বছর চারেক বিরতিতে আরেকটি ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলে এসেছে প্রায়। অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডের এই একাদশ আসরের খেলা মাঠে গড়ানোর আগে সময়ের আয়নায় ফিরে দেখা যাক আগের ১০ আসর। ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক শিরোপার সঙ্গে আসে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
Published : 07 Feb 2015, 05:20 PM
২০১১: বাংলাদেশেও বিশ্বকাপ, শিরোপা ভারতের
২০০৩: অস্ট্রেলিয়ার টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা
১৯৯৯: অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক বিশ্বকাপের জয়ের সূচনা
১৯৯৬: শ্রীলঙ্কার আভিজাত্যে উত্তরণের কাহিনী
১৯৯২: পাকিস্তানের ক্রিকেটীয়-রূপকথা
১৯৮৭: উপমহাদেশে প্রথম বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্যের সূচনা
১৯৮৩: অঘটনের তৃতীয় বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন ভারত
আয়োজনের দিক দিয়ে সবচেয়ে ব্যর্থ বিশ্বকাপ কোনটি? জরিপে নিঃসন্দেহে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হবে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের তাতে বয়েই গেল! প্রথম দলটি সেবার জেতে তাদের হ্যাটট্রিক শিরোপা। দ্বিতীয় দলটি ভারতের মতো পরাশক্তিকে হারিয়ে সুপার এইটে ওঠে বধ করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। নিজেদের ওই সোনালী সাফল্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের আয়োজকদের ধূসর ব্যর্থতা তারা মনে রাখবে কেন!
তবে সেই আয়োজনের ব্যর্থতাটা ছিল আসলে চোখে পড়ার মতোই। ক্যারিবিয়ানদের জীবনধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিকল্পনাহীনতা আর অব্যবস্থাপনা তো ছিলই পদে পদে। সেটি দুঃস্বপ্নের হয়ে ওঠে আরো নানা কারণে। টেস্ট খেলুড়ে ১০ দেশের সঙ্গে আরো ৬টি সহযোগী সদস্য মিলিয়ে টুর্নামেন্টের দলসংখ্যা ছিল ১৬। ফলে একপেশে ম্যাচের সংখ্যা ছিল ভুরি ভুরি। আবার গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের কাছে হেরে ভারত এবং আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে পাকিস্তান বিদায় নেয়ায় অনেকের কাছেই আকর্ষণ হারায় বিশ্বকাপ।
বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সুপার এইটে ওঠায় সেখানেও অর্থহীন ম্যাচের সংখ্যা বাড়ে হু হু করে। বাংলাদেশ না হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে চমক দেখিয়েছে। কিন্তু কার্যত সেমি-ফাইনালে খেলার সম্ভাবনা ওই দলদুটি জাগাতে পারেনি কখনো। বাকি ছয় দলের মধ্যেই সীমিত ছিল সেই লড়াই।
মাঠের ক্রিকেট যেমনই হোক, আমুদে ক্যারিবিয়ান দর্শকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের গ্যালারিটা রঙিন হওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকে সবসময়। কিন্তু সেটি রঙচটা হয়ে যায় আইসিসির অবিশ্বাস্য এক সিদ্ধান্তে। ঢোল-বাদ্যি নিয়ে দর্শকদের স্টেডিয়ামে প্রবেশ যে নিষিদ্ধ করে তারা! সঙ্গে ছিল চড়া মূল্যের টিকেট। সব মিলিয়ে নিজ দেশের বিশ্বকাপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা।
টুর্নামেন্ট শেষের এসব বিশ্লেষণে কিছু যায়-আসে না অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের। তাদের বিশ্বকাপ কেটেছে যে স্বপ্নের মতো! রাজত্ব অক্ষুণ্ন রেখে টানা তৃতীয় ট্রফি জেতে অসিরা। আর বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো প্রথম রাউন্ডের গন্ডি পেরোয় বাংলাদেশ। ২০০৩ বিশ্বকাপের দুঃস্বপ্নের কথা মাথায় রাখলে সেটি ছিল যে স্বপ্ন ছাড়ানো অর্জন!
ভারতের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচের আবহে অবশ্য বিষাদের ছায়ায় ঢেকে ছিল হাবিবুল বাশারের দল। দেশ থেকে মানজারুল ইসলামের মৃত্যুসংবাদ উড়ে আসায়। এই বাঁহাতি স্পিনার খুব সহজেই স্কোয়াডের অংশ হয়ে উড়ে আসতে পারতেন ক্যারিবিয়ানে। অল্পের জন্য চূড়ান্ত দলে জায়গা হয়নি। খুলনায় সড়ক দুর্ঘটনায় মানজারের মৃত্যুর খবর ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে পৌঁছে ভারতের বিপক্ষে খেলার আগের দিন।
শোককে শক্তিতে পরিণত করে সেদিন মাঠে নামে হাবিবুলের দল। মাশরাফি বিন মর্তুজার চার উইকেট এবং তিন তরুণ তুর্কি তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসানের অর্ধশতকে ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকাপকেই কাঁপিয়ে দেয় বাংলাদেশ। আর ওই এক ম্যাচের ফলে বাংলাদেশ সুপার এইটে ওঠা এবং ভারত বিদায়ের পথে এগিয়ে যায় অনেকখানি।
আসলে ২০০৭ বিশ্বকাপের ফরম্যাটটাই ছিল এমন। আইসিসির পূর্ণ সদস্য ১০ টেস্টের সঙ্গে সে সময় ওয়ানডে স্ট্যাটাস থাকা কেনিয়া সরাসরি খেলে টুর্নামেন্টে। সঙ্গে যুক্ত হয় আইসিসি ট্রফি পেরিয়ে আসা পাঁচ দল- আয়ারল্যান্ড, কানাডা, বারমুডা, নেদারল্যান্ডস ও স্কটল্যান্ড। ১৬ দলকে শুরুতে ভাগ করা হয় চার গ্রুপে; প্রতি গ্রুপে চারটি করে দল। সেখানে লিগ পদ্ধতিতে একে অন্যের সঙ্গে খেলে সব গ্রুপের সেরা দুটি দল ওঠে সুপার এইট পর্বে।
‘বি’ গ্রুপে প্রথম ম্যাচ জিতে তাই সুপার এইটের পথে অনেকটাই এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার কাছে হারলেও বারমুডাকে হারিয়ে ঠিকই প্রথম পর্ব পেরোয় তারা। ওদিকে ভারত ছিটকে পড়ে বাংলাদেশের পর শ্রীলঙ্কার কাছেও হেরে; মাঝের ম্যাচটিতে বারমুডাকে হারালেও তাই কোনো লাভ হয়নি।
‘এ’ গ্রুপে ঘটেনি কোনো অঘটন। নেদারল্যান্ডস-স্কটল্যান্ডকে পিছু ফেলে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা ওঠে সুপার এইটে। ‘সি’ গ্রুপেও কেনিয়া-কানাডাকে ছিটকে দিয়ে ওঠে নিউ জিল্যান্ড-ইংল্যান্ড। কিন্তু ‘ডি’ গ্রুপে ঘটে যায় বড়সড় অঘটন। স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ তিন জয়ে পরবর্তী পর্ব নিশ্চিত করলেও পাকিস্তান পারেনি তাদের সঙ্গী হতে। তাদের হারানো আয়ারল্যান্ড জায়গা করে নেয় সেরা আটে। তবে এর চেয়ে বড় দুর্ঘটনা মাঠের বাইরে। আইরিশদের কাছে হারের কয়েক ঘন্টা পর হোটেল কক্ষে পাওয়া যায় পাকিস্তানের কোচ বব উলমারের মৃতদেহ। কেন, কিভাবে তাঁর মৃত্যু হল এই রহস্যের কিনারা হয়নি আজো।
টুর্নামেন্টে টিকে থাকা চার দল অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডের সামনে চ্যালেঞ্জটা ছিল অভিন্ন- নিজেদের দুটো ম্যাচ জিতে বিশ্বকাপ জিতে নেওয়ার।
সেমি-ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ আফ্রিকাকে সহজেই হারিয়েছে সাত উইকেটে। আগে ব্যাটিং করা প্রোটিয়ারা ২৭ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ম্যাচ হেরে যায় প্রায়। সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে ১৪৯ পর্যন্ত যেতে পারলেও সেটি আর অসিদের জয়রথ থামানোর মতো ছিল না। অন্য সেমি-ফাইনালে নিউ জিল্যান্ডকে ৮১ রানে হারিয়ে ১৯৯৬ সালের পর প্রথমবারের মতো ফাইনালে ওঠে শ্রীলঙ্কা।
এই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোনো ফাইনাল হল ‘রি-ম্যাচ’। শ্রীলঙ্কার সামনে সুযোগ ছিল ১৯৯৬ সালের পুণরাবৃত্তির। কিন্তু সেটি ছাপিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিশোধটাই হয়ে গেল যে! অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ১০৪ বলে ১৪৯ রানের বিধ্বংসী ইনিংসে বৃষ্টির কারণে দৈর্ঘ্য কমে আসা ম্যাচে ৩৮ ওভারেই চার উইকেটে ২৮১ রান তুলে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। এরপর দ্বিতীয় উইকেটে সনাৎ জয়াসুরিয়া ও কুমার সাঙ্গাকারা ১১৬ রানের জুটিতে ভালোই জবাব দিচ্ছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এই দুজনের আউট পর আস্কিং রেটের সঙ্গে আর পাল্লা দিতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। ম্যাচ শেষের বেশ আগেই ম্যাচটি হেরে যায় তারা।
তবে সেই শেষটা হয়ে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের আরেক কলঙ্ক। আরেক দফা বৃষ্টিতে শ্রীলঙ্কার সামনে পুনঃনির্ধারিত লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩৬ ওভারে ২৬৯ রান। ৩৩ ওভারে আলোর স্বল্পতায় দুই আম্পায়ার স্টিভ বাকনর-আলিম দার যখন খেলা বন্ধ ঘোষণা করেন, ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে তখন ৩৭ রানে এগিয়ে অস্ট্রেলিয়া। নূন্যতম ২০ ওভার যেহেতু ব্যাটিং হয়ে গেছে, বিশ্বকাপ জয়ের উল্লাসে তাই মেতে ওঠে পন্টিংয়ের দল। দুই আম্পায়ার বাধ সাধলেন সেই উৎসবে। জানালেন, যেহেতু বৃষ্টির কারণে না, আলোর স্বল্পতার কারণে খেলা বন্ধ হয়েছে, সে কারণে শ্রীলঙ্কার ইনিংসের বাকি তিন ওভারও ব্যাটিং করতে হবে; আর সেটি রিজার্ভ ডেতে।
অবশ্য ভুলে ভরা ২০০৭ বিশ্বকাপের এমন শেষ না হলে হয়তো ঠিক মানাতও না!
সবচেয়ে বেশি রান:
খেলোয়াড় (দেশ) | ম্যাচ | রান | সেরা | গড় | ১০০/৫০ |
ম্যাথু হেইডেন (অস্ট্রেলিয়া) | ১১ | ৬৫৯ | ১৫৮ | ৭৩.২২ | ৩/১ |
মাহেলা জয়াবর্ধনে (শ্রীলঙ্কা) | ১১ | ৫৪৮ | ১১৫* | ৬০.৮৮ | ১/৪ |
রিকি পন্টিং (অস্ট্রেলিয়া) | ১১ | ৫৩৯ | ১১৩ | ৬৭.৩৭ | ১/৪ |
স্কট স্টাইরিস (নিউজিল্যান্ড) | ১০ | ৪৯৯ | ১১১* | ৮৩.১৬ | ১/৪ |
জ্যাক ক্যালিস (দ. আফ্রিকা) | ১০ | ৪৮৫ | ১২৮* | ৮০.৮৩ | ১/৩ |
সবচেয়ে বেশি উইকেট:
খেলোয়াড় (দেশ) | ম্যাচ | উইকেট | সেরা | গড় | ইকোনমি রেট |
গ্লেন ম্যাকগ্রা (অস্ট্রেলিয়া) | ১১ | ২৬ | ৩/১৪ | ১৩.৭৩ | ৪.৪১ |
মুত্তিয়া মুরালিধরন (শ্রীলঙ্কা) | ১০ | ২৩ | ৪/১৯ | ১৫.২৬ | ৪.১৪ |
শন টেইট (অস্ট্রেলিয়া) | ১১ | ২৩ | ৪/৩৯ | ২০.৩০ | ৫.৫২ |
ব্র্যাড হগ (অস্ট্রেলিয়া) | ১১ | ২১ | ৪/২৭ | ১৫.৮০ | ৪.০০ |
লাসিথ মালিঙ্গা (শ্রীলঙ্কা) | ৮ | ১৮ | ৪/৫৪ | ১৫.৭৭ | ৪.৮৬ |