ব্যাট হাতে একদমই চেনা যাচ্ছে না সাকিব আল হাসানকে, অনেকটা যেন নিজের ছায়া হয়ে আছেন তিনি।
Published : 01 Nov 2023, 08:44 AM
শট খেলেই নিজের পরিণতি বুঝতে পারলেন সাকিব আল হাসান। হতাশায় নুয়ে পড়ল মাথা। এক ঝলক তাকিয়ে দেখলেন, ফিল্ডারের হাতে জমেছে বল। এরপর হাঁটা দিলেন। মাথা নিচু করে। আরও একবার।
মাথা নিচু করে তাকে মাঠ ছাড়তে হচ্ছে এই বিশ্বকাপে নিয়মিতই। রান পাচ্ছেন না, ছন্দে নেই। এসব তো আছেই। কিন্তু ইডেন গার্ডেন্সে পাকিস্তানের বিপক্ষে ইনিংসটিতে যেমন হয়েছে, ব্যাট হাতে এতটা অসহায় তাকে সবশেষ কবে লেগেছে!
এবারের বিশ্বকাপের নিজের সবচেয়ে বড় ইনিংসটি এ দিনই খেলেছেন সাকিব। তবে এই ইনিংসটিই হয়তো বুঝিয়ে দিল, এই মুহূর্তে তার ব্যাটিং অতীতের কঙ্কাল।
তিনি ধুঁকেছেন। ভুগেছেন। ছটফট করেছেন। পরে লড়াইয়ের চেষ্টা করেছেন বটে। তবে সেই লড়াই শেষ করতে পারেননি। জিততে পারেননি। কিংবা সেই লড়াই জয়ের রসদ বা উপকরণ তার ভেতরে কিছু অবশিষ্ট নেই।
এমনিতেই এই বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে একদমই ছন্দে নেই তিনি। এই ম্যাচের আগে ৫ ইনিংস মিলিয়ে তার রান ছিল ৬১। এর মধ্যে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে এক ইনিংসেই করেন ৪০। গত বিশ্বকাপ তিনি স্বপ্নের মতো কাটিয়েছেন। অমন পারফরম্যান্স সাধারণত এক জীবনে একবারই হয়। একইরকম কিছুর আশা তাই এবার নিশ্চিতভাবেই বাড়াবাড়ি। তবে গতবারের অর্ধেক করার সামর্থ্য তো তার আছে। অন্তত কিছু তো করবেন!
আগের ম্যাচগুলোর হতাশা পেছনে ফেলে কিছু করার সুযোগ ছিল বিশ্বকাপের শেষ তিন ম্যাচে। দলের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ওঠার যে লক্ষ্য, তা পূরণ করার পথে নেতৃত্ব দিতে পারতেন সামনে থেকে। সেটির শুরু হতে পারত পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি দিয়েই। কিন্তু এই ইনিংসেই তিনি যেভাবে ব্যাট করলেন, তিনি হয়তো ভুলে যেতে চাইবেন।
যারা খেলা দেখেননি, তাদের কাছে বিস্ময় লাগতে পারে, ৪৩ রানের একটি ইনিংস নিয়ে কেন এতটা নেতিবাচকতা, কেন এত হাহাকার, এত হতাশা! বাংলাদেশ দলের এখনকার বাস্তবতায় ৪৩ রানও কম নয়। কিন্তু খেলা যারা দেখেছেন, তাদের অনুধাবন করতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
মঙ্গলবার সাকিব যখন উইকেটে যান, প্রাথমিক বিপর্যয় তখন অনেকটাই সামাল দিয়েছে দল। ২৩ রানে ৩ উইকেট হারানোর ধাক্কা সামলে ৭৯ রানের জুটি গড়েছেন লিটন কুমার দাস ও মাহমুদউল্লাহ। বিশেষ করে মাহমুদউল্লাহর দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের সৌজন্যে রান রেটও তখন খারাপ নয়। তাই বলা যায়, বেশ ভালো ভিত সাকিব পেয়েছিলেন। তার কাজ ছিল আপাতত জুটি গড়া, প্রান্ত বদল করা, এক-দুই করে নিয়ে আস্তে আস্তে ইনিংস গড়া।
সাকিব সেই কাজটিই করতে পারছিলেন না!
সাকিব যেমন বহু আগেই বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের একজন হয়ে গেছেন, তেমনি আরও একটি জায়গায় তিনি দেশের ইতিহাসের সেরাদের একজন। যখন তিনি আপন ছন্দে থাকেন, দুনিয়ার যে কোনো বোলিং আক্রমণের সামনে সিঙ্গেল বের করতে পারেন। আলতো খেলে, ফাঁকা জায়গায় ঠেলে, স্মার্ট ব্যাটিং করে একটু একটু রান বাড়াতে তার জুড়ি নেই। এবারের বিশ্বকাপে তো সেই সাকিবের দেখাই মিলছিল না। পাকিস্তানের বিপক্ষে এই ইনিংসে অবিশ্বাস্যভাবে তিনি ধুঁকলেন ইফতিখার আহমেদের বলে সিঙ্গেল বের করতে!
ইফতিখারের বলে রক্ষণাত্মক খেলেই সাকিবের ইনিংস শুরু। ইফতিখারের পরের ওভারে টানা ৫ বল খেলে রান নিতে পারলেন না। এই অফ স্পিনারের পরের ওভারে আবার টানা ৫ বলে রান না পাওয়ার পর শেষ বলে একটি রান নিতে পারলেন। মানে মুখোমুখি লড়াইয়ে ১২ বলে এলো স্রেফ ১ রান।
এরপর একটু সচল হলো তার ব্যাট। সেটিও দারুণ কিছু নয়। ইফতিখারের ওই স্পেলে ১৮ বল খেলে সাকিব নিতে পারেন স্রেফ ৪ রান।
ইফতিখার বিশেষজ্ঞ বোলার নন। খুব বেশি টার্ন বা কারুকাজ তার বলে নেই। স্রেফ ক্রিজের ব্যবহার করেন আর ভালো জায়গায় বল রাখার চেষ্টা করেন। ব্যাটসম্যানের মনোভাব বুঝে বল করার চেষ্টা। সাকিবের বিপক্ষেও তার কৌশল ছিল এটুকুই। তাতেই বাংলাদেশ অধিনায়ককে তিনি বৃত্তবন্দি করে রাখলেন।
সাকিববে মনে হচ্ছিল একদম অসহায়। ইফতিখারের সরল স্পিনের জটিল ধাঁধায় হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার সামনে ইফতিখার হয়ে উঠেছিলেন যেন সেরা ফর্মের সাকলায়েন মুশতাক কিংবা সাঈদ আজমল!
২০ বলে ৬ রান করার পর মোহাম্মদ ওয়াসিমের বলে একটি বাউন্ডারির দেখা তিনি পান বটে। তবে আত্মবিশ্বাস ফেরেনি তাতেও। কোনো বোলারকেই তিনি স্বচ্ছন্দে খেলতে পারছিলেন না। ৩০ বল খেলে তার রান ছিল ১১।
তার এমন ব্যাটিংয়ের সরাসরি প্রভাব পড়ে মাহমুদউল্লাহর ওপর। স্ট্রাইক না পেয়ে তিনিও খানিকটা ছন্দ হারান, কিছুটা চাপে পড়ে যান। তার ব্যাটিংয়ের সাবলিলতা কমে যায়।
সাকিব ক্রিজে যাওয়ার সময় মাহমুদউল্লাহর রান ছিল ৪৫ বলে ৪৬। সেখান থেকে চার রান নিয়ে ফিফটিতে যেতে তার লেগে যায় ১২ বল। ফিফটির পরও একই চিত্র। শেষ পর্যন্ত শাহিন শাহ আফ্রিদির দারুণ ডেলিভারিতে তিনি বোল্ড হয়ে যান ৭০ বলে ৫৬ করে।
সাকিবের ভোগান্তি চলতেই থাকে। ২০ রান করতে তার লেগে যায় ৪৫ বল। এমনকি লেগ স্পিনার উসামা মিরের ধারহীন বোলিংও তিনি খুব স্বচ্ছন্দে খেলতে পারেননি। উইকেটে যাওয়ার একটু পর থেকেই তাকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। এক পর্যায়ে ছটফট করতে থাকেন, কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠেন। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে, জায়গা বানিয়ে, বিভিন্নভাবে রান করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন।
ইফতিখার নতুন স্পেলে বল হাতে নেওয়ার পর অবশেষে যেন জেগে ওঠার ডাক শুনতে পান সাকিব। টানা তিনটি বাউন্ডারি মারেন, একটির চেয়ে আরেকটি আরও বেশি দুর্দান্ত। মনে হচ্ছিল, অবশেষে নিজেকে ফিরে পেয়েছেন তিনি। আগের ভোগান্তিটুকুও তখন গ্রহণযোগ্য করে নেওয়ার যুক্তি মিলছিল। ফর্মে না থাকলে বা দুঃসময় চলতে থাকলে অনেক সময়ই এরকম দাঁতে দাঁত চেপে চোয়ালবদ্ধ লড়াইয়ের প্রয়োজন হয়। কোনোভাবে উইকেটে সময় কাটাতে পারলে একটা সময় নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়।
সাকিবকেও মনে হচ্ছিল তেমন কিছুই। যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজন ছিল ইনিংসটিকে বড় করা। সেঞ্চুরি না হলেও অন্তত উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে ইনিংসকে টেনে নেওয়া। কিন্তু একটু পরই হারিস রউফের শর্ট বল পুল করতে গিয়ে বল তুলে দেন ওপরে। সহজ ক্যাচ।
শটটি খেলতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় দেরি করে ফেলেন সাকিব, বলের ওপর তাই চড়ে বসতে পারেননি। বলা যায়, রিফ্লেক্স যথেষ্ট ভালো ছিল না। হতে পারে, স্রেফ শটটি খেলতে গিয়ে ওরকম হয়েছে। কিংবা হতে পারে, তার বয়স, তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার প্রতিফলন পড়েছে রিফ্লেক্সে।
এই বিশ্বকাপে তার আউটগুলোর যা ধারা, তাতে পরেরটা ধরে নেওয়ার কারণই বেশি।
এই নিয়ে এবারের বিশ্বকাপে তৃতীয়বার তিনি আউট হলেন শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে। প্রথম ম্যাচে আজমাতউল্লাহ ওমারজাইয়ের বলে, নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে লকি ফার্গুসনের ডেলিভারিতে। এছাড়াও আরও দুবার তিনি শর্ট বলের শিকার হয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ড্রাইভের মতো খেলতে গিয়ে, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে খোঁচা মেরে।
তার রিফ্লেক্স কমে যাওয়ার বার্তা তাতে মিলতেই পারে। দলগুলিও হোমওয়ার্ক করছে এবং তা কাজে লাগাচ্ছে।
ক্যারিয়ারের নানা সময়ে শর্ট বলের চ্যালেঞ্জ ভালোভাবেই সামলেছেন তিনি। কখনও কখনও দাপট দেখিয়েছেন। তবে সময়ের সঙ্গে বদলে যায় অনেক বাস্তবতা। এখন এই বিশ্বকাপের শেষ দুই ম্যাচের জন্য সাকিবের চ্যালেঞ্জ আপাতত কিছু উপায় খোঁজা। শর্ট বল সামলানোর উপায়, ছন্দে ফেরার উপায়, বড় ইনিংস খেলার উপায়। নইলে তার ব্যাটিং ঘিরে প্রশ্নেরা ভিড় করবে ক্রমেই।