বিনিময় হার বাজারমুখী করার উদ্যোগে সময়ে সময়ে টাকার বিপরীতে ডলারের দর বাড়িয়ে আসছে বাংলাদেশ। তারপরও হুন্ডির চাপে আসছে না কাঙ্ক্ষিত রেমিটেন্স। বৈশ্বিক নানা কারণে রপ্তানি আয়ও চাপে। ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেনের ভাষায়, পরিস্থিতি ‘কঠিন’।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক শেষে বৈদেশিক মুদ্রা বাজার নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন।
ডলারের দর নিয়ে ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “বৈদেশিক মুদ্রা বাজার পরিস্থিতি, অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি।”
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দর নির্ধারণ করে দিচ্ছে এবিবি এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন-বাফেদা। কিন্তু সেই দর না মেনে কিছু ব্যাংক বেশি দরে বিদেশি মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সর্বশেষ গত ১ নভেম্বর ডলারের দর ক্রয় পর্যায়ে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা এবং বিক্রয় দর সর্বোচ্চ ১১১ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বাফেদা-এবিবি।
সেই দর না মেনে বেশি দরে রেমিটেন্স কিনছে কিছু ব্যাংক এমন অভিযোগ উঠার পর বিনিময় হার নির্ধারণ নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়।
এবিবি-বাফেদার অভিযোগের ভিত্তিতে উপায় বের করতে বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকে ১৬ বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
বৈঠক শেষে এবিবি চোরম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, “আমাদের মিটিংয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। গত ১ তারিখের সিদ্ধান্ত যেন বাস্তবায়ন হয়, এবিবি ও বাফেদা ডলারের যে দর নির্ধারণ করে দিয়েছে, ডলার ক্রয়-বিক্রয়ে সেই দর যেন সার্বিকভাবে মেনে চলতে পারি, সে বিষয়ে গভর্নর কথা বলেছেন।’’
তিনি বলেন, “আগামী সপ্তাহ থেকে আমরা চেষ্টা করব সকলে মিলে যেন এই দর মেনে চলতে পারি।’’
প্রবাসী আয় বাড়াতে রেমিটেন্সের ওপর আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদানা দিয়ে আসছে সরকার। গত ২২ অক্টোবর এবিবি ও বাফেদা সিদ্ধান্ত দেয়, সরকারের পাশাপাশি ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে আরো আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া যাবে।
এ নিয়ে বির্তক উঠলে গত ১ নভেম্বর আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে প্রণোদনার সীমা তুলে দেয় এবিবি-বাফেদা। ওই বৈঠকে রেমিটেন্সে ডলারের দর ১১০ টাকা ৫০ পয়সা ঠিক করা হয়।
এর সঙ্গে সরকার ও ব্যাংকের দেওয়া পাঁচ শতাংশ প্রণোদনা যোগ করলে রেমিটেন্স দর হয় ১১৬ টাকা। কিন্তু কিছু ব্যাংক রেমিটেন্স কিনছে ১২২-১২৩ টাকা দিয়েও, যা বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। সে কারণে দর ফের ১১৬ টাকায় ফিরিয়ে আনতে বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসেন ব্যাংকিং খাতের নেতারা।
সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, “ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে প্রণোদনা দেওয়ার কোনো ঊর্ধ্বসীমা লিখে না দিলেও ব্যাংকগুলো সমঝোতায় পৌঁছেছিল, সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিয়ে রেমিটেন্স আনতে পারবে ব্যাংক।’’
লিখিত নির্দেশনা ও মৌখিক সমঝোতা বিপরীত হওয়া নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “প্রত্যেকটা জিনিস লাইন বাই লাইন লিখে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন কারণ আছে। আমাদের আন্তর্জাতিক ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে কাজ করতে হয়। ’’
তিনি বলেন, “সবকিছু একটা সীমার মধ্যে থাকতে হবে। সীমা তুলে নেওয়ার পরও আমাদের মধ্যে এগ্রিমেন্ট (সমঝোতা) ছিল আড়াই শতাংশের বেশি প্রণোদনা দেব না। কোনো কোনো ব্যাংক তিন বা চার শতাংশ দিচ্ছিল।”
ডলারের দর ১১১ টাকা হলেও আমদানিতে তার চেয়ে বেশি নিচ্ছে কিছু ব্যাংক। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে এবিবি চেয়ারম্যান বলেন, “কোনো ব্যাংক যদি বেশি দরে ডলার ক্রয় করে, তারপরও বার্ধিত দর কোনো অবস্থাতেই গ্রাহকের কাছ থেকে নিতে পারবে না।”
নির্ধারিত দর না মানা ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল সেলিম আরএফ হোসেনের কাছে।
উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা এই দর বাস্তবায়নে সকলের সহযোগিতা চাই। যারা বেশি দরে ডলার কেনা-বেচা করবেন তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখবে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয় তাদের তদারকির মাধ্যমে সেগুলো বের করতে পারবে। কিন্তু তখন পরিস্থিতি ভালো হবে না।’’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, “সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা একমত হয়েছেন এক দরে ডলার কেনাবেচা করতে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে তারা সবাই একমত হয়েছেন।”
তিনি বলেন, “বাড়তি প্রনোদনা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর বাজার অস্থির হয় একেক ব্যাংক একেক দরে কেনাবেচা করায়। এখন সবাই এক দরে কেনার বিষয়ে একমত হয়েছেন।’’
বৈঠক শেষে এবিবি ও বাফেদা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বুধবার রাতে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে ‘সতর্কভাবে’ প্রণোদনা দিতে হবে। অথচ গত ১ নভেম্বরের সিদ্ধান্ত ছিল, প্রণোদনা দিতে কোনো সীমা থাকবে না।