ডলারের মূল্য আগের অবস্থায় থাকলে ভর্তুকি বাবদ খরচ আরও প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা কমত বলে মনে করেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
Published : 15 May 2024, 09:43 AM
আন্তর্জাতিক বাজারে সারের আকাশচুম্বি মূল্য ধীরে ধীরে কমতে থাকায় এ খাতে ভর্তুকির চাপও গত এক বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কমে এসেছে।
অবশ্য চাপ কমলেও চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সার খাতে সরকারকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি গুণতে হচ্ছে, যার বড় কারণ ডলারের বিনিময় হার।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ উইংয়ের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সারে ভর্তুকি দিতে হয়েছিল ৬ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে (২০২০-২০২১) সারের দাম কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় সাত হাজার ৮০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম হুহু করে বাড়তে থাকে। ওই বছর গড়ে প্রতি কেজি ইউরিয়া ৯৬ টাকা, টিএসপি ৭০ টাকা, এমওপি ৫৪ টাকা ও ডিএপি ৯৩ টাকায় কিনতে হয়েছিল।
ফলে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে সারে ভর্তুকি বাবদ সরকারকে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছিল বলে তখন কৃষিমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়। সে বছর ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা।
২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ ২৬ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল। আর ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য ভর্তুকি প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরও সারের দাম আগের কমতির দিকে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সার কিনতে সরকারের ব্যয়ও কমে আসছে।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে প্রায় চার বিলিয়ন ডলার মূল্যের সার আমদানি করতে হয়েছিল। আর চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে একই পরিমাণ সার আমদানি করতে লেগেছে আড়াই বিলিয়ন ডলার।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতিটন ইউরিয়া সার গড়ে ৭৯৪ ডলার, প্রতিটন টিএসপি ১০২২ ডলার, প্রতিটন ডিএপি ১১০৪ ডলার, প্রতিটন এমওপি ৯৫৯ ডলারে কিনতে হয়েছিল।
চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রয়োজনীয় সার কেনা ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। তাতে প্রতিটন ইউরিয়া সারের খরচ গড়ে ৪১৪ ডলার কমে ৩৮০ ডলার, প্রতিটন টিএসপি সারে ৪৮২ ডলার কমে ৫৪০ ডলার, প্রতিটন ডিএপি সারে ৪৭৪ ডলার কমে ৬৩০ ডলার এবং প্রতিটন এমওপিতে ৬০৯ ডলার কমে ৩৫০ ডলার খরচ হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে সার কেনার খরচ কমলেও টাকার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হওয়ায় মূল্যহ্রাসের কিছু সুবিধা বাস্তবে পাওয়া যায়নি। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে সার কেনার ক্ষেত্রে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার গড় বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা, যা ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১০৪ টাকা হয়েছে।
ডলারের মূল্য আগের অবস্থায় থাকলে ভর্তুকি বাবদ খরচ আরও প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা কমত বলে মনে করেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সারে ভর্তুকির ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কোনো চাহিদা থাকে না। সারে ভর্তুকি দেওয়া সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। তাই প্রতিবছর যা খরচ হয়, তাই সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে একটা সম্ভাব্য হিসাব জমা দেওয়া হয়।”
ভর্তুকি ছাড়াও বীজ, সেচসহ বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে কৃষি সচিব জানান, প্রণোদনা বাবদ গত বছর ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। আগামী বাজেটেও বরাদ্দের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকার কথা।
সারের দামও বেড়েছে
তিন বছর আগে সারের বার্ষিক চাহিদা ৫৬ লাখ টন থাকলেও গত অর্থবছরে চাহিদা ছিল প্রায় ৬০ লাখ টন। এর মধ্যে ২৭ লাখ টন ইউরিয়া সার, সাড়ে সাত লাখ টন টিএসপি সার, ১৬ লাখ টন ডিএপি সার এবং ৯ লাখ টন এমওপি সার।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের পক্ষ থেকে মওসুম অনুযায়ী ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি সারের চাহিদা নিরূপণ করা হয়। নির্দিষ্ট এলাকার তালিকাভুক্ত ডিলাররা মাসে মাসে নির্ধারিত চাহিদা অনুযায়ী সরকারি গুদাম থেকে সার সংগ্রহ করেন। নির্দিষ্ট কমিশনে মুনাফা করার পর সরকার নির্ধারিত মূল্যে কৃষকের কাছে সার পৌঁছে দেন ডিলাররা।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার গত দুই বছরে দুই দফায় ইউরিয়া সারের দাম বাড়িয়েছে।
২০২২ সালের অগাস্টে কৃষক প্রতিকেজি ইউরিয়া সার ১৬ টাকা করে কিনতে পারতেন। এই দাম ওই বছর অগাস্টে ৬ টাকা বাড়িয়ে ২২ টাকা এবং ২০২৩ সালের এপ্রিলে আরও ৫ টাকা বাড়িয়ে ২৭ টাকা করা হয়েছে।
একই সময়ে টিএসপির দাম ৫ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি ২৭ টাকা, ডিএপি সারের দাম ৫ টাকা বেড়ে ২১ টাকায় এবং এমওপি সারের দাম ৫ টাকা বেড়ে ২১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি কেজি ইউরিয়ার আমদানি ব্যয় ছিল ৩২ টাকা, টিএসপি ৩৩ টাকা, এমওপি ২৩ টাকা, ডিএপি ৩৭ টাকা।
এ ব্যয়ের ওপর ভর করে সরকারকে বছর শেষে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছিল। পরের ২০২১-২২ অর্থবছরে তা অনেক বেড়ে গেলে সরকারকে বাড়তি ব্যয় করতে হয় ২০ হাজার কোটি টাকার মত; মোট ভর্তুকি বাবদ খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা।
পুরনো খবর