৪ বছর ধরে তিনি এ কাজ করছেন। আগে এ ব্যবসায় লাভ থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে তেমন কোনো লাভ হয় না।
“এবছর ১৪০টি চামড়া সংগ্রহ করেছি। গড়ে প্রতিটি চামড়া কিনেছি সাড়ে ছয়শ টাকা করে। কিন্তু আড়তদারের প্রতিনিধিরা সেগুলো ৭০০ টাকার বেশি দাম দিতে চাইছে না। তাই অপেক্ষায় আছি, বেশি দামে বিক্রির জন্য।”
একই এলাকায় সাথাওয়াত হোসেন নামে এক যুবক বলেন, তারা কয়েক জন মিলে দাইয়া পাড়া এলাকা থেকে ৩১টি চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করতে এসেছেন।
তার ভাষ্য, গত দুই বছর তারা ব্যবসা না করলেও এবছর আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ৩১টি চামড়া সংগ্রহ করেছেন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করে। কিন্তু আড়তদারদের প্রতিনিধিরা ‘সিন্ডিকেট’ করে সাড়ে ছয়শ টাকার বেশি দাম দিতে চাচ্ছেন না।
চৌমুহুনি এলাকায় মো. সাগের নামের এক মওসুমি চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তারা চামড়ার ব্যবসা করছেন। বছর দশেক আগেও ১৫/২০ লাখ টাকা লাভ হত। কিন্তু গত কয়েক বছরে ২০/২৫ হাজার টাকার বেশি তারা লাভ করতে পারছেন না।
“৬০০ থেকে ৭০০ টাকা করে ৪০০টি চামড়া সংগ্রহ করেছি। এবছরও বেশি লাভ হবে বলে মনে হয় না। অল্প লাভেই এসব চামড়া বিক্রি করতে হবে।”
চৌমুহুনিতে চামড়া নিয়ে যাওয়া মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অভিযোগ আড়তদারের প্রতিনিধিরা সন্ধ্যার পর তাদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ করার আগ্রহ দেখায়। কারণ চামড়া বেশি সময় রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে। সে সুযোগটি কাজে লাগিয়ে আড়তদারররা কম দামে চামড়া কিনতে চান।
ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়; গত বছর এই দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, গত বছর যা ৪৭ থেকে ৫২ টাকার মধ্যে ছিল।
এছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা দরে বিক্রি হবে ট্যানারিতে, যা গত বছর ছিল ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা, যা আগের বছর ছিল ১২ থেকে ১৪ টাকা।
তবে ফড়িয়া বা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কোরবানি দাতাদের কাছ থেকে বর্গফুট হিসেবে চামড়া কেনেন না। আকার বুঝে মোটের ওপর একটি দাম তারা দেন। সেখানে কিছু লাভ রেখে তারা আড়তদারদের বিক্রি করেন।
সংরক্ষণের পর আড়তদাররা নিজেদের লাভ রেখে সরকারের ওই নির্ধারিত দরে বা তার বেশি দামে বিক্রি করেন ট্যানারিতে।
দাম কম দেওয়া নিয়ে আড়তদারদের প্রতি মওসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ মানতে চাননি বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়ৎদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সহ-সভাপতি আব্দুল কাদের।
তিনি বলেন, “চামড়ার দাম নির্ধারণ করে সরকার। সেখানে আমাদের কোন হাত নেই। আমরা ৩০ ফুটের চামড়া ৮০০ টাকা দরেও সংগ্রহ করছি। আবার ১৫ ফুটের চামড়া সংগ্রহ করছি ৩০০ টাকায়।”
তার দাবি, একটি চামড়া সংগ্রহের পর সংরক্ষণ করে ঢাকায় ট্যানারির কাছে বিক্রি পর্যন্ত ৪৯৮ টাকা খরচ হয়। যদি ট্যানারি মালিকরা চামড়াগুলো চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে যান তাহলে খরচ পড়বে ৩০০ টাকার মধ্যে।
কাদেরের অভিযোগ, “সরকারের বেঁধে দেয়া দাম অনুযায়ী একটি চামড়া ট্যানারি মালিকরা আমাদের কাছ থেকে কিনবেন এক হাজার টাকায়। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা চামড়া কেনেন ফুট হিসেবে। তার মধ্যে ১৫ ফুটের নিচে চামড়াগুলো মালিকরা নিতে চায় না। আবার যারা নেন তারা সেগুলোর দাম ধরেন ২০০/৩০০ টাকা করে।”
ট্যানারি মালিকরা কীভাবে চামড়া কিনছে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নজরদারিতে আনা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চামড়া সংগ্রহে গাউসিয়া কমিটি
আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহম্মদিয়া সুন্নীয়া ট্রাস্টের অধীনে দেশে পরিচালিত হয় দুই শতাধিক সুন্নীয়া মাদ্রাসা। এ ট্রাস্টের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাউসিয়া কমিটি। মহামারীর মধ্যে কোভিডে মৃতদের সৎকারের মত কাজে সহায়তা দিয়ে এ সংগঠন আলোচনায় আসে।
গত দুই বছর ধরে গাউসিয়া কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে চামড়া সংগ্রহের কাজ শুরু করে। পরে সেগুলো আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন।
সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মোসাহেব উদ্দিন বখতেয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ বছর তারা এক লাখ চামড়া সংগ্রহের টার্গেট করেছেন। যার মধ্যে নগরীতে ৪০ হাজার, উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রাম মিলিয়ে আরও ৬০ হাজার।
তিনি জানান, নগরীর এবং উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রায় তিন হাজারকর্মী বিভিন্ন বাসা বাড়িতে গিয়ে চামড়া সংগ্রহ করছেন।
বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা চামড়া গত দুই বছর মুরাদপুর সুন্নীয়া মাদ্রাসায় জড়ো করা হয়। এবার তাদের সংগ্রহ করা চামড়া বিবিরহাট বাজার মাঠে বেঙ্গল আড়তের সামনের মাঠে জড়ো করা হচ্ছে। আড়তদারের লোকজন সেগুলো সংরক্ষণ করছে।
এছাড়া হালিশহর, খুলশী এলাকায় তাদের পরিচালিত মাদ্রাসা মাঠে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকে সংগ্রহ করা চামড়াগুলো রাউজান উপজেলায় এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকে সংগ্রহ করা চামড়াগুলো পটিয়া, চন্দনাইশ উপজেলায় সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানান বখতেয়ার।
সাড়ে ৩ লাখ চামড়া কেনার লক্ষ্য আড়তদারদের
এবারের কোরবানির ঈদে সাড়ে তিন লাখ চামড়া কেনার আশা করছেন চট্টগ্রামের আড়তদাররা। তবে জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, চট্টগ্রামে আরও বেশি পশু কোরবানি হয়।
আড়তদারদের সংগঠনের নেতা কাদের বলেন, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে টাকা পাওনাসহ নানা কারণে চট্টগ্রামে আড়তদারের সংখ্যা কমে গেছে। আগে প্রায় ২৫০ জন আড়তদার চামড়া সংগ্রহ করতেন। গত কয়েক বছরে তা কমতে কমতে ২০/৩০ জনে দাঁড়িয়েছে। এত অল্প আড়তদারের পক্ষে বেশি চামড়া সংগ্রহ করা সম্ভব না।