“কোম্পানিগুলো হয়ত আরও লাভ করতে চায়। এটাও একটা কারণ হতে পারে”, মনে করেন ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির নেতা গোলাম মাওলা।
Published : 21 Dec 2024, 11:22 PM
সরকারিভাবে দাম বাড়ানোর পর রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোয় সয়াবিন তেলের সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও তাতে চাহিদা পুরোপুরি মিটছে না; আপত্তি আছে দাম নিয়েও।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মহাখালী ও নিকেতন কাঁচাবাজারের একাধিক ক্রেতার অভিযোগ, কোনো দোকানে এক লিটার সয়াবিন তেলের সংকট; কোনো দোকানে দুই লিটারের।
আবার বোতলের লেবেলে পুরনো দাম লেখা থাকলেও নেওয়া হচ্ছে বাড়তি মূল্য।
খুচরা বিক্রেতাদের ভাষ্য, তারা চাহিদামাফিক তেল পাচ্ছেন না। যে পরিমাণ সরবরাহ আসার কথা তা করা হচ্ছে না। রোজা সামনে রেখে অনেক পাইকার তেল মজুদ শুরু করে দিয়েছেন বলে তারা তথ্য পাচ্ছেন।
বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ আগের অবস্থায় না ফেরার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এস আলম গ্রুপ আমাদের ভোজ্যতেলের বাজারে বড় ধরনের যোগান দিত; তারা বন্ধ।
“সিটি গ্রুপের মাল কিছুটা শর্ট আছে, হয়ত অন দ্য ওয়ে আছে। সেজন্য সরবরাহ সংকটটা হতে পারে।”
মজুদের অভিযোগে দ্বিমত জানিয়ে তিনি বলেন, “মজুদ কত হাজার টন করবে? বোতলজাত তেলের মজুদ করার এত জায়গা কোথায়? এটা কিছু না। আরেকটা কারণ হতে পারে, কোম্পানিগুলো হয়ত আরও লাভ করতে চাচ্ছে। এটাও একটা কারণ হতে পারে।”
টানা কয়েক সপ্তাহ ছোট-বড় সব বাজার থেকে সয়াবিন তেল ‘উধাও হওয়ার’ মধ্যে গত ৯ ডিসেম্বর পণ্যটির দাম লিটারে আট টাকা বাড়ায় সরকার। যুক্তি হিসেবে সামনে আনা হয় আন্তর্জাতিক বাজারে এটির দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাকে।
ঘোষণা অনুযায়ী ৮ টাকা বেড়ে এখন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ঠিক হয়েছে ১৭৫ টাকা। খোলা সয়াবিন তেল ও খোলা পাম তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য হবে ১৫৭ টাকা; পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল পাওয়া যাবে ৮৫২ টাকায়।
দাম বাড়ানোর দিনে (৯ ডিসেম্বর) বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করেছি। আর সমস্যা হবে না।”
ওই দিনের পর থেকে রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোয় বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ বাড়তে থাকে। তবে ‘সমস্যা’ এখনও পুরোপুরি কাটেনি।
শনিবার মহাখালী কাঁচাবাজারে কয়েক দোকান ঘুরে তেল কেনেন হামিদ আকন্দ নামের একজন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাজারে আগে যেরকম তেল ছিল, এখনও সেরকম; স্বাভাবিক হয়নি; সংকট রয়ে গেছে।
“কিছু দোকানে দুই লিটারের তেল আছে, কিন্তু এক লিটারের তেল নেই। কোথাও এক লিটার আছে তো পাঁচ লিটার নেই। কোথাও আবার খোলা তেলে বিক্রি হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি টাকায়।”
নিকেতন কাঁচাবাজারে আসা গৃহিণী সালমা বেগমের ভাষ্যও একই রকম। তিনি বলেন, “বাজারে এখনও আগের মত সয়াবিন তেলের বোতল মিলছে না।
“খোলা তেলেরও দাম সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি। আমি ১৮০ টাকা করে খোলা সয়াবিন তেল কিনেছি।”
এ বাজারে আসা আবদুর রহমান নামের আরেকজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এক লিটার তেলের একটা বোতল নিলাম, দাম রাখল ১৭৫ টাকা। কিন্তু বোতলের গায়ে লেখা ১৬৭ টাকা।
“বিক্রেতাদের যুক্তি, তেল আগের হলেও তারা নতুন দামেই কিনেছেন। সেজন্য বেশি রাখতে হচ্ছে।”
বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে বাংলাদেশ এডিবল ওয়েল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার বলেন, “কীভাবে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, সেটা নিয়ে কয়েকদিন থেকে আমরা কাজ করেছি।”
তিনি বলেন, “এক্স বন্ড, ইন বন্ড ভ্যালু এবং গত এক মাসে যে এলসি খোলা হয়েছে, তার ভ্যালু- এই তিনটা ভ্যালু যোগ ও গড় করে একটা দাম ঠিক করতে হয়। সঙ্গে বিভিন্ন প্রক্রিয়াকরণ খরচ, বোতলজাতকরণ খরচ যোগ হয়। ২০১১ সাল থেকে এই পদ্ধতি চর্চা হয়ে আসছে।”
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, গত জুলাই থেকে অক্টোবরে দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১০৬ টনের মত, যা গেল বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৫৪ হাজার টন বেশি।
গত অক্টোবর থেকে আগের চার মাসে পরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি হয় ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৭৭৬ টনের মত। অপরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি হয় প্রায় চার হাজার টন।
সরবরাহে ঘাটতির কারণ হিসেবে খুচরা বিক্রেতারা ‘দুষছেন’ বড় কোম্পানিগুলোকে।
মহাখালী কাঁচাবাজারের ‘সিলেট স্টোরের’ বিক্রেতা মো. আব্দুল জব্বার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েক সপ্তাহ ধরেই বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট, যা এখনও পুরোপুরি কাটেনি।
“বাজারে ডিলারদের কাছে চাইলেও তারা চাহিদামাফিক তেল দিতে পারে না। সেজন্য আগের মত সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। বড় ব্যবসায়ীরা রোজা সামনে রেখে মজুদ করাতেই এই অবস্থা।”
একই বাজারের ‘লক্ষ্মীপুর স্টোরের’ সত্ত্বাধিকারী আবদুর রশিদ বলেন, “কিছুদিন তো দাম বাড়ল ডলারের সংকট দেখিয়ে। এখন কিসের সংকট?
“অনেক দিন ধরেই তেল পাওয়া যাচ্ছে না। তেল বড় বড় ব্যবসায়ীর দখলে। এজন্যই বাজারে তেল পাওয়া যায় না।”
কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের তেল বিক্রেতা মহিউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরবরাহ বাড়ছে ধীরে-ধীরে। বড় কোম্পানিগুলো হয়ত আরও দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করেছিল, কিন্তু সেটা হবে বলে মনে হচ্ছে না। চাইলেই তো আর বাড়ানো যায় না।
“বোতলজাত তেলের সরবরাহ বাড়লে ঝামেলা থাকে না। খোলা তেল আমাদের কেনাই পড়ে ১৬২ টাকা। বিক্রি করি ১৮০ টাকা করে। সরকারের দামের সঙ্গে হেরফের কিছুটা থাকেই। বোতলজাত তেলের সংকট না থাকলে খোলা বাজার আবার পড়ে যায়।”
আমদানিকারক ও বিপণনকারী টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তসলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা প্রচুর ডেলিভারি দিচ্ছি। কেন সরবরাহ স্বাভাবিক হবে না! আপনারা হয়ত বেশি ‘ফলোআপ’ করছেন, যার জন্য হয়ত বেশি চোখে পড়তেছে।
“সব সময় এরকমই কম আর বেশ থাকে। আসলে তেলের সংকট নাই। আমি রেকর্ড পরিমাণ ডেলিভারি দিচ্ছি। গত এক সপ্তাহে যে হারে ডেলিভারি দিছি, এক বছরেও তা দিই নাই।”
তিনি বলেন, “আমার নরমাল ডেলিভারি ছিল বোতলে ৩০০ থেকে ৪০০ টন, গত কিছুদিন ধরে আমি ৮০০ টন দিচ্ছি; আগামীকাল প্রায় ৯০০ টন দিব। এই মাল যাচ্ছে কোথায় তাহলে?”
দেশের শীর্ষস্থানীয় আরেক ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা প্রতিদিন বাজারে পর্যাপ্ত মাল দিচ্ছি। ৭০০ থেকে ৮০০ টন দিচ্ছি।
“এর মধ্যে টিসিবিতেই প্রতিদিন আমরা ২০০ থেকে ৩০০ টন তেল দিচ্ছি। আমরা প্রতিদিন যে তেল সরবরাহ করছি, সেগুলো কোথায় যাচ্ছে, সেটা আবার সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকেও জানাচ্ছি।”