“দুই বছর পাড়ি দিতে পারলেই নতুন বিনিয়োগ পাওয়া যাবে, বিনিয়োগ থেকেই গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ করতে হবে,” বলছেন দীর্ঘদিন পর জামিনে বেরিয়ে আসা রাসেল।
Published : 25 Dec 2023, 12:40 AM
লোভনীয় অফার আর চটকদার বিজ্ঞাপনে যে ই-কমার্স কোম্পানি একসময় অভাবনীয় সাড়া ফেলেছিল, সেই ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা সিইও মোহাম্মদ রাসেল কারামুক্ত হওয়ার পর কোম্পানিটির দায়দেনা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
ই-কমার্স খাতের আলোচিত এ উদ্যোক্তা এখন বলছেন, ব্যবসায় আগের আগ্রাসী বিপণন থেকে তিনি সরে আসতে চাইছেন। বিশাল মূল্যছাড়ের কৌশল এড়িয়ে ক্যাশ অন ডেলিভারি (পণ্য হাতে পেয়ে মূল্য) পদ্ধতিতে সামনে এগোতে চান তিনি।
তবে সেই মূল্য যাতে বাজারের যেকোনো প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির চেয়ে কম হয় সেদিকেও নজর রাখার কথা বলছেন রাসেল।
এক গ্রাহকের করা মামলায় ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। এরপর তাদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়; নেওয়া হয়েছিল রিমান্ডেও।
ইভ্যালির পুনর্গঠন হিসাব-নিকাশের সুবিধার্থে তার স্ত্রী শামীমাকে এক বছরের মাথায় শর্ত সাপেক্ষে জামিন দিয়েছিল আদালত। আর রাসেল মুক্তি পান গত ১৯ ডিসেম্বর।
গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ও পরেএই দম্পতির বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতি ও অন্যান্য প্রতারণার দায়ে দেশে সাড়ে ৩০০ এর অধিক মামলা হয়েছিল। এসব মামলার মধ্যে বেশ কয়েকটিতে রাসেলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
কারামুক্তির পর সম্প্রতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর সঙ্গে ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন রাসেল। গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীদের দীর্ঘদিনের পাওনা কীভাবে পরিশোধ করবেন, এমন প্রশ্ন রাখা হয় তার কাছে।
জবাবে রাসেল বলেন, দুই বছর নির্বিঘ্নে পরিকল্পনা মাফিক ব্যবসা করতে পারলে ইভ্যালি দায় পরিশোধের পর্যায়ে পৌঁছাবে। সেক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগ পাওয়ার একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এবং সেই বিনিয়োগ থেকে ব্যবসা সম্প্রসারণের পাশাপাশি দায়দেনাগুলোও পরিশোধ করা যাবে।
কারা-কিভাবে পাওনা বুঝে পাবেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আপাতত এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না। জেল থেকে বের হওয়ার পর বিষয়গুলো নিয়ে এখনও চিন্তাভাবনার পর্যায়ে রয়েছি।”
রাসেলের ভাষ্য অনুযায়ী, বন্ধ হওয়ার আগে রমরমা পরিস্থিতিতে ইভ্যালির ইউনিক কাস্টমার ছিল ৪২ লাখ। এখন আদালতের নির্দেশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, ই-ক্যাবের প্রতিনিধি ও রাসেলের পরিবারের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত পর্ষদের অধীনে যে ইভ্যালি যাত্রা করেছে, সেখানে ইউনিক গ্রাহকের সংখ্যা ২ লাখ ৭৪ হাজারে পৌঁছেছে।
বর্তমানে ১২০ জন লোকবল নিয়ে চলছে ইভ্যালি। তাতে মাসে ৪০ লাখ টাকা খরচ গুনেও মাস ছয়েক ধরে আয়-ব্যয় সমান সমান (‘ব্রেক ইভেনে’) পর্যায়ে রয়েছে কোম্পানিটি।
ইভ্যালির ওয়েবসাইট ও ফেইসবুক পেইজে গিয়ে দেখা যায়, ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, ঘড়ি, ফ্যাশনপণ্য, হোম এপ্লায়েন্সসহ বিভিন্ন পণ্যের মজুদ রয়েছে সেখানে।
রাসেলের মুক্তির পর ইভ্যালির ফেইসবুক পেইজে তার ভক্তদের অভিনন্দন বার্তাই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দায়দেনার হিসাব কই?
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ব্যবসায় নেমে বিশাল ছাড় দেওয়ার চমক দেখাতে গিয়ে আড়াই বছরেই ক্রেতা ও পণ্য সরবরাহকারীদের কাছে ৫৪৩ কোটি টাকার দায়ে পড়ার কথা গ্রেপ্তার হওয়ার আগে রাসেল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিলেন।
তবে সেই হিসাবে আস্থা না পাওয়ার কথা জানিয়ে বিভিন্ন সংস্থার তথ্যের বরাত দিয়ে কোম্পানিটি এক হাজার কোটি টাকারও বেশি দায়দেনায় পড়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তখন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। তবে নানা জটিলতার কারণে এসব বিষয়ে কোনো পক্ষই চূড়ান্ত কোনো তথ্য হাজির করতে পারেনি।
রাসেল গ্রেপ্তার হওয়ার এক মাসের মধ্যে ইভ্যালির প্রধান সার্ভারটিও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দায়দেনার হিসাব আর সামনে এগানো যায়নি। সার্ভারের সিকিউরিটি কোড রাসেলের কাছে থাকলেও কারামুক্তির আগে সেটা কাউকে সরবরাহ করা সম্ভব নয় বলেও তখন তিনি জানিয়েছিলেন।
এখন কারামুক্তির পর দায়দেনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এক হাজার কোটি টাকার দায়দেনার যে তথ্য হাজির করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। সর্বমোট দায় ৭০০ কোটি টাকার কিছু বেশি।
“আমি গ্রেপ্তার হওয়ার পর হোস্টিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনের কাছে ৭ কোটি টাকা দায় পড়েছে। নিয়ম অনুযায়ী তারা সার্ভার স্থগিত করে দিয়েছে। এখন আগামী ২/৩ মাসের মধ্যে সেই সার্ভার আবার সক্রিয় করা যাবে বলে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে মনে হচ্ছে।”
ওই সার্ভারে চালু হলে ৪২ লাখ গ্রাহকের সব লেনদেনের তথ্য পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে জানান রাসেল।
কেমন ছিল কারাবাস?
রাসেলের ২৭ মাস কারাবাসের সময় ইভ্যালি নানা ধাপ ও পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে গেছে। তার কোটি টাকা দামি গাড়িটিসহ ইভ্যালির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
সবচেয়ে কৌতুহল নিয়ে ইভ্যালির অফিসে থাকা লোহার সিন্দুকটি ভাঙার পর সেখানে পাওয়া গেছে মাত্র আড়াই হাজার টাকা।
ছবি: ইভ্যালির সিন্দুক ভেঙে মিলল আড়াই হাজার টাকা
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বে আদালত গঠিত পর্ষদ দীর্ঘদিন প্রচেষ্টা চালিয়ে, সিএ ফার্ম দিয়ে হিসাব কষেও কোনো কূল কিনারা করতে পারেনি। দেউলিয়া কোম্পানিটি বিলুপ্তি ঘোষণার কথাও আলোচনা হয়েছিল।
তখন ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা রাসেল কারাগারে থাকায় এর উদ্ধারকাজ বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
কাশিমপুর কারাগারে কাটানো সময় প্রসঙ্গে রাসেল বলেন, “কারাগার মোটেও স্বস্তির জায়গা নয়। তবে মানসিক শক্তির কারণে শক্তভাবে দিনগুলো অতিক্রম করেছি। যেসব মামলায় আমি গ্রেপ্তার হয়েছি, সেগুলোতে অনেক আগেই জামিন হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কারাগারে যাওয়ার ফলে ব্যবসায়িক পিছিয়ে যাওয়ার কারণে গ্রাহক, সরবরাহকারী এবং অন্যসবপক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
“কারাগার যে কেওয়াজের জায়গা, বিশেষ করে সেখানে যেধরনের বন্দি থাকে, আমি ছিলাম তাদের থেকে আলাদা। একটি ছোট্ট তোয়ালে হলেই আমি সেখানে দিব্বি ঘুমিয়ে যেতে পারতাম।”
নিজের গ্রেপ্তার হওয়ার পেছনে ‘কিছু মানুষের’ ইন্ধন ছিল বলেও দাবি করেন রাসেল। এই মানুষগুলো তার ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ইঙ্গিত দিলেও কারও নাম তিনি বলেননি।
দায় শোধ কীভাবে?
কোম্পানি ও পণ্যসরবরাহকারীদের কাছ থেকে সবচেয়ে কম মূল্যে পণ্য কিনে বাজারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মূল্যে গ্রাহকের হাতে তুলে দেওয়ার কথাই জানালেন রাসেল।
সেক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছ থেকে পণ্য দেওয়ার কথা বলে আগাম টাকা নেওয়ার পথে আর হাঁটবেন না বলেও জানান তিনি।
ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা বলেন, “ক্রেতা ও বিক্রেতাদের কাছে লাভজনক আইডিয়া নিয়ে পৌঁছাতে পারলে ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগবে না। মাসে ৫০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারলে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে হাঁটা যাবে। এতে মাসে তিন কোটি টাকা মুনাফা করার একটা পথ তৈরি হবে।
“আগামী দিনে আমরা আর লোকসান দিয়ে পণ্য বিক্রি করব না। এভাবে দুই বছর পাড়ি দিতে পারলেই নতুন বিনিয়োগ পাওয়া যাবে। বিনিয়োগ থেকেই গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ করতে হবে।”
কারা-কিভাবে পাওনা বুঝে পাবেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আপাতত আমরা পাওনা পরিশোধের বিষয়টি নিয়েই বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। অচিরেই সেটা সবার সামনে তুলে ধরব।”
আরও পড়ুন:
ইভ্যালি: চমক জাগানো উত্থান, পতন গ্রাহক ডুবিয়ে
ইভ্যালির জমা-খরচের ‘কূল-কিনারা পায়নি’ আদালত গঠিত পর্ষদ
জামিনে বেরিয়ে ‘নতুন শুরুর’ কথা বললেন ইভ্যালির শামীমা
ইভ্যালির শেয়ার কিনে পর্ষদে থাকতে চান রাসেলের শ্বশুর-শাশুড়ি
ইভ্যালির সিন্দুক ভেঙে মিলল আড়াই হাজার টাকা
ইভ্যালির প্রধান কার্যালয়ে চুরি: ভবন মালিক কারাগারে