বছর চারেক বিরতিতে আরেকটি ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলে এসেছে প্রায়। খেলা মাঠে গড়ানোর আগে সময়ের আয়নায় ফিরে দেখা যাক আগের ১০ আসর। ২০০৩ সালে আফ্রিকায় বিশ্বকাপে শিরোপা ধরে রাখে অস্ট্রেলিয়া।
Published : 05 Feb 2015, 08:22 PM
সর্বকালের সেরা লেগস্পিনার হিসেবে তাঁর নাম চলে আসে প্রায় অবধারিতভাবে। অস্ট্রেলিয়ার ১৯৯৯ বিশ্বকাপ জেতানোর মূল নায়কও তিনি। সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে চারটি করে উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। পরের বিশ্বকাপে দলের অন্যতম ভরসা যে থাকবেন তিনি, তাতে আর আশ্চর্য কী!
আশ্চর্যের ব্যাপার অন্যত্র। ২০০৩ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ম্যাচের ঠিক আগের দিন সেই শেন ওয়ার্নের মাদক পরীক্ষায় উতরাতে ব্যর্থ হওয়া। টুর্নামেন্ট মাঠে গড়ানোর আগেই টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাওয়া। স্বাভাবিক কারণেই অসিদের বিশ্বকাপ পরিকল্পনা হয়ে যায় এলোমেলো। তাতে শিরোপা ধরে রাখার সম্ভাবনা শেষ বলে রায় দেওয়ার মতো বিশ্লেষকও কম ছিলেন না। কিন্তু দলটি অস্ট্রেলিয়া বলে কথা! ওয়ার্নকে হারানোর হোঁচট সামলে ঠিকই টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয় তারা।
২০০৩ বিশ্বকাপ মাঠে গড়ানোর আগে বিতর্ক ছিল আরেক জায়গায়। প্রথমবারের মতো ওই বিশ্বকাপের আসর বসেছিল আফ্রিকা মহাদেশে। মূল আয়োজক দক্ষিণ আফ্রিকা হলেও জিম্বাবুয়ে-কেনিয়া ছিল সহআয়োজক। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সরকারের সম্পর্ক তখন বেশ খারাপ। হারারেতে ম্যাচ না খেলার ব্যাপারে তাই ইংলিশ অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডকে নির্দেশনা দেয় সরকার। অনেক আলোচনার পর ইংল্যান্ডের দল জিম্বাবুয়ে না যাওয়াই মনস্থির করে। ওদিকে নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে একই রকম সিদ্ধান্ত নেয় নিউ জিল্যান্ডও। কেনিয়ার বিপক্ষে নাইরোবির ম্যাচটি ওয়াকওভার দেয় তারা। ’৯৬ সালে একই রকমভাবে শ্রীলঙ্কা খেলতে যায়নি অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে টুর্নামেন্টের গতিপথ নির্ণয়ে সেটি ততটা প্রভাব রাখেনি।
কিন্তু ইংল্যান্ডের জিম্বাবুয়েকে এবং নিউ জিল্যান্ডের কেনিয়াকে ওয়াকওভার দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল সুদূরপ্রসারী। বুমেরাং হয়ে সেটি ইংল্যান্ডকে বিদায় করে দেয় প্রথম রাউন্ডে। আর কেনিয়ার সেমি-ফাইনাল উত্তরণেও বড় ভূমিকা ছিল ওয়াকওভার থেকে পাওয়া চারটি বোনাস পয়েন্ট।
১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর আইসিসির পূর্ণসদস্য পদ পেয়ে টেস্ট পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ খেলার জন্য তাই আর আইসিসি ট্রফিতে খেলতে হয়নি তাদের। ওয়ানডে মর্যাদা পাওয়া কেনিয়াও সরসারি পায় টুর্নামেন্টের টিকেট। আইসিসি ট্রফি পেরিয়ে আসে নেদারল্যান্ডস, কানাডা ও নামিবিয়া। এর মধ্যে শেষ দলটির সেটি ছিল প্রথম বিশ্বকাপ।
১০টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের সঙ্গে চারটি সহযোগী সদস্য - ২০০৩ বিশ্বকাপের দলসংখ্যা ছিল তাই ১৪। চার বছর আগের চেয়ে দল দুটি বাড়লেও ফরম্যাট রাখা হয় অভিন্ন। সেই দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলা, সেরা তিনটি করে দলের সুপার সিক্সে ওঠা, সেখানে গ্রুপপর্বের সঙ্গী হয়ে যাওয়া দলগুলোর বিপক্ষে পাওয়া পয়েন্ট নিয়ে যাওয়া আর অন্য গ্রুপের তিন দলের বিপক্ষে খেলা। আগের বিশ্বকাপের ‘শিক্ষা’ না নিয়ে সুপার সিক্সের জটিলতার পথেই হাঁটে আবার আইসিসি।
গ্রুপ পর্বের সবচেয়ে বড় চমক ছিল বড় চার পরাশক্তির ঝরে পড়া। ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযান শেষ প্রথম রাউন্ডে। এদের মধ্যে বিশেষত প্রোটিয়াদের বাদ পড়াটা ছিল বিস্ময়কর। বর্ণবাদের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ক্রিকেটে ফেরার পর থেকেই পরাশক্তি হিসেবে বিবেচিত তারা। ১৯৯২ থেকে যে তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছে, প্রথম রাউন্ড পেরিয়েছে অনায়সে। নানা দুর্ভাগ্য পিছু না নিলে এক বা একাধিক শিরোপাও জিততে পারত তারা। সেই দক্ষিণ আফ্রিকা ২০০৩ সালে নিজেদের মাঠের বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে বাদ! আসলে এখানেও কাটা পড়েছে তারা দুর্ভাগ্য আর নির্বুদ্ধিতায়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বৃষ্টির বাধায় পড়া শেষ ম্যাচে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রান তুলে ফেলেছিল বলে ভেবেছিল তারা। ড্রেসিংরুম থেকে পাঠানো হয় তেমন বার্তাও। কিন্তু খেলা শেষে দেখা গেল, ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে ম্যাচটি টাই হয়েছে কেবল। দক্ষিণ আফ্রিকার ছিটকে যাওয়ায় যথেষ্ট ছিল সেটি।
এই ‘বি’ গ্রুপ থেকে সুপার সিক্সে ওঠে শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া ও নিউ জিল্যান্ড। বাদ পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কানাডা ও বাংলাদেশ। প্রথম বিশ্বকাপটা রূপকথার মতো কাটলেও বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ছিল দুঃস্বপ্নের সমার্থক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচটিই কেবল ভেসে গেছে বৃষ্টিতে। হেরেছে তারা বাকি পাঁচ ম্যাচে। যার মধ্যে ছিল কানাডা-কেনিয়ার কাছে লজ্জাজনক পরাজয়ও।
‘এ’ গ্রুপ থেকে অস্ট্রেলিয়ার সুপার সিক্সে উঠতে সমস্যা হয়নি বিন্দুমাত্র। ওয়ার্নকে হারানোর ধাক্কা সামলে ছয় ম্যাচের ছয়টিই জেতে তারা। পাঁচ জয়ে তাদের সঙ্গী ভারত। আগের বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট পাকিস্তান বাদ পড়ে প্রথম রাউন্ডেই। দুই জয়, তিন হারের পাশাপাশি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচটি ভেসে যায় বৃষ্টিতে। ওই পরিত্যক্ত খেলা থেকে পাওয়া দুই পয়েন্ট আবার আফ্রিকান দেশটিকে সুপার সিক্সে তুলে দেওয়ার জন্য হয় যথেষ্ট। ইংল্যান্ড ওয়াকআউট করায় চার পয়েন্ট তো আগেই পায় তারা। নামিবিয়া-নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে অর্জন আরো আট পয়েন্ট। সঙ্গে পরিত্যক্ত ম্যাচের দুই পয়েন্ট যোগ হওয়ায় ১৪ পয়েন্ট নিয়ে সুপার সিক্সে ওঠে জিম্বাবুয়ে। দুই পয়েন্ট পেছনে থাকা ইংল্যান্ড বাড়ি ফিরে যায় তড়িঘড়ি। জিম্বাবুয়েকে চার পয়েন্ট ছেড়ে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার বন্দোবস্ত অবশ্য আগেই করে রেখেছিল তারা।
সুপার সিক্স পর্ব সবার উপরে থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া ও কেনিয়া; নিজ নিজ গ্রুপ থেকে আসা বাকি দুই দলকে হারানোয়। সুপার সিক্সে তাই একটি করে ম্যাচ জিতলেই সেমি-ফাইনালের হাতছানি ছিল কেনিয়ার। জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে সেই লক্ষ্যপূরণ হয় তাদের। অস্ট্রেলিয়ার জয়যাত্রা অব্যাহত এখানেও। সুপার সিক্সের তিন ম্যাচই জেতে তারা। তিন ম্যাচ জেতে ভারতও। আর চতুর্থ দল হিসেবে সেমি-ফাইনালে ওঠে ১৯৯৬ এর চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা। বাদ পড়ে নিউজিল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ে।
সেমি-ফাইনালে কেনিয়া-রূপকথা থেমে যায় সৌরভ গাঙ্গুলি-শচীন টেন্ডুলকারের সামনে। ‘লিটল মাস্টার’ করেছিলেন ৮৩, অধিনায়ক ১১১*। তাতে ৫০ ওভারে চার উইকেটে ২৭০ রানে ইনিংস শেষ করে ভারত। কেনিয়া এরপর অলআউট মাত্র ১৭৯ রানে। অন্য সেমি-ফাইনালও হয়েছে একপেশে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫০ ওভারে ধুঁকতে ধুঁকতে অস্ট্রেলিয়া যখন ৭ উইকেটে মোটে ২১২ রানে গিয়ে থেমে যায়, তখন কিন্তু এমন পূর্বাভাস করা যায়নি। এরপর বল হাতে ব্রেট লি আগুন ঝরালেন, গ্লেন ম্যাকগ্রা বরাবরের মতো মিতব্যয়ী। ৩৯তম ওভারে বৃষ্টি যখন এল, লঙ্কানরা তখন সাত উইকেট হারিয়ে ১২৩ রানে। ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে ৪৮ রানে জিতে টানা তৃতীয়বারের মতো ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া।
আর অস্ট্রেলিয়া টানা দ্বিতীয় শিরোপা জেতে কী রাজসিকভাবেই! জোহান্সবার্গের সেই ফাইনালে টস জিতে প্রতিপক্ষকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানান সৌরভ গাঙ্গুলি। প্রতিপক্ষ অধিনায়ক রিকি পন্টিং বিস্ফোরক সেঞ্চুরিতে এক অর্ধেই এক অর্থে শেষ করে দেন খেলা। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট-ম্যাথু হেইডেন মাত্র ১৪ ওভারে ১০৫ রানের ওপেনিং জুটি গড়ে দেন ভিত্তি। এরপর পন্টিং ১২১ বলে ১৪০ রানের অসাধারণ ইনিংস খেললে দুই উইকেটে ৩৫৯ রানের পাহাড় গড়ে অস্ট্রেলিয়া।
সেটি টপকানোর সাধ্য ভারতের ছিল না। প্রথম ওভারেই শচীন টেন্ডুলকার আউট হয়ে যাওয়ায় সেটি হয়ে পড়ে আরো অসম্ভব। বীরেন্দর শেবাগ (৮২) চেষ্টা করেছিলেন কিছুটা। তবু জয়ের ধারেকাছেও যেতে পারেনি ভারত। ৩৯.১ ওভারে ২৩৪ রানে অলআউট হয়ে তারা হেরে যায় ১২৫ রানের বিশাল ব্যবধানে।
সোনালী চুলের চ্যাম্পিয়ন বোলার শেন ওয়ার্নকে ছাড়াও সোনালী সময়ের ঝাণ্ডা তাই ওড়াতে থাকে অস্ট্রেলিয়া।
সবচেয়ে বেশি রান:
খেলোয়াড় (দেশ) | ম্যাচ | রান | সেরা | গড় | ১০০/৫০ |
শচীন টেন্ডুলকার (ভারত) | ১১ | ৬৭৩ | ১৫২ | ৬১.১৮ | ১/৬ |
সৌরভ গাঙ্গুলী (ভারত) | ১১ | ৪৬৫ | ১১২* | ৫৮.১২ | ৩/০ |
রিকি পন্টিং (অস্ট্রেলিয়া) | ১১ | ৪১৫ | ১৪০* | ৫১.৮৭ | ২/১ |
অ্যাডাম গিলক্রিস্ট (অস্ট্রেলিয়া) | ১০ | ৪০৮ | ৯৯ | ৪০.৮০ | ০/৪ |
হার্শেল গিবস (দ. আফ্রিকা) | ৬ | ৩৮৪ | ১৪৩ | ৯৬.০০ | ১/২ |
সবচেয়ে বেশি উইকেট:
খেলোয়াড় (দেশ) | ম্যাচ | উইকেট | সেরা | গড় | ইকোনমি রেট |
চামিন্ডা ভাস (শ্রীলঙ্কা) | ১০ | ২৩ | ৬/২৫ | ১৪.৩৯ | ৩.৭৬ |
ব্রেট লি (অস্ট্রেলিয়া) | ১০ | ২২ | ৫/৪২ | ১৭.৯০ | ৪.৭৩ |
গ্লেন ম্যাকগ্রা (অস্ট্রেলিয়া) | ১১ | ২১ | ৭/১৫ | ১৪.৭৬ | ৩.৫৬ |
জহির খান (ভারত) | ১১ | ১৮ | ৪/৪২ | ২০.৭৭ | ৪.২৩ |
শেন বন্ড (নিউজিল্যান্ড) | ৮ | ১৭ | ৬/২৩ | ১৭.৯৪ | ৩.৯১ |