ব্যথায় কাতর হয়েছেন, বারবার ফিজিওর সহায়তা নিয়েছেন, পরের ব্যাটসম্যান অ্যাডাম জ্যাম্পা কয়েকবার তো মাঠে প্রায় ঢুকেই যাচ্ছিলেন! হাঁটতে না পারায় রীতিমতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে ব্যাটিং করেছেন, তবু বেরিয়ে যাননি গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে, চোটের চোখরাঙানি এড়িয়ে তিনি খেলেছেন ইতিহাসের সেরা ইনিংসগুলোর একটি। এর পেছনে শুধুই ঝড়ো ব্যাটিং নয়, ছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, এমনটাই জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার।
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার ২০১ রানের যে অপরাজিত ইনিংসটি খেলেছেন ম্যাক্সওয়েল, এটি পুরোপুরি ফুটিয়ে তোলার জন্য যথার্থ শব্দ খুঁজে পাওয়াও কঠিন। বল হাতে আফগানিস্তানের উড়ন্ত শুরুতে যে চাপে পড়েছিল অস্ট্রেলিয়া, সেখান থেকে নিজের চোটের সঙ্গে লড়াই করে দলকে ৩ উইকেটের অবিশ্বাস্য এক জয় এনে দিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল।
২৯১ রান তাড়ায় পঞ্চাশের আগেই ৪ উইকেট পড়ার পর ক্রিজে যান ম্যাক্সওয়েল। প্রথম বলে এলবিডব্লিউ আবেদন থেকে বাঁচার পর তিনি শুরুতেই জীবন পান ক্যাচ দিয়ে। ক্রিজে তার থিতু হওয়ার আগেই স্কোরবোর্ড রূপ নেয় ৯১ রানে ৭ উইকেটে। ম্যাচের অবস্থা দেখে জয়-পরাজয়ের সম্ভাবনা নির্ধারণ করে, এমন প্রায় প্রতিটি ওয়েবসাইটে তখন আফগানিস্তানের পক্ষে রায় ৯৯ শতাংশেরও বেশি।
সেখান থেকে প্যাট কামিন্সের সঙ্গে অসাধ্য সাধনের অভিযান শুরু করেন ম্যাক্সওয়েল। এতেও বিপত্তি! অস্ট্রেলিয়া ও ম্যাক্সওয়েলের কাজ আরও কঠিন হয় হ্যামস্ট্রিং ও পায়ের পেছনের পেশির টানে। কিছুক্ষণ পরপর ফিজিও ছুটে আসেন মাঠে। চলার শক্তিই প্রায় হারিয়ে ফেলা ম্যাক্সওয়েল নিজেও ক্রিজের ওপর শুয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করেন ক্র্যাম্প।
সব কিছু সামলে নিয়ে প্রায় প্রতি ওভারে একটি-দুটি বাউন্ডারিতে ম্যাক্সওয়েল ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন জয়ের পথে। অন্য প্রান্তে অতন্দ্র প্রহরীর মতো তাকে সঙ্গ দিয়ে যান অধিনায়ক কামিন্স। ৭৬ বলে সেঞ্চুরি ছোঁয়ার পর আগ্রাসন আরও বাড়িয়ে দেন ম্যাক্সওয়েল।
জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার দরকার যখন ২৩ বলে ২১ রান, দ্বিশতকের জন্য ম্যাক্সওয়েলেরও প্রয়োজন ২১। মুজিব উর রহমানের টানা চার বলে ছক্কা-ছক্কা-চার-ছক্কায় দলকে কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি মাইলফলক স্পর্শ করেন ৩৫ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান।
ওয়ানডে ক্রিকেটে রান তাড়ায় এটিই প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। ২১ চার ও ১০ ছক্কায় স্রেফ ১২৮ বলে পূর্ণ করেন ম্যাক্সওয়েল। বিশ্বকাপে এটিই দ্রুততম ডাবল সেঞ্চুরি। ওয়ানডেতে এর চেয়ে কম বলে দ্বিশতক রয়েছে শুধু ইশান কিষানের, গত বছর বাংলাদেশের বিপক্ষে ১২৬ বলে।
মাঠে কাজটা শতভাগ সাফল্যের সঙ্গে করলেও, এমন এক ইনিংস খেলার পর সংবাদমাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিজের অনুভূতির প্রকাশটা পুরোপুরি করতে পারেননি ম্যাক্সওয়েল।
“মুহূর্তটি এখনও অনেক সতেজ। যদিও এখন অনুভূতি তেমন কাজ করছে না। দারুণ ছিল। মনে হচ্ছিল, আমি ও প্যাটি (কামিন্স) মিলে সেখানে মজা করছি। সামনের কয়েক দিনে সম্ভবত আরও বুঝতে পারব এবং আশা করছি হ্যামস্ট্রিং ও পায়ের পেছনের পেশি কিছুটা স্বাভাবিক হবে। এই মুহূর্তে এটি (ব্যথা) অনেকটাই বাজে অবস্থায়।”
জ্যাম্পা যেমন প্রস্তুত ছিলেন ব্যাটিংয়ে নামার জন্য, তেমনি মাঠেও একই ভাবনা খেলা করছিল ম্যাক্সওয়েলের মনে। তবে ফিজিওর কথায় সেই ভাবনা দূর করে ব্যাটিং চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এরপর কোন পরিকল্পনায় দলকে এনে দিলেন মনে রাখার মতো এক জয়, সেটি জানালেন ম্যাক্সওয়েল।
“মাঠের বাইরে (ড্রেসিং রুমে) গিয়ে পিঠে, পায়ে শুশ্রূষা নিয়ে আবার ব্যাটিংয়ে নামার ব্যাপারে কথা হচ্ছিল আমাদের। তখন ফিজিও বলল, এসব করে আবার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা খুবই কঠিন হবে। এটিই মূলত কাজটা আরও সহজ করে দিয়েছে।”
“এরপর আমরা একই প্রান্তে থেকে যত সম্ভব ব্যাটিং করার ব্যাপারে ঠিক করলাম। যতক্ষণ না খুব সহজ সিঙ্গেল পাওয়া যায়, যাতে হেঁটেই রান নেওয়া যায়। তবে কিছুক্ষণ ধরে বিষয়টা এমন ছিল, ‘আমি যদি এক প্রান্ত থেকে ওভারে একটি বা দুইটি বাউন্ডারি মারতে পারি’, তাহলে অন্য প্রান্তে কী হয় তা তেমন প্রভাব ফেলবে না। কারণ ততক্ষণে বলপ্রতি রান প্রয়োজন অবস্থা চলে আসে। পুরোটাই একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল। এমন না এলোপাথাড়ি ব্যাট চালিয়েছি।”
অষ্টম উইকেটে কামিন্সকে নিয়ে জুটি শুরুর সময় অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিল ২০১ রান। সেখান থেকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ৬০-৭০ রান বাকি থাকা অবস্থায় ম্যাক্সওয়েল বিশ্বাস করতে শুরু করেন, ম্যাচ জেতা সম্ভব। তখন তার ভাবনায় ছিল, রাশিদ খানের ওভার দেখেশুনে শেষ করে দেওয়ার কথা।
“আমরা জানতাম রাশিদের ৩ ওভার বাকি। যেটি শেষের ১৩ ওভার বা এর মধ্যে করবে। আমার মনে হচ্ছিল, তাকে যদি দেখে পার করতে পারি, অন্যদের ওভারে আমি বাউন্ডারি মারতে পারব। তার সামনে নিচের ব্যাটসম্যানদের আসতে না দিয়ে, তার ওভার শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। (জানতাম) আমরা যদি তাকে শেষ দিকে ম্যাচের বাইরে রাখি, তাহলে আমরা ঠিক থাকব।”
কামিন্সের সঙ্গে গড়া ২০২ রানের জুটিতে ম্যাক্সওয়েলের অবদান ১৭৯ রান। একপ্রান্তে আঠার মতো লেগে থাকা অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক ৬৮ বলে করেন ১২ রান। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাক্সওয়েলের ৪০ বলে সেঞ্চুরির ম্যাচেও কামিন্সের সঙ্গে হয় ১০৩ রানের জুটি। যেখানে ম্যাক্সওয়েলের অবদান ছিল ৯১ রান।