৭ উইকেট হাতে নিয়ে ১৮ বলে ২২ রান দরকার ছিল খুলনা টাইগার্সের, এই ম্যাচটিও জিততে পারেনি তারা, অভাবনীয় জয়ে ছুটছে রংপুর রাইডার্সের জয়রথ।
Published : 13 Jan 2025, 11:51 PM
খুলনার ডাগআউটে বসে খুনসুটি করছিলেন আর হাসছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। দলের অন্যদেরকেও দেখা গেল বেশ খোশমেজাজে। ১৮ বলে তখন প্রয়োজন ২২ রান। উইকেট বাকি তিনটি। এমন ফুরফুরে আবহই তো থাকবে! একটু পরে সেই মিরাজকে দেখা গেল প্রচণ্ড ক্ষোভে মাঠে বোতল ছুড়ে মারতে। কোচ তালহা জোবায়ের ক্ষিপ্ত হয়ে কাউকে বলছেন কিছু। কারণ, ম্যাচটি তখন তারা হেরে যাওয়ার পথে!
হ্যাঁ, এই ম্যাচটিও অবিশ্বাস্যভাবে হেরে গেছে খুলনা টাইগার্স। আর হ্যাঁ, আরও একবার, আরও একভাবে প্রতিপক্ষের মুঠে থেকে বের করে নিয়ে অভাবনীয় জয়ের আনন্দে ভেসেছে রংপুর রাইডার্স।
বিপিএলের সিলেট পর্বের শেষ ম্যাচটি পৌঁছে গেল রোমাঞ্চ-উত্তেজনার চূড়ায়। ঘুরে দাঁড়ানোর আরেকটি নজির মেলে ধরে ৮ রানের জয়ে রংপুর রাইডার্স ধরে রাখল তাদের অপ্রতিরোধ্য যাত্রা।
সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে সোমবার রংপুর ২০ ওভারে তেলে ১৮৬ রান। প্রথম ১০ ওভারে রান তুলতে ধুঁকতে থাকা দলকে বড় স্কোরে নিয়ে যায় খুশদিল শাহর ৩৫ বলে ৭৩ রানের ইনিংস।
রান তাড়ায় জয়ের পথে থাকা খুলনা শেষ পর্যন্ত আটকে যায় ১৭৮ রানে।
আগের ম্যাচে ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে যখন শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ২৬ রানের, রংপুরের অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহান ৩০ রান নিয়ে রূপকথার মতো এক জয় এনে দেন দলকে। এরপর এবারের এই রুদ্ধশ্বাস জয়
রংপুরের এটা সাত ম্যাচে সাত জন। দুই জয়ে আসর শুরু করা খুলনা হেরে গেল টানা তিন ম্যাচে।
শেষের নাটক
সপ্তদশ ওভারে আকিফ জাভেদের ওভারে যখন তিনটি বাউন্ডারি মারেন মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন, ম্যাচের ফয়সালা তখনই হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছিল। তিন ওভারে সাত উইকেট নিয়ে স্রেফ ২২ রান লাগত খুলনার। আফিফ হোসেন ও মাহিদুল তখন দারুণ ছন্দে।
অষ্টাদশ ওভারের প্রথম বলে শেখ মেহেদি হাসানকে রিভার্স সুইপের চেষ্টায় আউট হলেন আফিফ (১৫ বলে ২৯)। ওই ওভারে এলো মাত্র চার রান।
পরের ওভারের দ্বিতীয় আকিফকে স্লগ করার চেষ্টায় বোল্ড হলেন মাহিদুল। অভিজ্ঞ ইমরুল কায়েস গিয়ে ওভারের পঞ্চম বলে পুল করে চার মারার পর শেষ বলে ক্যাচ তুলে দিলেন মিড অফে।
ওভার থেকে এলো ছয় রান, উইকেটের পতন দুটি।
শেষ ওভারে খুলনার প্রয়োজন পড়ে ১২ রানের। মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিনের ওভারের প্রথম বলটি ফুল টস পেয়ে ব্যাটে লাগাতে পারলেন না মোহাম্মদ নাওয়াজ। পরের বল ফিল্ডার সোজা মেরে আবার পারলেন না রান নিতে। এরপর সাইফ করলেন ওয়াইড।
পরের বলে দুই রান নেওয়ার চেষ্টায় নাওয়াজ রান আউট সীমানা থেকে সাইফ হাসানের সরাসরি অসাধারণ থ্রোয়ে। চতুর্থ বলে রান আউট নাসুম আহমেদ। পঞ্চম বলে ফুল টসে লং অন সীমানায় ধরা আবু হায়দার।
১২ রানের মধ্যে পতন খুলনার ৬ উইকেটের। হারের দুয়ার থেকে জয় রংপুরের।
মিরাজের পরিকল্পিত প্রতিআক্রমণ
খুলনার রান তাড়ায় ওপেনার দারভিশ রাসুলি আউট হন ১৫ বলে ১৭ করে। বড় রান তাড়ায় যে দম প্রয়োজন, দলকে সেই হাওয়ার জোগান দেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তিনে নেমে চোখধাঁধানো পাল্টা আক্রমণ চালান খুলনা অধিনায়ক, নিশ্চিতভাবেই যা ছিল পরিকল্পিত।
রেজাউর রহমান রাজাকে দুটি চার মেরে তার শুরু। তবে মূল চমক উপহার দেন পরে ওভারে। নাহিদ রানার টানা তিন বলে ছক্কা-চার-ছক্কা, রংপুরের গতি তারকাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পণ করে নেমেছিলেন যেন মিরাজ।
মিরাজের সঙ্গে মোহাম্মদ নাঈম শেখের ৬৩ রানের জুটি খুলনাকে এগিয়ে দেয় রান তাড়ার পথে।
তৃতীয় সুযোগে মিরাজের বিদায়
৩২ রানে খুশদিল শাহর বলে শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ দেন মিরাজ। সহজ সেই ক্যাচ নিতে পারেননি আকিফ জাভেদ। দুই রান পর ইফতিখারের বলে আবার ফাইন লেগেই ক্যাচ দেন তিনি। এবার বল মুঠোয় জমাতে ব্যর্থ হয় নাহিদ রানা।
মিরাজ তবু টিকতে পারেননি বেশিক্ষণ। মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিনের বলে সেই শর্ট ফাইন লেগেই আকিফের হাতে ধরা পড়েন খুলনা অধিনায়ক (২৪ বলে ৩৯)।
নাঈমের ফিফটি
মিরাজের বিদায়ের পর নাঈম, আফিফরা দলকে রাখেন পথেই। আসরে নিজের প্রথম ফিফটিতে ৪১ বলে ৫৮ রান করেন নাঈম। আফিফও আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিংয়ে ছুটতে থাকেন।
শেখ মেহেদিকে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে শেষ হয় নাঈমের ইনিংস। এরপর আফিফ ও মাহিদুল দলকে এগিয়ে নেন জয়ের খুব।
এরপরই তাদের শেষের সেই দুঃস্বপ্ন।
আগুন-পানির শুরু
ম্যাচের শুরুতে রংপুর ব্যাটিংয়ে নামে টস জিতে। দারুণ পারফর্ম করে ফিরে গেছেন অ্যালেক্স হেলস। তার জায়গায় স্টিভেন টেইলরকে একাদশে ফেরায় রংপুর। তার সঙ্গে ইনিংস শুরু করেন তৌফিক খান তুষার। ম্যাচের শুরুতে ছিল ঝড়ের আভাস, তবে দমকা হাওয়া দিয়েই থেমে যায় তা।
প্রথম ওভারে দুটি চার মারেন দুই ওপেনার। পরের ওভারে নাসুম আহমেদকে ছক্কায় স্বাগত জানান টেইলর। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই ওপেনার বোল্ড হয়ে যান ৮ বরে ১৩ রান করে।
তিনে নেমে সাইফ হাসান ১১ বলে৭ করে বোল্ড হন হাসান মাহমুদের বলে।
তৌফিকের ইনিংস ছিল ভালো-মন্দের মিশেল। চারটি চার ও একটি ছক্কা আসে তার ব্যাট থেকে। তবে বের করতে পারেননি সিঙ্গল-ডাবলস।
১০ ওভারে কেবল ২ উইকেট হারালেও রংপুরের স্কোর ছিল মাত্র ৬৮। পরের ওভারেই আউট হয়ে যান তৌফিক (৩০ বলে ৩৬)।
এক জুটির গল্প
রংপুরের ব্যাটিং লাইন আপে সবচেয়ে ধারাবাহিক পারফরমার ইফতিখার আহমেদ ও খুশদিল শাহ। সেই ধারা এই ম্যাচেও ধরে রাখেন দুজন। নড়বড়ে অবস্থা থেকে দলকে এগিয়ে নেন দুই পাকিস্তানির শতরানের জুটি।
সেখানে মূল অবদান অবশ্য খুশদিলের। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যান উপহার দেন বিধ্বংসী ইনিংস। তাকে সঙ্গ দেন ইফতিখার।
শুরুতে অবশ্য একটু সময় নেন খুশদিলও। ১৪ ওভার শেষে তার রান ছিল ১২ বলে ১১। ততক্ষণে ৩০ রান হয়ে গেছে ইফতিখারের। পঞ্চদশ ওভার থেকে ভোজবাজির মতো বদলে যায় চিত্র। নাসুমের টানা চার বল মাঠের বাইরে আছড়ে ফেলেন খুশদিল।
তার ধুন্দুমার ব্যাটিং চলতে থাকে। ১০ বলে ৩৯ রান নিয়ে ফিফটি করে ফেলেন ২২ বলেই। ইনিংসের শেষ ওভারে তার ব্যাটের দাপটে ছক্কা-চার হজম করেন হাসান মাহমুদ।
৩৬ বলে ৪৩ রান করে ইফতিখার আউট হন শেষের আগের বলে। চলতি আসরে তার চতুর্থ চল্লিশ ছোঁয়া ইনিংস এটি, তবে কোনোটিই এগোতে পারেনি ফিফটি পর্যন্ত।
জুটি থামে ৫৭ বলে ১১৫ রানে। অপরাজিত রয়ে যান ইফতিখার।
শেষ ১০ ওভারে ১১৮ রান তোলে রংপুর।
শেষের সেই প্রতিটি রান পরে হয়ে ওঠে মহামূল্য। নিজেদের রাঙায় তারা আরেকটি দারুণ জয়ে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
রংপুর রাইডার্স : ২০ ওভারে ১৮৬/৫ (তৌফিক ৩৬, টেইলর ১৩, সাইফ ৭, ইফতিখার ৪৩, খুশদিল ৭৩*, সোহান ১; আবু হায়দার ৪-০-৩৭-২, নাসুম ৪-০-৪৩-০, নাওয়াজ ৩-০-১৭-০, হাসান ৪-০-৩৮-২, ইরশাদ ৪-০-৪০-০, মিরাজ ১-০-৯-০)।
খুলনা টাইগার্স : ২০ ওভারে ১৭৮/৯ (রাসুলি ১৭, নাঈম ৫৮, মিরাজ ৩৯, আফিফ ২৯, মাহিদুল ১৫, নাওয়াজ ৪, ইমরুল ৪, আবু হায়দার ০, নাসুম ০, হাসান ০* ইরশাদ ১,; শেখ মেহেদি ৪-০-২৭-২, সাইফ ৩-০-২৮-২, আকিফ ৪-০-২৯-৩, রেজাউর ২-০-২৪-০, নাহিদ ৩-০-৩৭-০, খুশদিল ২-০-১৮-০, ইফতিখার ২-০-১৪-০)।
ফল: রংপুর রাইডার্স ৮ রানে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: আকিফ জাভেদ।