ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে লোয়ার অর্ডারের দারুণ ব্যাটিংয়ে ফাইনালে পৌঁছে গেল এক যুগ পর বিপিএলে ফেরা চিটাগং কিংস, জয়ের দুয়ার থেকে হেরে গেল খুলনার টাইগার্স।
Published : 05 Feb 2025, 10:40 PM
শেষ ওভারের প্রথম বলটি যখন বাউন্ডারিতে পাঠালেন চিটাগংয়ের আরাফাত সানি, ডাগআউটে তখন হতাশায় দুহাত মাথায় রেখে নিচু হয়ে গেলেন খুলনার কোচ তালহা জোবায়ের। সম্ভাব্য পরিণতি কী তখনই অনুমান করছিলেন তিনি! পরের কয়েক ডেলিভারিতে নাটক কম হলো না। উত্তেজনা চূড়ান্তে পৌঁছে গেল শেষ বলে। অসাধারণ শটে বাউন্ডারি মেরে স্মরণীয় এক জয়ে চিটাগংকে ফাইনালে পৌঁছে দিলেন আলিস আল ইসলাম।
রুদ্ধশ্বাস দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে শেষ বলের ফয়সালায় খুলনা টাইগার্সকে ২ উইকেটে হারাল চিটাগং কিংস। ২০১৩ আসরের ফাইনালে খেলা ফ্র্যাঞ্চাইজি এক যুগ পর বিপিএলে ফিরেই আবার পা রাখল শিরোপার মঞ্চে।
মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে বুধবার খুলনা ২০ ওভারে তোলে ১৬৩ রান। একসময় এই স্কোরকে মনে হচ্ছিল তাদের নাগালের বাইরে। কিন্তু শেষ চার ওভারে তাণ্ডব চালিয়ে ৭১ রান তোলে তারা।
চিটাগংয়ের রান তাড়ায় ম্যাচে নাটকীয়তা ছড়াল বিস্তর। এক পর্যায়ে তারা ছিল সহজ জয়ের পথে। ৮ ওভারে যখন তাদের প্রয়োজন কেবল ৫৯ রান, উইকেট বাকি তখনও ৮টি। সেখান থেকে পথ হারিয়ে ১৭ ওভার শেষে তাদের রান হয়ে ৭ উইকেটে ১৩০।
জয়ের জন্য শেষ তিন ওভারে চিটাগংয়ের প্রয়োজন ছিল ৩৪ রানের। বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান বা অলরাউন্ডার অবশিষ্ট ছিল না একজনও। কিন্তু দলের প্রয়োজনে দুই স্পিনার আরাফাত সানি ও আলিস আল ইসলাম হয়ে উঠলেন পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান। স্নায়ুর চাপকে হারিয়ে খুলনার আশা মাড়িয়ে চিটাগংকে জয়ের পথে এগিয়ে নিলেন দুজন। এবারের বিপিএলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে দুজনেরই বোলিং অ্যাকশন। কিন্তু এ দিন তাদের ব্যাটিং ছিল নিখাদ!
দুজনের লড়াইয়ের পরও অবশ্য শেষ ওভার শুরুর সময় ফেভারিট ছিল খুলনা। জেসন হোল্ডারের এক ওভার বাকি থাকলেও শেষ ওভারে তরুণ পেসার মুশফিক হাসানের হাতে বল তুলে দেন অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ। ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৫ রানের।
প্রথম বলে দারুণ শটে সানির চারের পর দ্বিতীয় বলে আসে দুটি রান। তৃতীয় বলে আসে সিঙ্গল। ওই রান নিতে গিয়েই পড়ে গিয়ে পায়ে চোট পান আলিস। কিছুক্ষণ চিকিৎসা নেওয়ার পর মাঠ ছেড়ে যান তিনি। নতুন ব্যাটসম্যান শরিফুল ইসলামকে ইয়র্কার করার চেষ্টা করেন মুশফিক। ব্যাটের কানায় লেগে ফাইন লেগ দিয়ে বল চলে যায় বাউন্ডারিতে।
নাটকের শেষ নয় তখনই। ওভারের পঞ্চম বলে স্লোয়ার ডেলিভারিতে আউট হয়ে যান শরিফুল। এক বলে তখন লাগে চার রান।
একটু আগেই মাঠ ছেড়ে যাওয়া আলিস আবার ফেরেন ক্রিজে। শেষ বলটি মুশফিক করেন স্টাম্পের বেশ বাইরে। ফাঁকা কাভার দিয়ে বল সীমানায় পাঠিয়ে বাঁধনহারা উল্লাসে মেতে ওঠেন দুই ব্যাটসম্যান। খ্যাপাটে উদযাপনে ব্যাট ছুড়ে দেন আকাশে। গোটা দলই মেতে ওঠে অভাবনীয় প্রাপ্তির উচ্ছ্বাসে।
শুরুতে টালমাটাল খুলনা
টস জিতে বোলিং নেওয়া চিটাগং কিংসের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। খুলনার ইনিংস এগোতে থাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। প্রথম চার ওভারে মোহাম্মদ নাঈম শেখের ব্যাট থেকে আসে চারটি বাউন্ডারি। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে আসরে পাঁচশ রান পেরিয়ে যান তিনি। কিন্তু আরেক পাশে দাঁড়াতে পারেননি কেউ।
বিনুরা ফার্নান্দোকে স্লগ করতে গিয়ে মেহেদী হাসান মিরাজ বোল্ড হন দুই রানে। আলিস আল ইসলামের বলে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে ফিরতি ক্যাচ দেন অ্যালেক্স রস (৬ বলে ০)।
আশা হয়ে থাকা নাঈমও ১৯ রান (২২ বলে) করে বোল্ড হয়ে যান সৈয়দ খালেদ আহমেদের বলে। ধুঁকতে থাকা আফিফ হোসেনও ফেরার পথ ধরেই দ্রুতই (১৪ বলে ৮)।
১০ ওভারে খুলনার রান দাঁড়ায় ৪ উইকেটে ৪৬।
লড়াইয়ের শুরু
এবারের বিপিএলে খুলনার হয়ে মূলত ফিনিশারের দায়িত্ব পালন করলেও এ দিন তাকে ভিন্ন দায়িত্বে পাঁচে পাঠানো হয়। দলকে টেনে তোলার অভিযানে নামেন তিনি শিমরন হেটমায়ারকে নিয়ে।
প্রথম পাল্টা আক্রমণের ছাপ রাখেন দুজন একাদশ ওভারে। শরিফুল ইসলামের বলে হেটমায়ারের বাউন্ডারির পর মাহিদুলের ব্যাট থেকে আসে চার ও ছক্কা। দুই ওভার পর শামীম হোসেনকেও ছক্কা ওড়ান মাহিদুল।
তবে দু-একটি শটের ফাঁকে তখনও পর্যন্ত সাবধানী ব্যাটিংই করছিলেন তারা।
একাদশ থেকে ষোড়শ- এই ছয় ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে রান ওঠে ৪৬।
শেষের তাণ্ডব
গোটা ইনিংসের চিত্র পাল্টে যায় শেষ চার ওভারে। এই সময়ে রান আসে ৭১!
খালেদের ওভারে মাহিদুলের ছক্কার পর জোড়া ছক্কা মারেন হেটমায়ার। পরের ওভারেই শরিফুলের বলে শেষ হয় মাহিদুলের ইনিংস (৩২ বলে ৪১)। জুটি থামে ৫০ বলে ৭৩ রানে।
তবে ওই ওভারেই হেটমায়ার মারেন দুটি বাউন্ডারি। পরের ওভারে দুটি চার দুটি ছক্কায় বিনুরা ফার্নান্দোকে বিধ্বস্ত করেন হেটমায়ার।
১৬ ওভার শেষে তার রান ছিল ২১ বলে ২২। পরের ১১ বলে ক্যারিবিয়ান এই ব্যাটসম্যান করেন ৪১ রান!
ওই ওভারের শেষ বলে আরেকটি ছক্কার চেষ্টায় তিনি আউট হয়ে যান।
ফার্নান্দোর প্রথম তিন ওভারে রান ছিল স্রেফ ছয়। শেষ ওভার থেকে আসে ২১ রান।
শেষ ওভারে শরিফুলের বলে মোহামমদ নাওয়াজের বাউন্ডারি ও জেসন হোল্ডারের চার ও ছক্কায় রান আসে ১৭।
ইনিংস শেষে ডাগ আউটে খুলনার কোচ তালহা জোবায়ের, সাপোর্ট স্টাফ ও ক্রিকেটারদের উল্লাস ছিল দেখার মতো। মোমেন্টাম তখন তাদের সঙ্গী
নাফের ‘নো লুক’ ছক্কা ও হাসানের জোড়া ছোবল
চিটাগংয়ের রান তাড়ার শুরুটা ছিল রোমাঞ্চ জাগানিয়া। হাসান মাহমুদ ও জেসন হোল্ডারের বলে ‘নো লুক’ মটে ছক্কা মারেন খাওয়াজা নাফে। তিনি শটের দিকে তাকাননি, কিন্তু শট দুটি দেখতে ছিল মোহনীয়।
এই দুই শটের ফাঁকেই হাসানের বলে পুল খেলে সহজ ক্যাচ দিয়ে ফেরেন পারভেজ হোসেন ইমন (৬ বলে ৪)। হাসানই পরে দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে উড়িয়ে দেন গ্রাহাম ক্লার্কের (৪) বেলস।
নাফের দারুণ কিছু শটের সৌজন্যে তবু পাওয়ার প্লেতে ৪৬ রান তোলে চিটাগং।
দুর্দান্ত জুটি
পাওয়ার প্লে শেষেও দুই দল ছিল প্রায় সমতায়। কিন্তু খাওয়াজা নাফে ও হুসাইন তালাতের জুটিতে তা অনেকটাই হলে চিটাগংয়ের দিকে। দারুণ ব্যাটিংয়ে ৪৮ বলে ৭০ রান যোগ করেন দুজন।
খুব একটা ঝুঁকি না নিয়েই নিয়মিত বাউন্ডারি আদায় করতে থাকেন দুজন। স্বদেশি বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ নাওয়াজের ওভারে দুজন মিলে রান নেন ১৭।
মিরাজের বলে ছক্কায় নাফের ফিফটি আসে ৩৬ বলে। দলের রান একশ পেরিয়ে যায় দ্বাদশ ওভারে।
নাটকীয় ধস
চিটাগংয়ের জয় যখন মনে হচ্ছিল স্রেফ সময়ের ব্যাপার, তখনই ভিন্ন স্রোতের দোলা। নাসুম আহমেদের শর্ট বলে সীমানায় ধরা পড়ে বিদায় নেন হুসাইন তালাত (২৫ বলে ৪০)।
তখনও পর্যন্ত চিটাগংয়ের বিপদ আঁচ করা যায়নি। তবে নাসুমের পরের ওভারে যখন শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ দিয়ে আউট হন ফর্মে থাকা শামীম হোসেন(৫), পালাবদলের হাওয়া টের পাওয়া যায় তখনই।
সে হাওয়ায় এরপর উড়ে যায় চিটাগংয়ের ব্যাটিং। তাদের মূল ভরসা হয়ে থাকা নাফে (৪৬ বলে ৫৭) বোল্ড হন মুশফিক হাসানের স্লোয়ারে স্কুপ খেলার চেষ্টায়। ওই ওভারে বিদায় নেন খালেদও।
একটু পর হাসানের বলে অধিনায়ক মোহাম্মদ মিঠুনের বিদায়ে শেষ হয়ে যায় চিটাগংয়ের শেষ আশাও।
১২ ওভার শেষে যে দলের রান ছিল ২ উইকেটে ১০৫, সেই দলের রান ১৭ ওভার শেষে হয়ে যায় ৭ উইকেটে ১৩০!
শেষের উত্তেজনা
শেষ তিন ওভারে যখন প্রয়োজন ৩৪ রান, খুলনার জয়কে তখন কেবল আনুষ্ঠানিকতাই মনে হচ্ছিল। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এই সমীকরণে ম্যাচ জয়ের নজির আছে অনেক। কিন্তু চিটাগংয়ের যে ব্যাটসম্যানই ছিল না!
কিন্তু সানি ও আলিস দেখালেন, তারাও ব্যাটসম্যান!
অষ্টাদশ ওভারে হোল্ডারকে টানা দুই বলে চার ও ছক্কায় চমকে দেন আলিস। ওভার থেকে আসে ১৩ রান। পরের ওভারে দারুণ বোলিংয়ে মাত্র ৬ রান দেন হাসান।
এরপর সেই শেষ ওভারের নাটকে চিটাগংয়ের জয়। সানি ও আলিসকে ঘিরে যখন তুমুল উল্লাস চলছে চিটাগংয়ের গোটা দলের, ক্রিজে তখন হতাশায় হাঁটু মুড়ে বসে রইলেন বোলার মুশফিক। খুলনার অন্যরাও ঠায় দাঁড়িয়ে মূর্তির মতো।
শুক্রবারের ফাইনালে চিটাগং কিংসের প্রতিপক্ষ টানা দ্বিতীয় ট্রফির আশায় থাকা ফরচুন বরিশাল।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
খুলনা টাইগার্স : ২০ ওভারে ১৬৩/৬ (মিরাজ ২, নাঈম ১৯, রস ০, আফিফ ৮, মাহিদুল ৪১, হেটমায়ার ৬৩, হোল্ডার ১২*, নাওয়াজ ৫*; ফার্নান্দো ৪-১-২৭-১, শরিফুল ৪-০-৫১-১, আলিস ৪-০-১৪-১, খালেদ ৩-০-২৯-১, শামীম ২-০-১৩-০, সানি ২-০-১০-১, তালাত ১-০-৯-০)।
চিটাগং কিংস: ২০ ওভারে ১৬৪/৮ (নাফে ৫৭, পারভেজ ৪, ক্লার্ক ৪, তালাত ৪০, শামীম ৫, মিঠুন ৭, খালেদ ০, সানি ১৮*, আলিস ১৭*, শরিফুল ৪; হোল্ডার ৩-০-২৩-০, হাসান ৪-০-৩৪-৩, নাসুম ৪-০-২১-২, মিরাজ ৪-০-২৭-০, নাওয়াজ ২-০-২৩-০, মুশফিক ৩-০-৩২-৩)।
ফল: চিটাগং কিংস ২ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: আলিস আল ইসলাম।