সেমি-ফাইনাল জিতে উৎসবের আবহ আরও বাড়িয়ে তুলতে চায় ভারত, তাদেকে হারিয়েই স্বপ্ন পূরণের পথে আরেকধাপ এগোতে চায় নিউ জিল্যান্ড।
Published : 14 Nov 2023, 06:58 PM
দীপাবলির পর পেরিয়ে গেছে দুদিন। কিন্তু মুম্বাই এখনও রঙিন। সন্ধ্যার পর পটকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে এখনও, আতশবাজির রোশনাইও চোখে পড়ছে। উৎসবের রেশ রয়ে গেছে চার পাশে। মুম্বাই তথা গোটা ভারত অপেক্ষায় এখন আরেকটি বড় উৎসবের। ক্রিকেট যেখানে ধর্মের মতো, তারা যদি নিজ দেশে জিততে পারে বিশ্বকাপ, এই উৎসবের মৌসুমে আনন্দ-উচ্ছ্বাস তো পূর্ণতা পাবে তখনই!
এক যুগ আগে যে মাঠে ভারত শিরোপা জিতেছিল ২৮ বছরের খরা কাটিয়ে, গৌতাম গাম্ভিরের দুর্দান্ত ইনিংসের পর মহেন্দ্র সিং ধোনির স্মরণীয় ছক্কায় শেষ হয়েছিল যে ম্যাচ, যেখানে সাচিন টেন্ডুলকারকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটেছিলেন ভিরাট কোহলি, সেই ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামেই ভারত এবার নামবে আরেকটি ফাইনালে ওঠার লক্ষ্যে। সেমি-ফাইনালে বুধবার তাদের সামনে বাধা নিউ জিল্যান্ড।
এমনিতে সেমি-ফাইনালে ফেভারিট বলে কিছু থাকে না। তবে ভারত এই টুর্নামেন্টে যেভাবে খেলছে, টানা ৯ ম্যাচ জয় বা আসরের একমাত্র অপরাজিত দল বলেই শুধু নয়, একের পর এক ম্যাচে প্রতিপক্ষকে তারা যেভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, তাতে এই সেমি-ফাইনালে নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে থেকে মাঠে নামছে রোহিত শার্মার দল। সঙ্গে গ্যালারির উপচেপড়া সমর্থন তো থাকবেই!
ম্যাচকে ঘিরে এমনিতেও শহরে উত্তেজনা প্রবল। মাঠের আশেপাশে দুদিন ধরে ভীড় লেগেই আছে। হন্নে হয়ে টিকেট খুঁজছেন অনেকে। কিন্তু চাইলেও কী আর সোনার হরিণের দেখা মেলে! ওয়াংখেড়ের গ্যালারি বুধবার আকাশী-নীলের সমুদ্রে রূপ নেবে নিশ্চিতভাবেই। ৩৩ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়ামে ৩৩ জন নিউ জিল্যান্ড সমর্থক পাওয়া গেলেও তা হবে বিস্ময়কর।
চার বছর আগেও কিন্তু চিত্র অনেকটা এরকমই ছিল!
২০১৯ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালেও মুখোমুখি হয়েছিল এই দুদল। সেখানেও ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের গ্যালারি ঠাসা ছিল ভারতীয় সমর্থকে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে দুই দিনে শেষ হওয়া ম্যাচে তাদেরকে স্তম্ভিত করে ফাইনালে উঠেছিল নিউ জিল্যান্ড। কন্ডিশন-গ্যালারি-পারিপার্শ্বিকতা বিরুদ্ধ হলেও নিউ জিল্যান্ড নিজেদের উজাড় করে দেবে এবারও।
ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে সেই প্রত্যয়ই শোনা গেল নিউ জিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের কণ্ঠে।
“আমরা জানি, খুবই কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষায়। ওরা এমন একটি দল, যারা সত্যিই খুব ভালো খেলছে। তবে আমরা জানি যে ফাইনাল, সেমি-ফাইনালের পর্যায়ে সবকিছু অনেকটা নতুন করে শুরু হয় এবং সবকিছুই নির্ভর করে সেই দিনটির ওপর।”
“দল হিসেবে আমাদের জন্য ব্যাপারটি হলো মনোযোগ মাঠের ক্রিকেটে রাখা। আমরাও বেশ ভালো ক্রিকেট খেলে আসছি। কিছু ম্যাচে খুব কাছে গিয়ে হেরেছি, কিছু জিতেছি, যে পথ ধরে আজকে আমরা এখানে। সামনের চ্যালেঞ্জ নিয়েও আমরা রোমাঞ্চিত।”
চার বছর আগের প্রেরণা তো তাদের আছেই। সেবার তাদের পুঁজি ছিল স্রেফ ২৩৯ রানের। কিন্তু নতুন বলে ম্যাট হেনরি ও ট্রেন্ট বোল্টের অসাধারণ স্পেল অনেকটাই ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিয়েছিল। ২৪ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ম্যাচ থেকে অনেকটা ছিটকে যায় ভারত। এবার বিশ্বকাপে এসেও চোটের কারণে ছিটকে গেছেন হেনরি। তবে বোল্ট, টিম সাউদি, লকি ফার্গুসন, কাইল জেমিসনরা আছেন। এবারও তাদের কাজটাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
রোহিত শার্মা, শুবমান গিল, ভিরাট কোহলিরা যে ধরনের ফর্মে আছেন, মূলত তারাই ম্যাচের পর ম্যাচ ভারতের জয়ের ভিত্তি গড়ে দিচ্ছেন। এই দলকে হারাতে হলে এই তিনজনকে দ্রুত ফেরানোর বিকল্প নেই। মিডল অর্ডারে শ্রেয়াস আইয়ার ও লোকেশ রাহুলও দুর্দান্ত খেলছেন। তবে বিপর্যয়ের মধ্যে ক্রিজে গিয়ে তারা কেমন খেলেন বা চাপটা কীভাবে সামলান, সেই পরীক্ষায় এখনও সেভাবে তাদের পড়তে হয়নি। তাই বোল্ট-সাউদিরা পারলে, নিউ জিল্যান্ডের সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে।
যদিও কাজ শেষ হবে না সেখানেই। ভারতের টপ অর্ডার যেমন প্রচণ্ড শক্তিশালী, তেমনি তাদের তিন পেসারও ভয়ঙ্কর। ম্যাচের পর ম্যাচ প্রতিপক্ষের টপ অর্ডার ভেঙে দিচ্ছেন তারা নিয়মিতই। জাসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ সিরাজ, মোহাম্মদ শামির ছোবল এড়িয়ে ভালো ভিত্তি গড়তে পারাটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
ম্যাচের দুই ইনিংসেই তাই প্রথম ১০-১৫ ওভার হবে গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়টাই নির্ধারণ করে দিতে পারে ম্যাচের গতিপথ।
তবে মাঠের লড়াই শুরুর আগেও কিন্তু ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়ে যেতে পারে। এবারের বিশ্বকাপে টস যে এই মাঠে বড় ভুমিকা রাখছে!
আগের যে চারটি ম্যাচ এখানে হয়েছে, আগে ব্যাট করা দল বিশাল ব্যবধানে জিতেছে তিন ম্যাচেই। আরেকটিতেও আগে ব্যাট করা দল বিশাল জয়ের পথেই ছিল। কিন্তু আফগানিস্তানের সেই রাতের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে যায় গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের রূপকথাময় এক ইনিংসে। সেই ব্যতিক্রম ছাড়া আগে ব্যাট করা মানেই যেন বড় জয়ের নিশ্চয়তা!
আগের চার ম্যাচে এখানে আগে ব্যাট করে গড় স্কোর ৩৫৭, পরে ব্যাট করে ১৮৭। ব্যবধানটা পরিষ্কার। ম্যাচের প্রথম ভাগে উইকেট দেখা যায় নিখাদ ব্যাটিং স্বর্গ, দ্বিতীয় ইনিংসে ফ্লাড লাইটের আলোয় বল সিম-সুইং করে, ব্যাটসম্যানদের জন্য তা সামলানো হয়ে উঠছে কঠিন।
ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শার্মা অবশ্য বললেন, টসকে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন না। এই শহরের সন্তান তিনি, এই মাঠে খেলেছেন অসংখ্য ম্যাচ। এই বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো দিয়েই তিনি এখানকার উইকেট বিবেচনা করতে চান না। তবে ভারতীয় নানা সংবাদ মাধ্যমের খবর, টসের প্রভাব কমানোর সব চেষ্টাই নাকি করা হচ্ছে। উইকেট যদি একটু মন্থর, একটু টার্নিংও করা যায়, তাহলে হয়তো দুই ইনিংসে তা কাছাকাছি মানের থাকবে।
মাঠের ক্রিকেটের বাইরে ভারতের যা শক্তির জায়গা, নিজেদের কন্ডিশন ও দর্শক, সেটি আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে উল্টো কাজও করতে পারে। প্রত্যাশার এমন প্রবল চাপে নক আউট ম্যাচে ভেঙে পড়াটা তো অস্বাভাবিক নয়! রোহিত অবশ্য বললেন, তারা এসব সামলাতে জানেন ভালোভাবেই।
“এই চাপ সামলেই আমরা ৯টি ম্যাচ জিতেছি। বিশ্বকাপ বলেই চাপের কথা বলা হচ্ছে। ভারতীয় ক্রিকেটারদের তো এসব চাপ সব ম্যাচে সব টুর্নামেন্টেই সামলাতে হয়। সব জায়গা থেকে শুনতে হয় যে ম্যাচ জিততে হবে, সেঞ্চুরি করতে হবে, ৫ উইকেট নিতে হবে। ভারতীয় ক্রিকেটারদের জন্য চাপ অবধারিত। আমরা চেষ্টা করে চলেছি, এসব পাশে সরিয়ে রেখে আমাদের খেলায় মনোযোগ রাখতে।”
রোহিতের সংবাদ সম্মেলনে চার বছর আগের সেমি-ফাইনালের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরেই এলো।
“ভারত যখন প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছে, এই দলের অর্ধেকের বেশির তখন জন্মই হয়নি। ভারত যখন সবশেষ বিশ্বকাপ জেতে, এই দলের অর্ধেক তখন খেলাই শুরু করেনি। আমাদের জন্য এখনকার দলটি বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়েই ভাবে। গত বিশ্বকাপ বা প্রথম বিশ্বকাপ কীভাবে আমরা জিতেছি, সেসব নিয়ে ওদের কথা বলতে দেখি না। সবার মনোযোগ, তারা কীভাবে আরও ভালো ক্রিকেটার হয়ে উঠতে পারে, দলে কী যোগ করতে পারে।”
মাঠের ক্রিকেট আর স্কিলের সঙ্গে টিম স্পিরিট সবসময় ঠিক রাখতেও খুব সচেতনভাবে চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানালেন রোহিত। প্রতি ম্যাচেই সেরা ফিল্ডারের পুরস্কার দিয়ে আসছে তারা, মূলত দলীয় ঐক্য পোক্ত করতে, সেটা নিয়ে তো তুমুল আলোচনা চলছেই। এছাড়াও দলীয় বন্ধন শক্ত করতে দলের ভেতর নানা আয়োজন চলছে বলেও জানালেন অধিনায়ক। সব মিলিয়ে দলটাকে একটা পরিবার হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে।
রোহিতরা যদি বিশ্বকাপ জিততে পারেন, তাহলে গোটা দেশই হয়তো হয়ে উঠবে একটি পরিবার। ভারতীয়রা অপেক্ষা করছে সেই মুহূর্তটির। নিউ জিল্যান্ডের হয়তো সেই আবেগ নেই। তবে আছে তাড়না, প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের প্রবল আকাঙ্খা।
সেই লড়াইয়ে তাই রোমাঞ্চ নিয়ে তাকিয়ে থাকাই যায়!