সিএনজিতে ভোলার গ্যাস, পর্যালোচনার পরই সিদ্ধান্ত

গ্যাস আনার খরচ গ্রাহকরাই বহন করবেন- এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত এমনই বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা।

ফয়সাল আতিকজ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 March 2023, 08:08 PM
Updated : 10 March 2023, 08:08 PM

বিচ্ছিন্ন দ্বীপ জেলা ভোলার গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে পাওয়া চাহিদার অতিরিক্ত গ্যাস দেশের অন্য স্থানের গ্রাহকদের কাছে সিএনজি আকারে বিতরণের বিষয়ে ‘মাঠের কাজ’ সেরেছে কারিগরি কমিটি; এখন অপেক্ষা নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তের।

তবে কয়েক মাস বন্ধের পর খোলা বাজারের এলএনজি আবার আসতে শুরু করায় পাইপলাইনে বেড়েছে সরবরাহ। শিল্পাঞ্চলে সংকটও কিছুটা কমে এসেছে।

এতে ভোলা থেকে সিলিন্ডারে আনা গ্যাসে শিল্প উদ্যোক্তাদের আগ্রহ আগের মত থাকবে কি না, তা নিয়েও আছে প্রশ্ন।

এমন প্রেক্ষাপটে ভোলার গ্যাস সিএনজিতে রূপান্তরের করণীয় বিষয়ক কারিগরি কমিটির সুপারিশ পর্যালোচনার জন্য এখন রয়েছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে।

সেখানে পর্যালোচনা শেষে প্রস্তাবটি যাবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। কবে, কোথায় এই গ্যাস ব্যবহার হবে- সেই সিদ্ধান্ত সরকারপ্রধানের দপ্তর থেকেই আসবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

জ্বালানি সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোলার গ্যাস সম্পর্কে বক্তব্য হচ্ছে, সেখান থেকে সিএনজি আকারে গ্যাস আনার প্রস্তুতি চলছে। তবে কবে নাগাদ আনা শুরু হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।”

দাম কমায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি আমদানি আবার শুরু হওয়ায় দেশে গ্যাসের সংকট অনেকটাই কেটে গেছে বলেও তার ভাষ্য।

গ্যাসের জাতীয় সঞ্চালন পাইপে যুক্ত নয় ভোলা। সাম্প্রতিকসময়ে সেখানে গ্যাসের একাধিক নতুন কূপ আবিষ্কার হওয়া এবং বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার পর দেশে সংকট দেখা দিলে এই গ্যাস মূল ভূখন্ডে ব্যবহারের বিষয়ে আলোচনা ওঠে।

প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী গত অক্টোবরে ঢাকায় ব্যবসায়ীদের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “চলমান গ্যাস সংকট নিরসনে ভোলার অতিরিক্ত গ্যাস সিএনজি আকারে এনে শিল্প গ্রাহকদের চাহিদা পূরণের চেষ্টা চলছে।”

গত জানুয়ারিতে ঢাকায় জেলা প্রশাসক সম্মেলন শেষে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, “ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই ভোলা থেকে গ্যাস আনার কাজ শুরু করা হবে। সিএনজি আকারে নৌপথে এই গ্যাস পরিবহন করে গ্রাহকদের দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।”

এ প্রক্রিয়ার সবশেষ অগ্রগতির বিষয়ে গত সপ্তাহে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) কামরুজ্জামান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে ইন্ট্রাকো সিএনজি নামের একটি কোম্পানি ভোলা থেকে গ্যাস সিএনজিতে রূপান্তর করে গাজীপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের শিল্পগ্রাহকদেরকে সরাসরি দেবে।” 

কিসের ভিত্তিতে ইন্ট্রাকো কাজটি পেয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আরও কিছু কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। এর মধ্যে ইন্ট্রাকোর প্রস্তুতি ভালো বলে আমাদের মনে হয়েছে। এতে সফল হলে পর্যায়ক্রমে অন্যদের দিয়েও সিএনজি আকারে গ্যাস আনার কাজটি করানো হবে বলেই আলোচনা হয়েছে।”

ইন্ট্রাকো সিএনজির কোম্পানি সচিব সালাউদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ভোলা থেকে গ্যাস সিএনজিতে রূপান্তর করে পেট্রোবাংলার পরামর্শ অনুযায়ী গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণের প্রস্তাব করেছিলাম। তবে এ বিষয়ে এখনও সরকারের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি।

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কর্তৃপক্ষ আরপিজিসিএল এর একজন কর্মকর্তা জানান, ক্রমান্বয়ে চাহিদার আলোকে ভোলা থেকে দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সিএনজিতে রূপান্তর করে সরবরাহ করা সম্ভব।

আগ্রহ কমল কেন

ভোলার গ্যাস সিএনজি আকারে এনে শিল্পে ব্যবহারের আলোচনা শুরুর সময় তা পেতে সরব ছিলেন আগ্রহী অনেক উদ্যোক্তা। তবে সঞ্চালন লাইনে সরবরাহ বাড়ার পর সেই আগ্রহে ভাটা পড়েছে বলে জানিয়েছেন তিতাসের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।

গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিটির ময়মনসিংহ অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা উপ মহাব্যবস্থাপক সত্যজিৎ ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্যাস সংকটে থাকা ৪৮ জন গ্রাহককে সিএনজি নিয়ে আগ্রহ আছে কি না জানতে চেয়েছিলাম। তাদের মধ্যে প্রায় ২০ জন লিখিত আকারে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এর বাইরেও কেউ কেউ মৌখিকভাবে আগ্রহের কথা জানিয়েছে।

"তবে এখন এসব অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ফলে আগের সেই আগ্রহ থাকবে কি না সন্দেহ আছে।”

Also Read: ভোলায় একটি গ্যাস কূপে খনন শুরু, আরও দুটি করবে গ্যাজপ্রম

Also Read: ভোলায় গ্যাস খুঁজতে বাপেক্সের সঙ্গে যুক্ত হল গ্যাজপ্রম

কোনো কারণে জাতীয় লাইনের গ্যাস সরবরাহ যদি কমে যায়, তাহলে আবারও এসব অঞ্চলে ভোলার গ্যাসের চাহিদা তৈরি হবে মনে করছেন এ কর্মকর্তা।

সিএনজিতে আনতে দাম হবে কত?

দেশে সরবরাহ সংকটের মধ্যে ভোলায় আরেকটি নতুন কূপে গ্যাসের সন্ধান মিলেছে বলে গত ২৩ জানুয়ারি জানায় বাপেক্স। এ কূপের বড় মজুদ থেকে দৈনিক দুই কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে বলে আশা গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানিটির।

এমন খবরের মধ্যে দ্বীপ জেলাটিতে পাওয়া গ্যাস সিএনজি আকারে মূল ভূখন্ডে আনা নিয়ে আলোচনা জোরালো হয়।

ভোলায় এখন পর্যন্ত নয়টি কূপ থেকে দিনে গ্যাস মিলছে ১২০ কোটি ঘনফুট। সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ দৈনিক চাহিদা ৮৬ কোটি ঘনফুট। উদ্বৃত্ত গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ৩৪ কোটি ঘনফুট।

এই গ্যাস সিএনজি করলে দাম কেমন হবে- এ প্রশ্নে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) কামরুজ্জামান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, “বর্তমানে গ্রাহক ৪৩ টাকা করে সিএনজি কিনছে। পরিবহন খরচ মিলিয়ে তাদের ৫০ টাকার মত খরচ হয়ে যায়। সেই ক্ষেত্রে ভোলার গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর মাঝামাঝি কোনো একটা খরচ ঠিক করা হবে।”

ভোলা থেকে গ্যাস আনার খরচ গ্রাহকরাই বহন করবে জানিয়ে তিনি বলেন, “পেট্রোবাংলা গ্যাসের দাম বাবদ সামান্য টাকা নেবে। এখানে আলাদা শ্রেণি করা হবে। তারপর একটা দাম ঠিক করে দেওয়া হবে। এখানে সরকারের কোনো খরচ নেই।”

গ্যাস সিএনজিতে রূপান্তরের কাজটি যারা করবে সেই কোম্পানিই বিক্রির জন্য গ্রাহক নির্বাচনের সুযোগ পাবে বলে জানান তিনি।

এলএনজি আমদানিতে পাইপলাইনে বেড়েছে সরবরাহ

২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক ২ হাজার ৪০০ মিলিয়ন থেকে ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হচ্ছিল। এ সময়কালে চাহিদা ছিল ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মধ্যে।

এর মধ্যে এলএনজি থেকে আসছিল ৩৭০ মিলিয়ন থেকে ৪২০ মিলিয়ন ঘনফুটের আশেপাশে। তবে ফেব্রুয়ারিতে স্পট মার্কেটের এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার পর গ্যাসের সরবরাহ বেড়ে দৈনিক প্রায় তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়।

পেট্রোবাংলার হিসাবে, গত ৫ মার্চ দুটি ভাসমান টার্মিনাল থেকে ৭৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি জাতীয় সঞ্চালন লাইনে যুক্ত হয়েছে। এদিন মোট গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৮০ মিলিয়ন ঘনফুট।

সরকারি সংস্থাটির চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার মনে করেন, দিনে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে দিতে পারলে আগামী শুকনো মৌসুমে তেমন একটা সংকট থাকবে না।

Also Read: ভোলায় আরও এক কূপে গ্যাস, দৈনিক মিলবে ২ কোটি ঘনফুট

Also Read: টবগী-১ কূপে ২৩৯ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ

স্পট মার্কেটে প্রতি ইউনিট ৬ থেকে ৮ ডলারের এলএনজির দাম বেড়ে ৩৮ ডলারে উন্নীত হলে প্রথমে সরকার কেনা কমিয়ে দেয়। পরে ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ডলার সাশ্রয়ে তা কেনা বন্ধ রাখা হয়।

এতে গত জুন থেকে দেশে গ্যাসের সরবরাহ কমে যায়। গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিঘ্নিত হয়, শিল্প কারখানাও প্রায় অচল হয়ে পড়ে।

খোলা বাজারে এলএনজির সেই দাম এক পর্যায়ে ৮০ ডলারও ছাড়িয়ে যায়। কয়েক মাস পর দাম এখন ২০ ডলারের নিচে।

গ্যাস সংকট তীব্র হলে উদ্যোক্তারা দাম বাড়িয়ে হলেও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের দাবি তোলেন। এরপর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে জ্বালানির দাম বাড়ানোর অংশ হিসেবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

পরে পাইপলাইন ছাড়া বিদ্যুৎ ও শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আবার এলএনজি আমদানি শুরু হয়।

বর্তমানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম আগের ৫ টাকা ০২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করা হয়েছে।

ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আগে দাম ছিল ১৬ টাকা, বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা, মাঝারি শিল্পে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে দাম আগে ছিল ১০ টাকা ৭৮ পয়সা। সব খাতেই এখন গুনতে হবে ৩০ টাকা।