সয়াবিন-চিনি পরিশোধনকারীদের দরেই, নীরব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়

“এ বিষয়ে আমাদের উপর মহল ভালো বলতে পারবেন,” বললেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা শামীমা আকতার।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2022, 03:44 PM
Updated : 20 Nov 2022, 03:44 PM

সরকারের তরফে ঘোষণা না এলেও পরিশোধনকারীরা দাম বাড়িয়ে বাজারে সয়াবিন তেল ও চিনি সরবরাহ শুরু করেছে। অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নীরব।

এ দুই খাতের ব্যবসায়ীদের নতুন দর ঘোষণার পর পরই নতুন দামের তেল ও চিনি হাজির হয়েছে বাজারে। অথচ সরবরাহ সংকটে এক সপ্তাহ ধরে বাজারে এ দুই পণ্য মিলছিলই না।

রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দেখা গেছে, বাজারে তীর, ফ্রেশসহ অন্যান্য ব্র্যান্ডের দুই লিটার সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা হয়েছে ৩৮০ টাকা (এক লিটার ১৯০ টাকা)। একইভাবে ফ্রেশ ব্র্যান্ডের চিনির এক কেজির প্যাকেটের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা হয়েছে ১০৮ টাকা।

ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া, গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়াসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তেল ও চিনির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেন পরিশোধনকারীরা। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত আসার আগেই গত বৃহস্পতিবার থেকে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯০ টাকা এবং চিনির দাম কেজিতে ১৩ টাকা বাড়িয়ে ১০৮ টাকা (প্যাকেট) করার ঘোষণা দেন তারা।

যদিও দুই সপ্তাহ ধরেই মিল থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার বাজারে তেল ও চিনির সংকট দেখা দিয়েছিল। আর সেই ‘সুযোগে’ খুচরা দোকানগুলোতে আগের নির্ধারিত দরের চেয়ে বাড়তি দামে পণ্য দুটি বিক্রি হচ্ছিল।

সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর কথা বৃহস্পতিবার জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনিং অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সচিব নুরুল ইসলাম মোল্লা। তবে রোববার ফোন করা হলে তিনি বলেন, “দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব ট্যারিফ কমিশনে জমা আছে। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত আসবে।”

টিকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়েছি। আমরা ১৫ টাকা করে বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিলাম; সরকারের পক্ষ থেকে ১২ টাকা বাড়ানোর পক্ষে সায় দেওয়া হয়েছে বলে আমাকে জানানো হয়েছে। সেই হিসাবে এখন আমরা নতুন এমআরপি লিখছি।”

বাণিজ্য মন্ত্রী না কি বাণিজ্য সচিব, কে নতুন মূল্য নিশ্চিত করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সেটা আমি জানি না আমার কোম্পানির লোকজন বলেছে ১২ টাকা বাড়ানোর পক্ষে সায় এসেছে। এখানে মন্ত্রণালয় ছাড়াও ট্যারিফ কমিশন কাজ করছে।”

চিনির নতুন মূল্য সম্পর্ক জানতে সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। সাড়া পাওয়া যায়নি বাজারে তেল-চিনির অন্যতম সরবরাহকারী সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহার কাছ থেকেও।

কারওয়ান বাজরের মুদি দোকানি সেকান্দর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তেল চিনির দাম বাড়ানো হলেও খুচরা বিক্রেতাদের লাভের হার কমিয়ে দিয়েছে কোম্পানিগুলো। প্রতিকেজি চিনিতে ২ টাকা লাভ থাকছে।

“এর মধ্যে একটা পলিথিনের ব্যাগ দিতে গেলে চলে যাচ্ছে এক টাকা। আগে আমরা এক কেজি চিনি বিক্রি করে ৪/৫ টাকা লাভ করতাম,” বলেন তিনি।

বোতলজাত তেলের ক্ষেত্রেও খুচরা বিক্রেতাদের লাভ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে বিক্রেতারা জানান। এক লিটারের একটি বোতল বিক্রি করলে ২ টাকা লাভ থাকছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চুপ
মন্ত্রণালয় ঘোষণা না দিলেও ব্যবসায়ীদের নিজ উদ্যোগে দাম বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আবার ব্যবসায়ীরা মূল্য বাড়ানোর যে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, তান নিয়েও কোনো সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয় থেকে আসছে না।

তেল, চিনির মূল্য নির্ধারণ নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য শাখার মধ্যম পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও তাদের মুখ থেকে কিছু বের করা যায়নি।

দাম বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের সায় আছে কি না অথবা ব্যবসায়ীদের বাড়িয়ে দেওয়া মূল্য মেনে নেওয়া হয়েছে কি না, এ বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না‘ উত্তর চাইলেও তারা কিছু বলতে রাজি হননি। 

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য শাখার যুগ্ম নিয়ন্ত্রক শামীমা আকতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে “এ বিষয়ে আমাদের উপর মহল ভালো বলতে পারবেন” বলে হেঁটে চলে যান ।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) দায়িত্বপ্রাপ্ত নুসরাত জাবীন বানুর কক্ষে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তেল-চিনির বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারবেন একমাত্র বাণিজ্যমন্ত্রী মহোদয়।”
গত তিন দিন ধরে ফোন করে এবং রোববার মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ।

Also Read: সয়াবিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়াতে চান মিল মালিকরা

Also Read: ‘কিছু পণ্যের’ দাম প্রতি মাসে বেঁধে দেবে সরকার: বাণিজ্যমন্ত্রী

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইন অনুযায়ী কোম্পানি কিংবা অ্যাসোসিয়েশন তেল চিনির দাম নির্ধারণ করতে পারে না। তারা একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছে কিন্তু সরকার এখনও সিদ্ধান্ত জানায়নি। সুতরাং তেল চিনির আগের দামই এখনও কার্যকর আছে।“

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) মুখপাত্র ভোক্তা কণ্ঠের অবৈতনিক সম্পাদক কাজী আব্দুল হান্নান এবিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অ্যাসোসিয়েশনের আবেদনে ট্যারিফ কমিশন হয়ত নতুন এই মূল্যবৃদ্ধির অনুমোদন দিয়েছে।

“কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে- যেই ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে দাম বাড়ানো হলেও তা সঠিক নয়। আর বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী, সাধারণ ভোক্তাদের এই দামে তেল-চিনি কেনার সামর্থ্য নেই।”