এক ম্যাচে অনেক জয় সাকিবের

ক্রিকেট ম্যাচে লড়াইয়ের ভেতর থাকে ছোট ছোট অনেক লড়াই, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই সব লড়াইয়েই জিতে দলকে জিতিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।  

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিদিল্লি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2023, 03:33 AM
Updated : 7 Nov 2023, 03:33 AM

অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের হাতে কোনো ঘড়ি ছিল না। তবু সাকিব আল হাসানকে আউট করার পর তিনি ঘড়িতে সময় দেখানোর মতো ভঙ্গি করলেন। তর্জমা বুঝতে কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। নিজের ‘টাইমড আউট’ নিয়েই খোঁচা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার। তার হয়তো ভাবনায় ছিল না, সময়ের খেলায় অনেক দেরি হয়ে গেছে তাদের! ওই ডেলিভারিতে ম্যাথিউস জিতলেও আরও অনেক লড়াইয়ে ততক্ষণে জিতেই গেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক!

ক্রিকেট ম্যাচে লড়াইয়ের ভেতরও থাকে অনেক ছোট ছোট লড়াই। সেই লড়াইগুলির ফলাফলই দিনশেষে গড়ে দেয় ম্যাচের ভাগ্য। সেখানেই সাকিব কালকের ম্যাচের নায়ক। ম্যাচ সেরার পুরস্কারও হয়তো পুরোপুরি বলতে পারছে না, এই ম্যাচে কত লড়াইয়ে জিতলেন সাকিব!

সবচেয়ে বড় লড়াইটা তিনি নিজেই ডেকে এনেছিলেন। ম্যাথিউসকে ‘টাইমড আউট’ করে আলিঙ্গন করেছিলেন বড় চ্যালেঞ্জ। সেধে মাখামাখি হয়েছিলেন চাপের সঙ্গে। এরপর তার আর পেছন ফিরে তাকানোর অবকাশ ছিল না। তিনি তাকাননি। চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটারের মতোই সমস্ত চ্যালেঞ্জকে দিয়েছেন পাল্টা জবাব।

তার জয়ের শুরুটা টস থেকেই। মুদ্রা নিক্ষেপে জিতেছেন ভাগ্যের জোরে। তবে ম্যাচ তো আর ভাগ্য দিয়ে জেতা যায় না। টসের সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করতে হয় ২২ গজে। সেটিও করেছেন তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে।

এই বিশ্বকাপেই যে মাঠে আগে ব্যাট করে দক্ষিণ আফ্রিকা করেছিল ৪৩৮, অস্ট্রেলিয়া ৩৯৯, সেখানে টস জিতে সাকিব নিলেন আগে বোলিং। তার যুক্তি, এখানে অনুশীলন সেশন থেকেই বুঝতে পেরেছেন যে, রাতে শিশির পড়ে প্রচুর। পরে ব্যাটিংয়ের সুবিধা তিনি কাজে লাগাতে চান।

ম্যাচ শেষে লক্ষ্য পূরণ করে সেই সাকিব তৃপ্তির হাসিতে বললেন, “টস জিতে আমার কোনো দ্বিধাই ছিল না এখানে আগে বোলিং করা উচিত…।”

ম্যাচ জয়ের পাশাপাশি তার সিদ্ধান্তেরও জয়!

সেই জয় অর্জনের পথ অবশ্যই মসৃণ ছিল না। পরে ব্যাটিং করা তুলনামূলক সহজ হলেও রানটা নাগালে রাখা জরুরি ছিল। উইকেট নিখাদ ব্যাটিং স্বর্গ। মাঠের সীমানা ছোট, আউটফিল্ড গতিময়। ৩২০-৩৩০ রান এখানে স্বাভাবিক ক্রিকেট খেলেই হওয়া উচিত! সত্যিই যদি শ্রীলঙ্কা তিনশ ছাড়াত, রাতের শিশিরের পরও বাংলাদেশের কাজটা হতো ভীষণ কঠিন। তিনশর বেশি রানের যে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, ফর্মে না থাকা একঝাঁক ব্যাটসম্যানদের জন্য বড় চাপ হয়ে যেত তা।

শ্রীলঙ্কার রান যে ২৮০ ছুঁতে পারল না, তাতে তাদের ব্যাটসম্যানদের খামখেয়ালিপনার কিছুটা অবদান তো আছেই। তবে বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডারদের কৃতিত্বও দিতে হবে। যথারীতি এখানে অগ্রণী ছিলেন সাকিব।

মুশফিকুর রহিমের অসাধারণ ক্যাচে কুসাল পেরেরা প্রথম ওভারে আউট হওয়ার পর পাথুম নিসানকা ও কুসাল মেন্ডিস ভালো একটি জুটি গড়ে তোলেন। দ্বাদশ ওভারে বল হাতে নিয়ে প্রথম ওভারেই মেন্ডিসকে ফিরিয়ে জুটি ভাঙেন সাকিবই।

পরে চারিথ আসালাঙ্কা ও সাদিরা সামারাউইক্রামার জুটি যখন বাংলাদেশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে, তখনও দাওয়াই হয়ে আসেন অধিনায়কই। এবার তিনি বিদায় করেন দারুণ খেলতে থাকা সামারাউইক্রামাকে।

সেই প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৩ উইকেট নেওয়ার পর চার ম্যাচের একটিতেও একাধিক উইকেট নিতে পারেননি তিনি। অবশেষে জোড়া শিকারের স্বাদ পেলেন। দুটিই গুরুত্বপূর্ণ উইকেট। ছোটখাটো একটা জয় তো বটেই!

ম্যাচের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা এরপরই। সেখানে সাকিব কেন্দ্রবিন্দুতে এবং সবচেয়ে বড় চাপটা তিনি নিজের ওপর নিয়ে নিলেন তখনই। সামারাউইক্রামাকে আউট করার পরপরই ম্যাথিউসকে ‘টাইমড আউট’ করার আবেদন করলেন, আম্পায়ারের দুই বার জিজ্ঞাসা এবং ম্যাথিউসের অনুরোধেও অবস্থান থেকে সরলেন না। ম্যাচের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আগুন নিয়ে খেলা!

তিনি জানতেন, এই ঘটনার পর ম্যাচজুড়ে চর্চা হবে প্রচুর। সবার নজর থাকবে তার দিকে। প্রতিপক্ষের তোপের মুখেও থাকবেন তিনি। সম্ভাব্য সবকিছুতেই তিনি সাদরে বরণ করেছেন। ম্যাচ শেষে কারণটিও ব্যাখ্যা করেছেন, “আজকের ম্যাচে আমাদের জিততেই হতো। আমরা যদি যুদ্ধে নামি, তাহলে যুদ্ধে আপনার দলকে বা দেশকে জেতাতে সবকিছু করতে রাজি থাকা উচিত বলে মনে করি। আমি সেটাই করেছি।"

ম্যাথিউসের বিদায়ে ৫ উইকেটে ১৩৫ হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা তবু ২৭৯ পর্যন্ত যেতে পারল চারিথ আসালাঙ্কার সেঞ্চুরিতে। রান তাড়ায় বাংলাদেশের দুই ওপেনার বিদায় নিলেন ৭ ওভারের মধ্যে। দৃশ্যপটে তখন আবার সাকিব আল হাসান।

আগের দুই ম্যাচে পাঁচ-ছয়ে ব্যাট করলেও এ দিন তিনি নামলেন চারে। একটা বার্তাও তাতে ছড়িয়ে দিলেন। সময়টা বিরুদ্ধ হলেও তিনি ভড়কে যাননি, বরং চ্যালেঞ্জ নিতেই নেমেছেন! এবারের আসরে তখনও পর্যন্ত তিনি ব্যাট হাতে একদমই অচেনা। একটা ভালো ইনিংস দরকার। দলের শুরুটা নড়বড়ে, একটা ভালো জুটি দরকার। প্রতিপক্ষ তেতে আছে, পাল্টা জবাব দেওয়া দরকার।

সবচেয়ে বড় কথা, তিনি জানতেন যে ক্রিজে যাওয়া মাত্রই প্রকিপক্ষ চেপে ধরবে নানা ভাবে। ‘টাইমড আউট’-এর ‘বদলা’ নেওয়ার চেষ্টা করবে প্রবলভাবে। কিন্তু সাকিবের ভাবনায় তো এটি যুদ্ধক্ষেত্র। সেনাপতিকে তো সামনে থেকেই লড়তে হয় প্রবলবিক্রমে! সাকিব দাঁড়িয়ে গেলেন ব্যাটকে তরবারি বানিয়ে।

তিনি উইকেটে যাওয়া মাত্রই কাছে গিয়ে কিছু একটা বললেন ম্যাথিউস। উষ্ণতায় ভরা সাদর সম্ভাষণ নিশ্চয়ই নয়! ক্রিজের চারপাশ থেকে লঙ্কানরা কথার তোপ দাগাতে থাকলেন। লড়াইটা তখন অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক। মনোযোগ নাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা, কথার তিরে বিদ্ধ করে ড্রেসিং রুমে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা।

পাওয়ার প্লে শেষ হতেই বল হাতে এগিয়ে এলেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস। মনোজগতের আরেকটি লড়াই! সাকিব এবার ফাঁদে পা দিলেন শুরুতেই। প্রথম বলেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে মারার চেষ্টায় ব্যর্থ হলেন। পরের বলে আবার একই চেষ্টায় ক্যাচ দিয়ে বসলেন। তবে দিনটি তো তার! আসালাঙ্কা তাই মুঠোয় জমাতে পারলেন না বল।

৭ রানে নবজীবন। নব ভাবনার প্রকাশও ফুটে উঠতে থাকল। এরপর আর ফাঁদে পা দিলেন না। খেই হারালেন না মানসিক লড়াইয়ে। বরং ছুটে চললেন দারুণ দাপটে। চাপের সঙ্গে লড়াইয়ে দারুণ এক জয়!

টেম্পারমেন্টের পাশাপাশি স্কিলের লড়াইও চলছিল শুরু থেকেই। এই বিশ্বকাপে তার যম হয়ে উঠেছিল শর্ট বল। এমন নয় যে খেলতে খুব ভুগছেন বা অস্বস্তিতে পড়ছিলেন। কিন্তু বারবার আউট হচ্ছিলেন শর্ট বলেই। এই ম্যাচের আগে ৬ ইনিংসে ৫ বার!

লঙ্কানদের সম্ভাব্য কৌশলও তাই অনুমিতই ছিল। সাকিব ক্রিজে যাওয়ার পরপরই আক্রমণে আনা হলো দলের সবচেয়ে গতিময় বোলার দুশমান্থা চামিরাকে। একটু পর শর্ট বলও এলো। চোখের পলকে পুল করে দিলেন সাকিব। বল ছুটল বাউন্ডারিতে। একটু পর চামিরার আরেকটি শর্ট বল আছড়ে পড়ল গ্যালারিতে। আগেই লেংথ অনুমান করতে পেরে অফ স্টাম্পের দিকে শাফল করে বলের নিচে গিয়ে উড়িয়ে মারলেন সাকিব।

ব্যস, শর্ট বলের জুজুর বিদায় দুই শটেই!

শর্ট বলে হেড পজিশন নিয়ে যে কাজ করছিলেন, কলকাতা পর্বের আগে ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে দুটি সেশন করলেন শৈশবের কোচের সঙ্গে, সেটির ছাপ কিছুটা পাওয়া গেল। এমনকি, এই ম্যাচের দুই দিন আগে দিল্লির নেটে অনুশীলনের সময় ক্রমাগত শর্ট বল খেলার সময় মাথার অবস্থান যেমন ছিল, সেটিও দেখা গেল এ দিন। অনেকটাই অপ্রথাগত, উন্মুক্ত স্টান্সে, পায়ের সঙ্গে একই লাইনে না থেকে বরং মাথা আগে থেকেই একটু ডানপাশে সরানো। দেখলে একটু অদ্ভুতূড়ে লাগে বটে, তবে এই ম্যাচের জন্য অন্তত কার্যকর। রিফ্লেক্স আগের মতো নেই বলেই হয়তো আগেভাগেই পজিশনে চলে যাওয়ার চেষ্টা।

এভাবেই খেলে সফল হলেন। পুল করলেন একের পর এক। শর্ট বল ছাড়লেনও বেশ কিছু। ব্যস, স্কিলের লড়াইয়েও দাপুটে জয়!

নাজমুল হোসেন শান্তর সঙ্গে গড়ে উঠল দারুণ এক ম্যাচ জেতানো জুটি।

এরপর অপেক্ষা ছিল একটি খরা কাটানোর। সেই ২০১৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর থেকে আর তিন অঙ্কের স্বাদ তিনি পাননি। প্রতীক্ষার অবসান হলো না এই ম্যাচেও। ওই মুহূর্তটাতেই কেবল জিতলেন ম্যাথিউস।

তবে সাকিবের জয়গাঁথা ততক্ষণে প্রায় রচিত হয়েই গেছে। দলের জয়ে পরে তা পূর্ণতা পেল। সেঞ্চুরি না পেলেও ৬৫ বলে ৮২ রানের যে ইনিংসটি খেললেন, তা মনে করিয়ে দিল সেরা সময়ের সাকিবকে। ওয়ানডেতে ফিফটি ছোঁয়া ইনিংসে গত সাত বছরের মধ্যে তার সেরা স্ট্রাইক রেটের ইনিংস এটি (১২৬.১৫)।

ম্যাচ সেরার পুরস্কার তোলা ছিল তার জন্যই। এই নিয়ে চারবার ম্যান অব দা ম্যাচ হলেন বিশ্বকাপে, যেখানে তার সঙ্গী ভিরাট কোহলি, সৌরভ গাঙ্গুলি, ব্রায়ান লারা, শেন ওয়ার্ন, মার্ক ওয়াহ, আরাভিন্দা ডি সিলভা, ডেভিড বুন, কুমার সাঙ্গাকারা, ইউভরাজ সিং, মাহেলা জায়াওয়ার্দেনের মতো তারকারা।

ওয়ানডে ক্রিকেটে ২৭ বার ম্যাচ সেরা হয়ে স্পর্শ করলেন ইউভরাজ ও এবি ডি ভিলিয়ার্সের মতো অলটাইম গ্রেটদের দুজনকে।

তিনি নিজেও তো সেই কাতারেই। এই বিশ্বকাপে তার পারফরম্যান্স প্রত্যাশার ধারে কাছে নেই। সেমি-ফাইনাল স্বপ্ন পূরণের মতো পারফরম্যান্স তিনি দেখাতে পারেননি, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেননি। দলকে উজ্জীবিত করতে না পারার দায়ও অধিনায়ক হিসেবে তার পড়ে। তবু অনেক কিছু হারিয়ে যখন শেষের প্রাপ্তির চেষ্টা, সেই তিনিই তখন আবার ত্রাতা।

সবেধন নীলমণি। সাকিব জিতলেন বলেই জিতল বাংলাদেশ।