গড়িমসির পর যেসব গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহ করেছিল ইভ্যালি, তার বড় অংশই সংগ্রহ করা হয়েছে বাকিতে।
Published : 05 Sep 2021, 10:42 PM
ফলে ছোট-বড় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে ইভ্যালির দেনা জমেছে ২০৫ কোটি টাকা, যাদের কাছ থেকে পণ্য এনে গ্রাহকদের দিচ্ছে ইভ্যালি।
আর গ্রাহকের ৩১১ কোটি টাকাও আটকা পড়ে আছে এই অনলাইন মার্কেটপ্লেসে।
ইভ্যালির আর্থিক হিসাব নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সন্দেহ হলেও কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল দাবি করছেন, দেনা-পাওয়ার এই হিসাব ব্যবসায় ‘স্বাভাবিক ঘটনা’।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ব্যবসায় নেমে ডিসকাউন্টের চমক দেখাতে গিয়ে আড়াই বছরেই ক্রেতা ও বিক্রেতাদের কাছে ৫৪৩ কোটি টাকার দায়ভার এসেছে ইভ্যালির কাঁধে।
রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমানের দপ্তরে ইভ্যালির পাঠানো চিঠিতে দেখা যায়, গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির মোট চলতি দায় ৫৪৩ কোটি টাকার মধ্যে মার্চেন্ট বা পণ্য সরবরাহকারীরাই পাবেন ২০৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আর গ্রাহকদের পাওনা ৩১১ কোটি টাকা।
ফেইসবুকে শাড়ি, থ্রি পিসসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রি করা পুরান ঢাকার অনিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তিনি, তার ভাই ও তার এক বোন মিলে ইভ্যালির কাছে পণ্য সরবরাহ বাবদ প্রায় ৮৩ লাখ টাকা পাবেন।
তিনি বলেন, গত জুন মাসের শুরুতে এ টাকা পরিশোধের কথা থাকলেও তারা সময় নিতে থাকে। জুলাই মাসে তাদের একাউন্ট ফ্রিজ হওয়ার পর এখন এই টাকা পাওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইভ্যালির ‘লোভনীয়’ অফারের কারণে তাদের স্বাভাবিক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলেন অনিক।
তিনি বলেন, “আগে ফেইসবুকে কাপড় বিক্রি করে আমাদের মাসে গড়ে অন্তত এক লাখ টাকা লাভ থাকত। ইভ্যালি এসে ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে কিছু পণ্য বিক্রি করে দিল। তিন ভাইবোন মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হতে দেখে খুশি হয়ে গেলাম।
“পরের ধাপে মার্চ মাসে প্রায় ৪০ লাখ টাকার পণ্য নিয়ে গেল ইভ্যালি। এপ্রিলে সেই টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও টাকা না দিয়ে উল্টো আরও অর্ডার করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ছোট ছোট গার্মেন্টেসগুলোতে আমরা আরও অর্ডার করতে থাকি। কিছুটা বাকিতে কিছুটা নগদে এসব অর্ডার করতে গিয়ে আমাদের আত্মীয় স্বজন কাছ থেকেও ধার করতে হয়েছিল। এখন সবকিছু হারিয়ে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ওষুধ খাওয়ার টাকাও পাচ্ছি না।”
“তারা (ইভ্যালি) বার বার সময় বাড়াচ্ছে। কোম্পানির নামে যেসব খবর শুনছি তাতে টাকা পাওয়ার আশা কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি কী করা উচিত তাও বুঝছি না,” বলেন এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেওয়া সর্বশেষ চিঠিতে মার্চেন্টদের কাছে এসব পাওনাকে ‘স্বাভাবিক’ উল্লেখ করেছেন ইভ্যালির রাসেল।
তিনি লিখেছেন, যে কোনো ব্যবসায় ক্রেডিট সুবিধা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং তা যুগ যুগ ধরে প্রতিটি ব্যবসার ক্ষেত্রেই বিদ্যমান।
ইভ্যালির সঙ্গে সব সরবরাহকারীর ক্রেডিট সুবিধা সংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে উল্লেখ করে তার ভাষ্য, “যে কোনো সরবরাহকারীর সঙ্গে ব্যবসা বাড়ানোর পাশাপাশি ক্রেডিট সুবিধাও বৃদ্ধি করা হয়।
“অন্যদিকে ইভ্যালি সরাসরি উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকদের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে। এসব সরবরাহকারী গড়ে ন্যূনতম ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে মুনাফা অর্জন করার মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। তাই যে অর্থ বর্তমানে দেনা হিসাবে আছে, তা অতি স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য একটি পরিমাণ।”
‘স্বাভাবিক ব্যবসা ও কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ’ পেলেই গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করা যাবে বলে মন্ত্রণালয়কে জানান ইভ্যালির এমডি।
তবে অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “তাদের আর্থিক হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে। সেজন্যই আমরা দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সব সরকারি দপ্তরে চিঠি দিয়ে খোঁজ খবর নিতে বলেছি। এখন এবিষয়ে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
“গ্রাহকের টাকা সরানো হয়েছে কি না, সেটাও সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। আমরা চাই প্রতিষ্ঠান এবং গ্রাহক সবাই সুরক্ষা পাক।”
এদিকে গণমাধ্যমে কথা না বললেও শনিবার রাতে ইভ্যালির ফেইসবুক পেইজে লাইভে এসে গ্রাহকদের উদ্দেশে এক ঘণ্টা ১৪ মিনিট কথা বলেন রাসেল।
তিনি বলেন, পাওনাদারদের মধ্যে যারা খুবই খারাপ পরিস্থিতিতে রয়েছেন, বিশেষ করে হাসপাতালে বা অন্য কোনো সমস্যায় রয়েছেন, কল সেন্টারের মাধ্যমে পাওয়া ওইসব অভিযোগ লিখে রাখা হচ্ছে।
জটিলতায় পড়ার পরও জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাত লাখ ১৮ হাজার অর্ডার ডেলিভারি করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
অনেক গ্রাহক বাড়ি বন্ধক রেখে ইভ্যালিতে পণ্য কিনতে টাকা জমা দিয়েছেন শুনে রাসেল বলেন, “আমি বুঝতে পারিনি যে, এই ভাবে আপানারা কেনাকাটা করবেন। ইট ইজ নট গুড এট অল।”
ইভ্যালি থেকে পণ্য কিনে আবার খোলা বাজারে বিক্রি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি রিসেলিংটাকে মোটেও খারাপ চোখে দেখি না।”