"এই সময়ে পেঁয়াজের দাম কোনোভাবেই প্রতি কেজি ৪৫ টাকার বেশি হওয়া উচিৎ নয়," কয়েকদিন আগে এমন মন্তব্য করেছিলেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।
Published : 05 Jun 2023, 01:33 AM
ঢাকার মিরপুরের কাজীপাড়ার বাসিন্দা মো. এহসান পেঁয়াজ কিনতে এসে মুদি দোকানি শামীম হোসেনের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতেই জড়িয়ে গেলেন; ক্রেতা বাড়তি দাম নেওয়ার জন্য দুষছেন আর দোকানি দায় দিচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীদের।
রোববার দুপুরে আধা কেজি পেঁয়াজ নিতে এসে দাম শুনেই চমকে যান এহসান। এ নিয়ে এক-দুই কথাতেই বচসা শুরু হয় ক্রেতা-বিক্রেতা দুজনের মধ্যে। এরমধ্যে জোরের সঙ্গেই এহসান বলে উঠলেন, “আপনারা কোরবানি ঈদ আসলেই এসব করেন। পেঁয়াজ সব স্টক করে দাম বাড়ান।”
বিক্রেতা শামীমের সোজাসাপ্টা উত্তর, “আমার অত খবর নেয়ার কি দরকার, এক বস্তা নিছি, যারা বড় ব্যবসায়ী তারা জানে।”
হুট করে চড়তে থাকা পেঁয়াজের দাম নিয়ে এখন প্রায় সব দোকানেই ক্রেতার প্রশ্নের মুখে পড়ছেন বিক্রেতারা। এক থেকে দুই দিনের মধ্যে দামের পার্থক্য অনেক বেড়ে যাওয়া দেখে ক্ষোভ থেকে প্রশ্ন করছেন দোকানিদের। তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে রোববারের পরিস্থিতি ছিল বেলায় বেলায় বেড়েছে পেঁয়াজের দাম।
পাইকারি আড়তে সকালে যে দামে পেঁয়াজ কিনছেন খুচরা বিক্রেতারা, বিকালে একই আড়তে তাদের কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। পেঁয়াজের দাম বাড়তে বাড়তে সেঞ্চুরি ছুঁয়েছে, খুচরা বাজারে কোথাও সেটা রোববার চড়ছে ১১০ টাকা কেজিতেও।
এমন পরিস্থিতিতে এদিন বিকালে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়ার কথা জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়; সোমবার থেকে যা শুরু করা যাবে।
আমদানির অনুমতিতে শেষ বেলায় আড়তে বাজছে ফোন
আমদানির অনুমতির খবরের পরপরই আড়ত ও পাইকারি বাজারে নড়চড় শুরু হয়েছে বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
ঢাকায় পেঁয়াজ সরবরাহকারীদের অনেকেই বড় আড়তগুলোতে যোগাযোগ করে সোমবারই বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিতে বলছেন। তাদের ধারণা, চড়া বাজারে এখন বেচলে যে দাম পাবেন আমদানি হতে শুরু করলে তা আর থাকবে না। এজন্য হাতে থাকা পেঁয়াজ ছাড়তে চান তারা।
অথচ দাম আরও বাড়বে এমন আশায় গত কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে চাষিদের ও হাট-বাজার থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহ করা এসব সরবরাহকারী ঢাকার আড়তগুলোতে পেঁয়াজ পাঠিয়েছেন কম। বেশির ভাগই হাতে পেঁয়াজ রাখতে চেয়েছেন।
এদিন রাতে এসব সরবরাহকারীদের ফোনের জবাবে আড়তদাররা সোমবার পাইকারিতে ক্রেতা কমে যাওয়ার সংশয় প্রকাশ করেন।
ঢাকার মতো চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের আড়তেও এর প্রভাব পড়ার কথা জানিয়েছেন আড়তদাররা।
খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের অন্যতম আড়তদার হামিদুল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, আমদানির অনুমতির কারণে সোমবার বিক্রি কমে যাবে। তবে দাম কমবে ধীরে ধীরে। ভারতের পেঁয়াজ আসা শুরু হলে দাম পড়তে শুরু করবে।
ঢাকার শ্যামবাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মাজেদ বলেন, "দিনভর ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করলাম। দাম বাড়ছে কারণ, দেশের ভেতর যারা ব্যবসা করে, কৃষকরা আজ সর্বোচ্চ চার হাজার টাকা মণও বিক্রি করেছে। এখন আমদানির খবর শুনে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসছে আমাদের মাল বেইচা দেন। কিন্তু কালকেও তো আমরা কাস্টমার পাব না। এ মুহূর্তে মাল নিলে ৭০ টাকা বাজার আছে, কাল ৫০ টাকাও হয়ে যেতে পারে।
“আমাদের দেশের মানুষ এত লোভী। কৃষক থেকে নিয়ে আমরা ব্যবসায়ী সবাই লোভী। অল্পতে পোষায় না।”
তাহলে কি সিন্ডিকেট ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এইটা আমি বললাম না। দেশের থেকে এই মুহূর্তে আমার কাছে অন্তত ১০ জন টেলিফোন করছে, বলতেছে মাল বেইচা দেন। যে পেঁয়াজ ৭০ তা আজ ৮৫ বেচছি। কাল কমবে না তার কি গ্যারান্টি। কেউ কিনবে না। এগুলো আমাদের দেশের কালচার। বাজার এমনি কমে যাবে। আমার ধারণা, ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ ঢুকলেই বাজার ৪০ থেকে ৫০ এ নেমে আসছে।”
মিরপুর ১১ নম্বরের পেঁয়াজের আড়তদার নুরুল হুদা রাতে তখনও পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণা শোনেননি বলে জানান। তবে আমদানি করলে দাম কমবে কি না সে বিষয়ে বলেন, “তা নির্ভর করবে গ্রামের হাটে কৃষকের কাছ থেকে- যেখান থেকে আসে সেখানে কমলে ওইটা তো মার্কেটে ঢুকবে তাহলে কিছুটা কমাই স্বাভাবিক।”
ফরিদপুরের সোনাপুর ও রাজবাড়ির বালিয়াকান্দির দেশি পেঁয়াজের হাট থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহ করে ঢাকায় সরবরাহ করেন বেপারী মতি মিয়া।
তিনি বলেন, “আইজ বস্তা কিনছি ৩৫০০ থেকে ৩৭০০ টাকা মণ (কেজিতে ৮৭ দশমিক ৫ টাকা থেকে ৯২ দশমিক ৫ টাকা)। এরপর সেইটা আমরা ঢাকায় দিছি। এখন আমদানি করলে কই থেকে আমদানি করবে, কে জানে। হাটে তো পেঁয়াজের আমদানি দেখি না। এখন বাইরে থেকে আনলে ঢাকার বাজারে যদি দাম কমে তাইলে পাঁচজনের যা আমারও তাই হবে।”
সকালের দর বিকালে বেড়েছে আরেক দফা
আগে থেকে পেঁয়াজের হঠাৎ বাড়তি দর ঈদের পরে লাফাতে শুরু করে। সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবেই এক মাসের মধ্যে পেঁয়াজের দর ৩০ টাকা থেকে ৮০ টাকায় পৌঁছে। আর গত কিছুদিন থেকে সপ্তাহ কিংবা দিন নয়, বেলার ব্যবধানেই বেড়েছে পেঁয়াজের দাম।
পেঁয়াজের বাজার সহনীয় করতে আমদানির বিকল্প নেই জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিঠি দেওয়ার দুই সপ্তাহ পর দর আরও বেড়ে ১০০ টাকায় পৌঁছে গত দুই দিনে। এরপরই কৃষি মন্ত্রণালয় রোববার বিকালে এক জরুরি বার্তায় সোমবার থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়ার কথা জানায়।
তড়তড়িয়ে দাম বাড়ার কারণ হিসেবে উৎপাদন কম থাকা, পরিবহন খরচ বাড়া, আমদানি বন্ধ থাকাসহ নানান যুক্তি দেখান পেঁয়াজ সরবরাহকারীরা। ক্রেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রীদের তরফ থেকেও অভিযোগ আসে মজুতদারির।
গত ২১ মে রাজধানীতে এক আলোচনায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, “আমাদের দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন পর্যাপ্ত হয়েছে। কিন্তু বেশি মুনাফা লাভের আশায় অনেকে পেঁয়াজ মজুদ রেখে সংকট তৈরি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করা হয়েছে।”
এই সময়ে পেঁয়াজের দাম কোনোভাবেই প্রতিকেজি ৪৫ টাকার বেশি হওয়া উচিৎ নয়, এমন মন্তব্য করে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এধরনের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে মাঠ পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তারা খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করেছেন। ভেতরে ভেতরে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।”
সরকারি হিসাবে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবি এবার উৎপাদন ৩৪ লাখ টনের কাছাকাছি, যা বার্ষিক চাহিদার চেয়ে বেশি।
তবে এসব আলোচনা দাম নিয়ন্ত্রণে প্রভাব রাখতে পারেনি। ক্রেতাদের অভিযোগ, ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারের পেঁয়াজ কম ছেড়ে এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও ঢাকার কয়েকটি বাজারের খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত কয়েকদিনে পেঁয়াজের দাম বেলায়-বেলায় লাফিয়ে বেড়েছে।
“গতকাল (শনিবার) সকাল ৯ টায়ও আমি ৭৫ টাকা কেজি কিনে আনছি, ৮৫ টাকা বিক্রি করছি; এরপর বিকালে ১১ নম্বর আড়তে গিয়ে শুনি আড়তেই ৯০ টাকা কেজি, তাইলে আমার তো আর ১০০ এর নিচে না বেইচা উপায় নাই,” বলছিলেন মিরপুর ১৩ নম্বরে পুলিশ কনভেনশন সেন্টারের সামনে ভ্যানে করে পেঁয়াজ বিক্রি করা আমজাদ হোসেন।
পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি দ্রুতই ১০০ টাকা উঠে যাওয়ার ব্যাখ্যা এভাবেই দিলেন তিনি। তার বক্তব্যে এটিও স্পষ্ট যে দিন ছাড়িয়ে এখন বেলার ব্যবধানে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম।
খাতুনগঞ্জের আড়তদার মোহাম্মদ ইদ্রিসের তথ্যও মিলে যায় ভ্রাম্যমাণ এ পেঁয়াজ বিক্রেতার সঙ্গে।
স্থানীয় আড়ত ব্যবসায়ীদের নেতা ইদ্রিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, রোববার মানভেদে আড়তগুলোতে দিনভর পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৮৫ থেকে ৮৭ টাকা পর্যন্ত। বিকালে এ দর গিয়ে ঠেকে ৯০ টাকায়। শনিবার এ দর ছিল ৮২ থেকে ৮৫ টাকা।
তিনি বলেন, “পেঁয়াজের দাম এমনিতেই বাড়ছিল। মোকাম ও কৃষক পর্যায়ে পণ্য আছে। গত কয়েকদিনে মোকামে মণপ্রতি দুইশ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। সেকারণে আড়তে রোববার দর কেজি ৯০ টাকা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে।“
চট্টগ্রামে খুচরা দোকানগুলোতে রোববার মানভেদে পেঁয়াজ ৯৫ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
ঢাকার মিরপুরের ১১ নম্বরের পেঁয়াজের আড়তে গিয়েও বেলা গড়াতে গড়াতে দাম বাড়তে থাকার কথা শোনা গেল। তবে সব আড়তের লোকজনেরই দাবি আড়তে পেঁয়াজ কম, তাই দাম বাড়তি।
বিকালে সেখানকার এক আড়তের কর্মী মোফাসসেল মিয়া জানান, পাইকারিতে হাইব্রিড পেঁয়াজ ৯৫ টাকা, দেশি অরজিনালটা এখন ১০০ টাকা। সকালেও কম ছিল; শনিবার ছিল আরও কম।
সকাল-বিকালে দুই দরের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তা তো আর আমরা জানি না, আমাদের ব্যবসা বেপারীদের সাথে। তারা মোকাম থেকে পেঁয়াজ কিনে আমাদের কাছে বিক্রি করে। তারা যে রেট দেবে আমরা তো সেটাই বিক্রি করব।
“১০০ টাকা কেজি হলেও আমাদের কমিশন ২ টাকা আর ২০০ টাকা কেজি হলেও সেই ২ টাকাই। আড়তে যা মাল দেখেন তা অনেক কম, একবেলার মাল। পেঁয়াজ কম হওয়াতে এই অবস্থা। আমাদের কোনো সিন্ডিকেট নাই।”
হিসাব মিলছে না হাজেরার
পেঁয়াজের দামের এমন গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না হাজেরা বেগমের মতো সীমিত আয়ের মানুষেরা। তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার ছেলে, পেশায় ট্রাকচালক। তাই মাসের হিসাবটা হাজেরাকে বুঝে শুনেই করতে হয়।
মিরপুর ১৩ নম্বরের মাদ্রাসা মার্কেটে বাজার করতে এসে পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। ১১০ টাকা কেজি দাম শুনে হাজেরা বলেন, “কালকে নিছি ৯৫ টাকা। আজকে ১১০ টাকা চায়। এইভাবে দাম বাড়লে গরীবে কেমনে খাইবো।”
এ মার্কেটের মুদি দোকানি আজগর আলী পাবনার পেঁয়াজ বিক্রি করছেন ১১০ টাকায়৷ ফরিদপুরের পেঁয়াজ ১০০ টাকা ও ছোট পেঁয়াজ ৯০ টাকা। কেনা দামের প্রসঙ্গ তুললে তিনি জানান, শনিবার ছিল ৯০ টাকা। খরচ আছে ৫ টাকা। ১৫ টাকা লাভ না করে পুষবে না। দোকান ভাড়া, আরও কত খরচ আছে।
আরও পড়ুন:
দর ১০০ টাকা ছোঁয়ার পর পেঁয়াজ আমদানিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সায়
খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম বাড়াচ্ছে ‘অসাধু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা’
‘পেঁয়াজ আমদানি ছাড়া উপায় নেই’, কৃষি মন্ত্রণালয়কে বাণিজ্যের চিঠি