Published : 20 Aug 2022, 12:59 AM
বাংলাদেশকে দেওয়া আরও ১ শতাংশ শুল্কমুক্ত পণ্যের তালিকায় সব ধরনের তৈরি পোশাক অন্তর্ভুক্ত থাকছে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক লিখিত সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, নতুন করে ১ শতাংশসহ ৯৮ শতাংশ পণ্যে দেওয়া শুল্ক সুবিধার মধ্যে সব ধরনের পোশাক পণ্য রয়েছে।
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এর দুদিনের ঢাকা সফরের সময় ৭ অগাস্ট বাংলাদেশ থেকে আরও ১ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা আসে; যে সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে ১ সেপ্টেম্বর থেকে।
এর আগে ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির দেওয়া আগের শুল্কমুক্ত সুবিধার তালিকায় তৈরি পোশাক খাতের নিট ও ওভেনের প্রায় সব পণ্য অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছিল। তবে তখনও বাংলাদেশের প্রধান এ রপ্তানি পণ্যের কিছু আইটেমে চীন পুরো শুল্ক তুলে দেয়নি।
সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূত জিমিং জানিয়েছেন, নতুন ১ শতাংশের আওতায় এবার তৈরি পোশাকের সব পণ্য বিনা শুল্কের সুবিধা পাবে।
আর তালিকায় আরও থাকছে বাদাম তেল, সূর্যমুখী তেল ও কটন সিড অয়েল, পলিইথিলিন ও পলিপ্রোপিলিনের মত রাসায়নিক ও জুতাসহ বিভিন্ন পণ্য বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের ৯৭ ভাগ পণ্যকে নিজেদের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ দেয় চীন। এ সুবিধার আওতায় তখন ৮ হাজার ২৫৬ পণ্যকে বিনা শুল্কে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে আরও ১ ভাগ পণ্যকে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সিদ্ধান্তকে সেই সময় ‘সুসংবাদ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
ওই সময় তিনিও আভাস দিয়েছিলেন, তৈরি পোশাকের সব পণ্য এবার নতুন শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ পাওয়া পণ্যের মধ্যে থাকতে পারে।
বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক। বিশ্বে পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারকও বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রপ্তানিতে ৮১ দশমিক ৮১ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক; যা টাকার অঙ্কে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ওই সময়ে মোট পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ৫২ বিলিয়ন ডলার।
চীনের আগের দেওয়া ৯৭% শুল্কমুক্ত সুবিধার উপর ভর করে ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে পণ্য রপ্তানি প্রথমবারের মত এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল বলে জানান রাষ্ট্রদূত জিমিং। আগের বছরের তুলনায় যা প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।
চীনে যাওয়া এসব পণ্যের ৬০ শতাংশের বেশি পোশাক বলে বাংলাদেশের পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে জানান তিনি।
পোশাকের বাইরে অন্য পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধার বিষয়ে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের এই রাষ্ট্রদূত জানান, “বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে ৯৮ ভাগ শূন্য শুল্ক সুবিধায় বিভিন্ন ধরনের মৌলিক চামড়াজাত পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশি চামড়া শিল্পের রপ্তানিকারকদের জন্য যা ভালো খবর।”
নতুন সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ থেকে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, মধু ও গরুর মাংসও চীনের বাজারে বিনা শুল্কে প্রবেশের সুযোগ পাবে বলে জানান রাষ্ট্রদূত।
তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, ৯৮% শুল্কমুক্ত সুবিধা চীনে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়ানো, রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে অর্জনকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারবে।”
ওয়াং ই এর সফরে ভূ-রাজনীতির আলোচনা
চীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এর ঢাকা সফরে বর্তমান ‘অস্বস্তিকর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের’ বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে নিজেদের প্রয়োগিক সহযোগিতাকে গভীর করার বিষয়ে উভয় দেশ একমত হয়েছে বলে জানান রাষ্ট্রদূত জিমিং।
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ আর তাইওয়ানে উত্তেজনার মধ্যে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর এবং বৈশ্বিক মেরুকরণ নিয়ে দুপক্ষের আলোচনা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে এ কথা বলেন তিনি।
লি জিমিং বলেন, “এই সফরের মাধ্যমে নিজেদের ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বের প্রতি প্রতিশ্রুতির নবায়ন এবং এক চীন নীতির প্রতি অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে চীন ও বাংলাদেশ।
“একটি অস্বস্তিকর আন্তর্জাতিক পরিবেশের বিরুদ্ধে কৌশলগত সংহতির পাশাপাশি অধিকতর দৃঢ় প্রায়োগিক সহযোগিতা এবং এই অঞ্চল ও এর বাইরের দেশের জন্য উভয়ের যৌথ স্থিতিশীলতার শক্তিকে আরও গভীর করার বিষয়ে একমত হয়েছে দুদেশ।”
দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ সফরের অংশ হিসেবে ৬ অগাস্ট ১৭ ঘণ্টার জন্য ঢাকায় আসেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং।
সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন তিনি।
সফরে দুদেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চারটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য পুনরায় ভিসা ইস্যু ও নতুন ফ্লাইট চালুর ঘোষণা আসে বৈঠক থেকে।
চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, দুদেশের উন্নয়ন কৌশলগুলোর সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে সমন্বয়ের বিষয়ে উভয় দেশ একমত হয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটি (বিআরআই) ও বাংলাদেশের ভিশন ২০৪১ লক্ষ্যমাত্রা এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে।
“অবকাঠামো, ডিজিটাল অর্থনীতি, পরিবেশবান্ধব উন্নয়নসহ অন্যান্য খাতে সহযোগিতা আরও গভীর হবে।”
দুই দেশের ঐতিহ্যগত বন্ধুত্ব এবং পরস্পরের জন্য লাভজনক সহযোগিতাকে হালনাগাদ করাই ছিল স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াংয়ের সফরের উদ্দেশ্যে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জিডিআই ও জিসিআই এ নজর চীনের
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের পর বৈশ্বিক পরিবর্তন ও করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষাপটে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) ও গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিসিআই) নামে দুটি নতুন কৌশল ঘোষণা করেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
এ দুই কৌশলের মাধ্যমে নীতি সমন্বয় ও প্রায়োগিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জরুরি প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি বৈশ্বিক উন্নয়ন ও শান্তির বিষয়ে সাড়া দেওয়ার কথাও বলে আসছে চীন সরকার।
জিডিআই ও জিসিআই নিয়ে ওয়াংয়ের সফরে আলোচনা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে রাষ্ট্রদূত জিমিং বলেন, এ দুই কৌশলের বাস্তবায়ন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায় চীন।
“জিডিআই ও জিসিআইয়ের বাস্তবায়নকে এগিয়ে নেওয়া, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়ে সমন্বয় জোরদার, আমাদের দুদেশ ও উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের সর্বজনীন স্বার্থের সুরক্ষা; একসঙ্গে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক উন্নয়ন, প্রগতির পথে অগ্রসর এবং মানবতার জন্য একই রকম ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য চীন বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।”
তাইওয়ান: ‘বল এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রান্তে’
তাইওয়ান বিষয়ে এক প্রশ্নে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, “তাইওয়ান চীনের ভূখণ্ড, এটাই আমাদের লাল দাগ। যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত উস্কানির মুখে আমরা অলস বসে থাকব না এবং আমাদেরকে ন্যায়সঙ্গত ও প্রয়োজনীয় সাড়া দিতেই হবে।
“চীনের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় তাইওয়ান দ্বীপের জলসীমায় মহড়া চালিয়েছে চীনা সামরিক বাহিনী। দেশি ও আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই চালানো হয় ওই মহড়া।”
বিশ্ববাসী আরেকটি সংঘাত সামনে দেখতে পাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বল এখন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। তারা যদি উত্তেজনা কমাতে চায়, তাদের উচিত হবে এক চীন নীতি ও চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া তিনটি যৌথ বিবৃতির অবস্থানে ফিরে আসা। উভয় দেশের মধ্যে পাঁচটি ‘নোটে’ তাদের নেতারা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা কঠোরভাবে মেনে চলা।”
যুক্তরাষ্ট্র যদি পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তাহলে চীনের দিক থেকে ’কঠিন ও শক্তিশালী’ প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়বে বলে হুঁশিয়ার করেন রাষ্ট্রদূত।
তাইওয়ান দ্বীপ ঘিরে চীনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা উল্লেখ করতে গিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে লি জিমিং বলেন, ‘এক দেশ ও দুই নীতি’র আলোকে তাইওয়ানকে শান্তিপূর্ণভাবে একীভূত করতে চায় চীন। প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগেও প্রস্তুত তারা।
তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, “চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তাইওয়ান সমস্যা সমাধানের ঐতিহাসিক মিশনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে পুনঃএকত্রিকরণ এবং ’এক দেশ দুই নীতি’ হচ্ছে তাইওয়ান সমস্যা সমাধানে আমাদের মৌলিক নীতি ও জাতীয় একীভূতকরণের উত্তম পদ্ধতি।”
তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে পুনঃএকত্রিকরণের জন্য সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করলেও প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের বিষয় উড়িয়ে দিচ্ছে না চীন।
‘এক দেশ ও দুই নীতির’ মাধ্যমে একীভূতভাবে পরবর্তী অগ্রগতির পথ ও জাতীয় পুনর্জ্জীবনের ভিত্তি রচিত হবে বলে উল্লেখ করেন চীনা রাষ্ট্রদূত।
তাইওয়ানকে একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসেবে দেখে চীন; সে হিসেবে, দ্বীপটি চীনেরই অংশ। অন্যদিকে তাইওয়ানের অনেক নাগরিকই স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হোক বা না হোক তাদের স্বশাসিত দ্বীপটিকে পৃথক দেশ মনে করেন।
বর্তমানে তাইওয়ানে এখনকার ক্ষমতাসীন ডিপিপিই আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার পক্ষে। অন্যদিকে কুওমিনতাং বা কেএমটি চায় চীনের সঙ্গে একীভূত হয়ে যেতে।
তবে জরিপে দেখা গেছে, তাইওয়ানের বেশির ভাগ নাগরিকই স্বশাসিত দ্বীপটির এখনকার স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে; যেখানে তাইওয়ান না স্বাধীন, না পরাধীন।
আরও পড়ুন
আরও ১% পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে চীন
শিক্ষার্থীদের ভিসা দেওয়া শুরু করছে চীন
চীনের সঙ্গে ৪ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক
চীন-তাইওয়ান উত্তেজনার পেছনে কী?
তাইওয়ান পরিস্থিতি: ঢাকার কাছে প্রত্যাশা কী, জানাল বেইজিং
বাংলাদেশের ‘এক চীন’ নীতির অবস্থানকে সাধুবাদ চীনের
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনার টেবিলে কী থাকছে?
ওয়াংয়ের ঢাকা সফর: রোহিঙ্গাদের ফেরানোর অগ্রগতির সম্ভাবনা কতটা?