বছর চারেক বিরতিতে আরেকটি ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলে এসেছে প্রায়। অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডে একাদশ বিশ্বকাপের খেলা মাঠে গড়ানোর আগে ফিরে দেখা যাক আগের ১০ আসর। এর মধ্যে ১৯৮৭ সালের উপমহাদেশে প্রথম বিশ্বকাপ অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায় ক্রিকেটকে।
Published : 04 Feb 2015, 01:54 PM
২০১১: বাংলাদেশেও বিশ্বকাপ, শিরোপা ভারতের
২০০৭: অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক শিরোপা, বাংলাদেশের সেরা সাফল্য
২০০৩: অস্ট্রেলিয়ার টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা
১৯৯৯: অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক বিশ্বকাপের জয়ের সূচনা
১৯৯৬: শ্রীলঙ্কার আভিজাত্যে উত্তরণের কাহিনী
১৯৯২: পাকিস্তানের ক্রিকেটীয়-রূপকথা
১৯৮৩: অঘটনের তৃতীয় বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন ভারত
প্রথম তিন বিশ্বকাপের আসরই বসেছিল ইংল্যান্ডে। সেই একক অধিকার থেকে তাদের মুঠি আলগা হয়ে যায় ১৯৮৭ সালে। ঐতিহ্যে এগিয়ে, অবকাঠামোয় অন্য সবার চেয়ে আধুনিক এবং গ্রীষ্মের দীর্ঘ দিনে ৬০ ওভার ম্যাচ আয়োজনের উপযুক্ততা- এসব যুক্তিতেই তো শুরুর তিন টুর্নামেন্ট হয়েছিল ইংল্যান্ডে। আইসিসির অন্য দেশগুলোর চাপের মুখে ওসব যুক্তি আর ধোপে টেকেনি। ভারত ও পাকিস্তানকে তাই যৌথভাবে দেওয়া হয় বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব।
প্রথম তিন বিশ্বকাপের কোনোটিতেই অভিন্ন আট দেশ খেলেনি। চতুর্থ বিশ্বকাপে এসে প্রথমবারের মতো খেলল তৃতীয় টুর্নামেন্টের দলগুলোই- পূর্ণ সদস্য সাত দেশের সঙ্গে আইসিসি ট্রফি জয়ী জিম্বাবুয়ে। ভারত-পাকিস্তান যৌথ আয়োজক হলেও ফরম্যাটে পরিবর্তন আসেনি। বড় পরিবর্তন এসেছিল অন্য জায়গায়। উপমহাদেশে যেহেতু ইংল্যান্ডের গ্রীষ্মের মতো দেরি করে সন্ধ্যা নামে না, সে কারণে ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনা হয় ৫০ ওভারে। আর এই প্রথমবারের মতো ম্যাচ পরিচালনায় ব্যবহার করা হয় নিরপেক্ষ আম্পায়ার। কালের প্রবাহে এই পরিবর্তন দুটি এখন নিয়মে পরিণত।
এছাড়া স্বাগতিকের মতো বদলে যায় টুর্নামেন্টের আনুষ্ঠানিক নামও। প্রথম তিন আসরে স্পন্সরের নামানুসারে সেটি পরিচিত ছিল ‘প্রুডেনশিয়াল কাপ’ নামে। ১৯৮৭ সালে স্পন্সর বদলে হল রিলায়েন্স, টুর্নামেন্টেরও নাম বদলে ‘রিলায়েন্স কাপ’। আর প্রথম তিনবার যেমন বিশ্বকাপ হয়েছিল জুন মাসে, এবার বদলে যায় সেটিও। উপমহাদেশের ক্রিকেটীয় আবহাওয়ার অক্টোবর-নভেম্বরে হয় বিশ্বকাপ।
এত সব পরিবর্তনের ভিড়ে আরেকটি পরিবর্তন ছিল লক্ষ্যণীয়। এই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেট ঘিরে তৈরী হয় প্রবল উন্মাদনা। আগের বিশ্বকাপে ভারতের চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা এখানে কাজ করেছে জাদুর মতো। দুই প্রবল প্রতিপক্ষ ভারত-পাকিস্তানের স্বপ্নের ফাইনালের স্বপ্নও দেখছিলেন সমর্থকরা। বিশ্বকাপের উত্তেজনার পারদ ওপরের দিকে ওঠায় সেটিও রেখেছিল বড় ভূমিকা।
মাঠের ক্রিকেট শুরুর আগে ফেভারিটের তকমাটা ছিল ওই ভারত-পাকিস্তানের ওপরই। প্রথম তিন আসরের ফাইনালিস্ট ওয়েস্ট ইন্ডিজের সম্ভাবনা বাতিল করে দেওয়ার উপায় ছিল না। ক্লাইভ লয়েড অবসরে যাওয়া এবং চোটের কারণে গর্ডন গ্রিনিজ আর ম্যালকম মার্শালের খেলতে না পারা সত্ত্বেও। গোনার মধ্যে ছিল ইংল্যান্ডও। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াকে সত্যিকার অর্থে গোনায় ধরেননি খুব বেশি জন। আগের দুই বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বে বিদায় নেওয়া অসিদের স্কোয়াড সেবারও তেমন শক্তিশালী না। এক ঝাঁক নতুন ক্রিকেটার নিয়েই উপমহাদেশে আসে অস্ট্রেলিয়া। কে জানত, তাদের হাতেই শেষ পর্যন্ত উঠবে ট্রফি! ১৯৮৩ বিশ্বকোপের ভারত-রূপকথার মতো না হলেও অ্যালান বোর্ডারের দলের শিরোপা জয়টা অবাক করা নিঃসন্দেহে।
গ্রুপ পর্বে ভারত-পাকিস্তান ছিল আলাদা গ্রুপে, তাদের ম্যাচগুলোও নিজ নিজ দেশে। পাকিস্তান উদ্বোধনী ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারায় কোনোমতে, মাত্র ১৫ রানের ব্যবধানে। ওদিকে ‘এ’ গ্রুপে ভারত নিজেদের প্রথম খেলায় হেরেই বসে অস্ট্রেলিয়ার কাছে। এক উইকেটের রুদ্ধশ্বাস জয় দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করে অসিরা। শুরুর ওই হোঁচট সামলে টুর্নামেন্টে প্রবল প্রতাপেই কিন্তু ফেরে ভারত। জেতে টানা পাঁচ ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র হার আবার ভারতের বিপক্ষে ফিরতি ম্যাচেই। তাতে এই দুই দলের পয়েন্ট হয়ে যায় সমান। নেট রান রেটে এগিয়ে থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমি-ফাইনালে যায় ভারত।
ভারতের গ্রুপ পর্বের ছয় ম্যাচের মধ্যে প্রথমটি স্মরণীয় হয়ে আছে রুদ্ধশ্বাস প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য। আর শেষটির কথা ইতিহাস মনে রেখেছে দুটি পারফরম্যান্সের সৌজন্যে। নাগপুরে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই খেলার বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক করেন চেতন শর্মা। আর টেস্ট ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কার করেন তার প্রথম ও একমাত্র ওয়ানডে শতক। ১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ৬০ ওভার খেলে ৩৬ রানে অপরাজিত থাকার দায়মোচন হয়তো অবশেষে হল তাতে!
‘বি’ গ্রুপে আরেক স্বাগতিক পাকিস্তানের পথচলাও ভারতের মতো। ছয় ম্যাচের মধ্যে পাঁচটি জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই সেমি-ফাইনালে যায় ইমরান খানের দল। পার্থক্য বলতে, ভারত হেরেছিল নিজেদের প্রথম ম্যাচ, পাকিস্তান শেষ ম্যাচ। ধ্রুপদী ম্যাচের মর্যাদা পেয়েছে এই গ্রুপের একটি ম্যাচ, যেখানে পাকিস্তান এক উইকেটে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের ওই খেলায় অবশ্য জয়-পরাজয় ছাপিয়ে উজ্জ্বল কোর্টনি ওয়ালসের ক্রীড়াসুলভ মনোভাব। ম্যাচের শেষ বলে দুই রানের প্রয়োজনীয়তার সামনে পাকিস্তান। এই বলটি করতে এসে ওয়ালশ দেখলেন, স্বাগতিকদের নন-স্ট্রাইক ব্যাটসম্যান সেলিম জাফর ক্রিজের বাইরে। চাইলে তাকে রান আউট করতে পারতেন তিনি; তাতে এক রানে খেলাটি জিতত ক্যারিবিয়ানরা। তবে নন-স্ট্রাইকারকে এভাবে আউট করা নিয়মসিদ্ধ হলেও ক্রিকেটের ক্রীড়াসুলভ মনোভাব দেখিয়ে ওয়ালশ জাফরকে আউট না করে সতর্ক করলেন কেবল। এরপর আবদুল কাদির শেষ বলে প্রয়োজনীয় রান নেওয়ায় ঠিকই ম্যাচ জেতে পাকিস্তান। হারলেও মাথা উঁচু করে মাঠ ছাড়েন ওয়ালশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল।
তবে বিশ্বকাপ থেকে দুই বারের চ্যাম্পিয়নদের বিদায়টা মাথা উঁচু করে হয়নি। প্রথম তিন বিশ্বকাপের ফাইনালিস্টরা এবার যে শেষ চারেই উঠতে পারেনি! পাকিস্তানের কাছে ওই এক উইকেটের হার ছাড়াও ইংল্যান্ডের কাছে দুটি ম্যাচ তারা হারে ২ উইকেট ও ৩৪ রানে। শ্রীলঙ্কাকে দুই ম্যাচে হারিয়ে এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচ জিতেও শেষরক্ষা হয়নি ক্যারিবিয়ানদের। পাকিস্তান (২০ পয়েন্ট) ও ইংল্যান্ডের (১৬ পয়েন্ট) পেছনেই থাকতে হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে (১২ পয়েন্ট)। ক্যালিপসো সুর এবার থেমে যায় গ্রুপ পর্বেই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ১২৫ বলে ১৮১ রানের অবিস্মরণীয় ইনিংস খেলা ‘কিং’ রিচার্ডসের তাই আর করা হল না ১৯৮৩ সালের প্রায়শ্চিত্ত।
তখন ক্যারিবিয়ানদের দুঃখে দুখী হওয়ার সময় কোথায় স্বাগতিক দর্শকদের! নিজেদের দেশ সেমি-ফাইনালে উঠেছে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে, নিজ নিজ ম্যাচ জিতলে ফাইনালের মহামঞ্চে হবে দেখা- এই রোমাঞ্চে বুঁদ তারা। কিন্তু সেই প্রত্যাশায় কুঠারাঘাতটা হল বড্ড নির্মম। ৪ নভেম্বর লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে পাকিস্তানকে ১৮ রানে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। এর ২৪ ঘন্টা পর তখনকার বোম্বের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভারতকে ৩৫ রানে হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করে ইংল্যান্ড। ৮ নভেম্বর ইডেন গার্ডেনসের নন্দনকাননে তাই ভারত-পাকিস্তান নয়, বিশ্বকাপ ট্রফির লড়াইয়ে নামে ভিন্ন দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী।
প্রথম তিন আসরের স্বাগতিক তারা, মাঝেরবার ফাইনালে উঠলেও ট্রফিতে হাত ছোঁয়া হয়নি কখনও- ট্রফি জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের মরিয়া থাকাটাই স্বাভাবিক। অন্য দিকে বিশ্বকাপ তখনো জেতা হয়নি অস্ট্রেলিয়ারও। প্রথমবার ফাইনাল খেলার পরের দুই আসরে বাদ তো প্রথম রাউন্ডেই। নতুনের ঝাণ্ডা ওড়ানো অসিরা তাই ট্রফিটা জিততে চাইছিল যে কোনো ভাবে। আগে ব্যাটিং করে পাঁচ উইকেটে ২৫৩ রান তোলে তারা। টুর্নামেন্টজুড়ে দারুণ ফর্মে থাকা ডেভিড বুনের ৭৫ রানে যে ইনিংসের ভিত্তি। আর শেষ দিকে মাইক ভেলেটার ৩১ বলে অপরাজিত ৪৫ রানে আড়াইশ’ পার হয় তারা।
তবে ওই রান ইডেনের উইকেটে নিরাপদ ছিল না মোটেও। বিল অ্যাথি (৫৮) আর মাইক গ্যাটিং (৪১) মিলে জয়ের বন্দরের দিকেই নিয়ে যাচ্ছিলেন ইংল্যান্ডকে। কিন্তু অধিনায়ক মাইক গ্যাটিংয়ের এক মুহূর্তের পাগলামি শেষ করে দেয় প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা। দুই উইকেটে ১৩৫ রান- এমন সময় বোর্ডারকে অহেতুক রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ক্যাচ দেন তিনি। যে মুহূর্তটি বিবেচিত ১৯৮৩-র ফাইনালে কপিল দেবের নেওয়া ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচের মতোই টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে। গ্যাটিংয়ের আউটে ধাক্কা খাওয়া ইংল্যান্ড ঠিকই ম্যাচটি হেরে যায় ৭ রানে। আর ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথম শিরোপার স্বাদ পায় সবচেয়ে সফল দল অস্ট্রেলিয়া।
সবচেয়ে বেশি রান:
খেলোয়াড় | দেশ | ম্যাচ | রান | সেরা | গড় |
|
গ্রাহাম গুচ | ইংল্যান্ড | ৮ | ৪৭১ | ১১৫ | ৫৮.৮৭ |
|
ডেভিড বুন | অস্ট্রেলিয়া | ৮ | ৪৪৭ | ৯৩ | ৫৫.৮৭ |
|
জিওফ মার্শ | অস্ট্রেলিয়া | ৮ | ৪২৮ | ১২৬* | ৬১.১৪ |
|
ভিভ রিচার্ডস | ও.ইন্ডিজ | ৬ | ৩৯১ | ১৮১ | ৬৫.১৬ |
|
মাইক গ্যাটিং | ইংল্যান্ড | ৮ | ৩৫৪ | ৬০ | ৫০.৫৭ |
|
সবচেয়ে বেশি উইকেট:
খেলোয়াড় | দেশ | ম্যাচ | উইকেট | সেরা | গড় | ইকোনমি |
ক্রেগ ম্যাকডারমট | অস্ট্রেলিয়া | ৮ | ১৮ | ৫/৪৪ | ১৮.৯৪ | ৪.৬৭ |
ইমরান খান | পাকিস্তান | ৭ | ১৭ | ৪/৩৭ | ১৩.০৫ | ৪.৪৫ |
প্যাট্রিক প্যাটারসন | ও.ইন্ডিজ | ৬ | ১৪ | ৩/৩১ | ১৮.০৭ | ৪.৫১ |
মনিন্দর সিং | ভারত | ৭ | ১৪ | ৩/২১ | ২০.০০ | ৪.০০ |
এডি হেমিংস | ইংল্যান্ড | ৬ | ১৩ | ৪/৫২ | ২১.০৭ | ৪.৬০ |