নারায়ণগঞ্জে দুটি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করেন তিনি; মতবিনিময় করেন পোশাক খাতের সংগঠন বিকেএমইএ নেতা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে।
Published : 13 Jan 2025, 10:51 PM
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর ইউরোপের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে বহু উদ্যোগ নেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার।
সোমবার নারায়ণগঞ্জে দুটি নিটওয়্যার কারখানা পরিদর্শন ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে গিয়ে এ কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ যেন ’সাবলীল’ হয়, সেই প্রত্যাশা করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। পরবর্তী অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি এখনকার ‘অস্ত্র ছাড়া সব কিছু বা ইবিএ’ সুবিধা থেকে ভিন্ন রকম হলেও বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে।
“তবে এর মানে হচ্ছে, এখানকার ব্যবসায়ী অংশীদার এবং বাংলাদেশ সরকারকে এখন বিশাল কর্মযজ্ঞ চালাতে হবে।”
শ্রম আইনের সামগ্রিক পর্যালোচনার মাধ্যমে সেই কর্মযজ্ঞের সূচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে মাইকেল মিলার বলেন, “অদূর ভবিষ্যতে আমরা এটা দেখতে চাই এবং আমরা আশা করি এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে স্বচ্ছতা বজায় রাখা হবে।”
সোমবার সকালে নারায়ণগঞ্জের মদনপুর এলাকায় ইপিলিয়ন নিটওয়্যারের কারখানা পরিদর্শনে যান ইইউ রাষ্ট্রদূত। সেখানে ইপিলিয়ন গ্রুপের কর্মকর্তা এবং বিকিএমইএ প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর কারখানার বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন তিনি।
এসময় কারখানার পরিবেশ, সবুজায়ন, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, কর্মপরিবেশ, কারখানার সার্টিফিকেশনসহ নানাবিধ প্রশ্ন করে মাইকেল মিলার কারখানার সামগ্রিক বিষয় বোঝার চেষ্টা করেন।
কোম্পানির বিভিন্ন দিক এবং বাংলাদেশে রপ্তানিমুখী নিটওয়্যার খাতের বিভিন্ন দিক রাষ্ট্রদূতের সামনে তুলে ধরেন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, ইপিলিয়ন গ্রুপের পরিচালক জুনাইদ আবু সালেহ মুসা, ইপিলিয়ন নিটওয়্যারের উপ-মহাব্যবস্থাপক (কমপ্লায়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি) শাহ আলম, উপ-মহাব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ, প্রশাসন ও কমপ্লায়েন্স) আহমেদ রিয়াজুল মোস্তফাসহ অন্যরা।
মতবিনিময়ের পর কারখানায় নিরাপত্তা, সবুজায়ন, ডেকেয়ার, স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন তিনি। ডেকেয়ার সেন্টারে শিশুদের সঙ্গে খুনসুটি করতেও দেখা গেছে তাকে।
এরপর নারায়ণগঞ্জ চাষাড়ায় এসে বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমসহ ব্যবসায়ীদের নেতাদের সঙ্গে মতিবিনিময় করেন ইইউ রাষ্ট্রদূত। এরপর ফতুল্লায় মেট্রো নিটিং অ্যান্ড ডায়িং মিলস পরিদর্শন করেন তিনি।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইইউতে অন্য ৪৫টি দেশের সঙ্গে ’অস্ত্র ছাড়া সবকিছুতে’ শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়ে আসছে বাংলাদেশ।
২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের যাত্রায় ইউরোপের বাজারে এখনকার মত অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধার (জিএসপি) বিষয়ও আলোচনায় আছে।
আরও কয়েকবছর এ সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস ইইউ দিলেও কারখানার পরিবেশ, সবুজায়ন এবং শ্রম আইন সংস্কারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলছে তারা।
জিএসপির সুবিধা চলমান থাকার মধ্যে অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ২০ দশমিক ৭০ শতাংশ হয়েছে ইউরোপীয় এই জোটের সঙ্গে।
ওই বছর ইউরোপের বাজারে ১৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ, যাতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে তৈরি পোশাক খাত। এর বিপরীতে বাংলাদেশের আমদানি তিন বিলিয়ন ডলারের, যেসব পণ্যের তালিকায় মূলত ছিল যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক।
বিকেএমইএ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, “বার্তাটা হচ্ছে, আমাদের বাজারে প্রবেশাধিকার বাংলাদেশের ভবিষ্যত সমৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি নির্ভর করে তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও নিটওয়্যার খাত এবং পরিবেশগত, সামাজিক ও সুশাসনের অগ্রগতির উপর।”
ইইউ’র অর্থায়ন ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গে
বাংলাদেশের জন্য ঋণসহ আর্থিক সহযোগিতা এখনকার এক বিলিয়ন ইউরো থেকে চলতি বছর দ্বিগুণ করার সম্ভাবনার কথা বলেছে ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (ইআইবি), পরিবেশগতভাবে টেকসই প্রকল্পের ঋণের মাধ্যমে আসার কথা এই অর্থ।
সম্প্রতি ঢাকা সফরে ইআইবি ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বির সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত প্রায় এক বিলিয়ন ইউরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছি এবং সম্ভবত এই পরিমাণটাকে দ্বিগুণ করতে পারি। এবং সেটা এ বছরের মধ্যে হতে পারে।”
নতুন অর্থায়নের বিষয়ে এক প্রশ্নে রাষ্ট্রদূত মিলার বলেন, “আমরা এদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছি এবং এর সঙ্গে বাংলাদেশের পরিবেশ সুরক্ষা ও কারখানায় নিরাপত্তার ব্যবস্থার স্থাপনের ক্ষেত্রে ঋণও আসছে।
“এটা একটা দিক। আপনাদের কমপ্লায়েন্স যাতে বাড়তে পারে, সেজন্য আমরা এখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়ন নিয়ে আসছি।”
সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ানোর ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ইইউ ও বাংলাদেশের মধ্যে বেশ বড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। সেই তুলনায় এফডিআই খুবই কম।
“বাস্তবিক অর্থে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিনিয়োগ কীভাবে বিস্তৃত করা যায়, সেজন্য আমি এখানে। এটা মূলধন বিনিয়োগ কিংবা বাণিজ্য বা যন্ত্রপাতিতে।”
রাজনৈতিক পালাবদলের প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা দিয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি আলোকপাত করতে চাই, আমরা আপনাদের অন্তর্বর্তী সরকারের খুব তাৎপর্যপূর্ণ অংশীদার। বাংলাদেশে আমাদের এজেন্ডা হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার যেন সফল রাজনৈতিক পালাবদল নিশ্চিত করতে পারে এবং বাণিজ্য ও ব্যবাসায়িক যোগাযোগ বাড়ে।”
বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ককে আরও আরও গভীর করার বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার কথা বলেন তিনি। কারখানা ঘুরে দেখা বিনিয়োগ ও পেশাদারিত্বকে ‘খুব অভিভূতকারী উদ্যোগ’ হিসেবে তুলে ধরেন করেন তিনি।
এলডিসির উত্তরণ পেছানোর পক্ষে বিকিএমইএ
এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের লক্ষ্য ২০২৬ থেকে পেছানোর দাবির কথা তুলে ধরেন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারগুলোতে জিএসপি সুবিধার আওতায় সর্বোচ্চ রপ্তানি করে।
“তবে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে এ সুবিধা হারাতে হবে কিন্তু এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ এখনও সক্ষম না।”
বাংলাদেশ সরকার যদি এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দিতে চায়, সেক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতাও কামনা করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম বৈঠকের ৪০তম প্লেনারি সভায় স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে গত ৪ থেকে ৮ মার্চ জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বা সিডিপির পর্যালোচনা বৈঠকে বলা হয়, এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়েছে কিংবা হওয়ার পথে রয়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই টানা তিনটি মূল্যায়নে সব সূচকে পাস করেছে।
বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের তারিখও ঠিক করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে।
এছাড়া বিগত এক দশকে পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাখ্যা করে এবং এইচআরডিডিডি আইনের প্রতি রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বিকেএমইএ’র সভাপতি।
তিনি বলেন, “আমাদের উপর আইনটির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বায়াররা সে অনুযায়ী ন্যায্য দাম দিতে ইচ্ছুক নয়। ফলে এটি এক ধরনের চাপ তৈরি করছে আমাদের উপর। অর্থাৎ ক্রেতারা অনৈতিক ক্রয়াদেশের চর্চা করছে যা কাম্য নয়, পণ্যের ন্যায্য দাম পাওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রদূতের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন তিনি।
সর্বোপরি এলডিসি পরবর্তী বাংলাদেশের অবস্থা, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আর্থ সামাজিক উন্নয়নের কথা বিবেচনায় রেখে ভবিষ্যতেও ইইউ এই সুবিধা বাংলাদেশের জন্য বজায় রাখবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণের হওয়ার পর আরও অন্তত ছয় বছর জিএসপি সুবিধা বজায় রাখতে রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে ইউরোপের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি শামীম এহসান।