মূল্যস্ফীতি কমানোসহ বাজার পর্যবেক্ষণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সুফল আসবে-বলেন তিনি।
Published : 10 Mar 2024, 06:37 PM
দেশের বেসরকারি খাতের জন্য আগামী বাজেট উৎসাহব্যঞ্জক হবে বলে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
আগামী জুনে নিজের প্রথম বাজেট উপস্থাপনের আগে রোববার ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বসেন অর্থমন্ত্রী। প্রাকবাজেট এ সভায় ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন দাবি ও পরামর্শ শোনার পর তাদের আশ্বাসের কথা শোনান তিনি।
তিনি বলেন, বেসরকারি খাত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আগামী বাজেটে এ খাত থেকে পাওয়া সুপারিশ ও মতামতকে ‘অত্যন্ত গুরুত্বের’ সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।
ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ‘প্রাক-বাজেট আলোচনা: প্রেক্ষিত বেসরকারিখাত’ শীর্ষক সভায় মাহমুদ আলী বলেন, বেসরকারি খাতের উন্নয়নে আয়কর, মূসক ও শুল্ক সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কর ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয় করা হচ্ছে, ব্যবসা সহজীকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ঋণের সুদহার যৌক্তিক করা হচ্ছে। এর বাইরেও ব্যবসায়ীদের জন্য নানাবিধ প্রণোদনা প্রকল্প রয়েছে। এসব পদক্ষেপ আরও কীভাবে ব্যবসাবান্ধব করা হবে সেজন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে এখনও কিছু কাঠামোগত সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে সময় প্রয়োজন। এবারের বাজেটে সেই বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার পাশাপাশি বাজার পর্যবেক্ষণে ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শিগগির এ বিষয়ে সুফল আসবে। এছাড়াও আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রয়োজনীয় নীতি সংস্কার, দীর্ঘমেয়াদী কৌশল নির্ধারণ, মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন, আমদানি বিকল্প শিল্পখাতের বিকাশ, পণ্যের বহুমুখীকরণ, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন এবং আভ্যন্তরীণ সম্পদের সুষম ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়গুলো আগামী বাজেটে প্রধান্য পাবে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিধারা অব্যাহত রাখতে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে করজাল সম্প্রসারণ এবং কর ব্যবস্থাপনার সহজীকরণ করা প্রয়োজন।
তিনি মূসক আইনে সব উপকরণ ব্যয়ের জন্য রেয়াত সুবিধা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আয়কর আইন-২০২৩ এও কিছু বিষয়ে অব্যাহতি দেওয়ার তাগিদ দেন।
খেলাপি ঋণ কমানো, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, রিজার্ভের ঘাটতি কমানো, ঋণ প্রবাহ বাড়ানেআ ও তারল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি বলে মত প্রকাশ করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
সেই সঙ্গে তিনি শিল্প খাতে সাশ্রয়ী ও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন।
ঢাকা চেম্বার সভাপতি বলেন, শিল্প-বাণিজ্যের প্রসারে উৎপাদন ও রপ্তানি আয় বাড়াতে পণ্য, সেবা ও বাজার বহুমুখীকরণ, রপ্তানিমুখী খাতসহ বিশেষ করে কৃষি, চামড়া, অটোমোবাইল, হালকা প্রকৌশল, ওষুধ, আইসিটি এবং অন্যান্য উদীয়মান খাতের সম্ভাবনা বাস্তবায়নে জাতীয় বাজেটে বিশেষ সুবিধা দেওয়া দরকার। শিল্পখাতে কমপ্লায়েন্স, সম্ভাবনাময় পণ্য ও বাজার সম্পর্কিত গবেষণা এবং উদ্ভাবনী কার্যক্রমে নীতি ও প্রণোদনা সহায়তা চালু করা দরকার।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকার কথা তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী না করলে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে। একজন ব্যবসায়ী একটি ব্যাংক থেকে ১২০০ কোটি টাকা নিয়ে গেছেন। ঋণ ছাড়ের আগে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের জানার কথা থাকলেও ব্যাংক জানে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি জানার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
“সরকারি নীতি পরিবর্তনের কারণে যারা খেলাপি হয়ে গেছে তাদের বিষয়ে আপনারা কোনো সুযোগ চালু করতে চাইলে করেন। কিন্তু যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে টাকা বিদেশি নিয়ে গেল তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে আমি অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চাই।“
এসব খেলাপি ও পাচারকারীদের নাম সরকারিভাবে জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি তোলেন চলতি সংসদে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত এই ব্যবসায়ী নেতা। বলেন, “তাদের ওপর একটা সামাজিক চাপ তৈরি হবে। মানুষ তাদের বয়কট করবে। বাধ্য হয়ে তারা টাকাগুলো দিয়ে দেবে।“
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের কথা স্মরণ করে আজাদ বলেন, “নতুন কোনো নীতির পরামর্শ দিলে মুহিত সাহেব চিন্তা করতেন, রেভিনিউর ক্ষতি হলেও কর্মসংস্থান কতটা বাড়বে। আমার বিশ্বাস মুহিত সাহেব অর্থনীতিকে যেখানে রেখে গেছেন তার থেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সেজন্য গুড গভার্নেন্স নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করতে হবে।“
জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনোযোগ আকর্ষণে দীর্ঘমেয়াদী নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও রাজস্ব কাঠামোর সংস্কার ও সহজীকরণ এবং শিল্প খাতে সাশ্রয়ীমূল্যে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, সরকারকে কর প্রদান প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও কর ভার লাঘবের মধ্যে সমন্বয় করতে হয় এবং ইতোমধ্যে কর প্রদানের প্রক্রিয়া সহজীকরণের জন্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি জানান, ২০২০ সালে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতার সংখ্যা যেখানে ছিল ২১ লাখ সেখানে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা ৩৭ লাখে উন্নীত হয়েছে। ২০২০ সালে বিআইএনধারী সংখ্যা ছিল ২ লাখ। চলতি বছরের মার্চের শেষ নাগাদ তা ৫ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। কর আহরণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে সহযোগিতা প্রদানই এনবিআরের মূল লক্ষ্য।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ কর্মসংস্থান বাড়াতে উদ্যোক্তাদের বিকাশে সর্বাত্মক নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে বেসরকারি খাতের আওতায় অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি চালু করার আইনি কাঠামা প্রণয়নের কাজ করছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনয়ন এবং খেলাপি ঋণ কমানোর মত বিষয়গুলোতে অধিক জোর দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানের উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অনেকটা বাধ্য হয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কিছুটা বাড়িয়েছে। বেসরকারি খাত যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য ‘এসএমএআরটি’ পদ্ধতিতে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), আর্থিক খাত, শিল্প ও বাণিজ্য এবং অবকাঠামো-এ চার অধিবেশনের নির্ধারিত আলোচনায় ইউনিলিভার বাংলাদেশের হেড অব ট্যাক্সেশন সাঈদ আহমেদ খান, শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আরিফ খান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আফতাব-উল ইসলাম, বিকেএমইর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহামুদ, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম মাশরুর রিয়াজ, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলী জওহর রিজভী, কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিমসহ সরকারি কর্মকর্তারা নির্ধারিত আলোচনা অংশ নেন।