এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকার বাজারে খুচরায় দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা।
Published : 24 Oct 2023, 09:31 AM
মওসুমের শেষের ভাগে ধানের সরবরাহ কমে যাওয়ার মধ্যে চাহিদা বাড়ছে মোটা চালের; এতে খুচরায় সপ্তাহের ব্যবধানে দামও বেড়েছে সাধারণের প্রধান এ খাদ্যপণ্যের।
ডিম, পেঁয়াজ, সবজির দাম চড়তে থাকার মধ্যে ঊর্ধ্বমুখী কাঁচাবাজারে কেজিপ্রতি মোটা চালের দামও ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়ে গেছে। চিকন চাল হিসেবে পরিচিত মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দামও প্রতি কেজিতে প্রায় ২ টাকা বেড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
ঢাকার মিরপুরের কয়েকটি বাজার ও মহাখালী কাঁচাবাজার ঘুরে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম বাড়ার এ চিত্র দেখা গেছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, চালকল মালিকরা ও আড়তে দাম বেশি রাখা হচ্ছে বলে পাইকাররা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই তারাও দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন।
তবে মিল মালিকরা বলছেন, মওসুমের শেষ দিকে সরবরাহ কমে আসায় ধানের দাম বাড়ার প্রভাবে কিছুটা বেড়েছে চালের দাম। যদিও মিল ও আড়তে যতটা বেড়েছে খুচরায় ততটা বেড়ে যাওয়ার কারণ নেই বলে দাবি তাদের।
বোরো মওসুমের শেষ সময়ে ধানের মজুদ কমে আসার মধ্যে অক্টোবরে ওএমএসের চাল বিতরণ বন্ধ থাকাকে বাজারে মোটা চালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ বলে অনেকেই মনে করছেন।
তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অক্টোবরের বরাদ্দ সেপ্টেম্বরেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওএমএসের উপকারভোগীরা কেজিপ্রতি ১৫ টাকা দরে মাসে ৩০ কেজি চাল পেয়ে থাকেন এবং সেপ্টেম্বরেই দুমাসের চাল পেয়েছেন। শুধু ওএমএস নয়, বিভিন্ন বাহিনীর জন্য অক্টোবর মাসের বরাদ্দও সেপ্টেম্বরে বিতরণ করা হয়ে গেছে।”
গুদাম খালি করার প্রয়োজনে দুই মাসের বরাদ্দ এক মাসে দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, “নভেম্বরে আবার চাল পাবেন উপকারভোগীরা।”
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সেলিম রায়হান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিগত কয়েক মাসের মূল্যস্ফীতির সময় চালের বাজারটা বেশ স্থিতিশীল ছিল। এখন মৌমুসের শেষ দিকে এসে দাম যে কিছুটা বেড়েছে, হয়তো স্বাভাবিকভাবেই তা বেড়েছে। সামনের মাসে আমনের নতুন ধান বাজারে আসতে শুরু করলে দামটা হয়তো ওভাবে আর বাড়তে সুযোগ পাবে না।
“তবে সরকারি ভাষ্য- 'চাল আমদানির প্রয়োজন নেই, যথেষ্ট মজুদ আছে' এমন বক্তব্যের সঙ্গে বর্তমান মূল্য বৃদ্ধিটা সাংঘর্ষিক। সে কারণে আমার পরামর্শ হচ্ছে, 'বাজার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে আমরা আমদানি শুরু করব’ এমন ঘোষণা দিয়ে রাখাই ভালো। তাহলে অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা করতে পারবেন না।”
দিনাজপুর, নওগাঁ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার কয়েকজন মিলারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা চালের দাম বেশি রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। দাম বাড়াবার কোনো পাঁয়তারা হচ্ছে না বলে দাবি তাদের।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার আল মদিনা ও মামা-ভাই্গ্না অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম স্বত্ত্বাধিকারী জামাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকায় চালের দাম যতটা বাড়ানো হয়েছে বলে শুনেছি, মিল পর্যায়ে ততটা বাড়েনি। প্রতি কেজিতে মিল মালিকরা এক থেকে দেড় টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে।”
তিনি বলেন, “সাধারণত আমন ফসল কাটার মৌসুমকে সামনে রেখে ধানের দাম একটু বেশি থাকে। তবে যেসব ধান থেকে মোটা চাল হয় সেগুলোর দাম এই মৌসুমে খুব একটা বাড়ে না। মোটা চালের দাম বাড়ে তখন, যখন সরকারি উদ্যোগে ধান-চাল কেনা হয়।”
নওগাঁ জেলা চালকল সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত এক মাসে সব ধরনের ধানের দাম মণপ্রতি ১০০ টাকা করে বেড়েছে। এখন সিজনের শেষ দিক, আগামী ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে রোপা আমন আসবে। তখন চালের দাম আবার কমে আসবে।”
রোববার তিনি বলেন, “আজকে জিরাশাইল (মিনিকেট) ধানের বাজার হচ্ছে প্রতিমণ (৪০ কেজি) ১৪০০ থেকে ১৪৫০ টাকা। কাটারি ধানের দাম প্রতিমণ ১৪০০ থেকে ১৪২০ টাকা। বিআর ২৮ ধানের আজকের বাজার হচ্ছে ১৩০০ টাকা। ধানের দাম বৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকভাবে চালের দামও কিছুটা বেড়েছে।”
দিনাজপুর জেলা ধান চাল ব্যবসায়ী গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মো. সাদেকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মিলাররা মূলত মুড়ির চাল বানানো নিয়ে ব্যস্ত। হাইব্রিড ধান বিশেষ করে স্বর্ণা-৫ এবং হিরা মোটা ধান পাওয়া যাচ্ছে না বলে চালও হচ্ছে না। ওদিকে আবার বাজারে মোটা চালের চাহিদা বেড়েছে। ফলে দামও কিছুটা বেড়েছে।”
মহাখালী কাঁচাবাজারের খুচরা চাল বিক্রেতা জাকির ট্রেডার্সের মালিক মো. মুজিবুর রহমানও মোটা চালের ক্রেতা বেড়েছে বলে জানালেন। তিনি বলেন, “আমার দোকানে যে পরিমাণ চাল বিক্রি হয় তার অন্তত ৬০ ভাগ মোট চাল। এবার এই মোটা চালের দামটাই বাড়ছে বেশি।”
কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটসহ কয়েকটি পাইকারি বাজার থেকে চাল সংগ্রহ করেন জানিয়ে তিনি বলেন, সব বাজারেই গত এক সপ্তাহের মধ্যে চালের দাম বেড়েছে।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশের বাজারে এখনও বোরো মৌসুমের চাল বিক্রি হচ্ছে। আগামী ২০-২৫ দিন পর আমন কাটা শুরু হবে। অর্থাৎ বোরো ধানের শেষ মজুদ এখন বাজারে আসছে। মজুদদাররা শেষের এই মজুদের দাম কিছুটা বাড়ানোর কারণেই চালের দাম বাড়ছে।
তবে সাধারণ ভোক্তাদের অভিযোগ সরকার ঠিকমতো বাজার তদারক না করার কারণে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কারণে ব্যবসায়ীদের কাছে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে বলে ক্ষোভ তাদের।
ঢাকার মিরপুর-১, মিরপুর ১১, ও মহাখালী কাঁচাবাজারের চালের বাজার ঘুরে দেখা যায়, মোটা চাল হিসেবে পরিচিত স্বর্ণা ও বিআর ২৮ প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে মান ও বাজার ভেদে ৪৮ থেকে ৫৫ টাকায়। মোটা চালের এ দাম গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বেশি।
মিনিকেট চাল প্রতিকেজি বিক্রি ১ থেকে ২ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় এবং নাজিরশাইল অন্তত ১ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়।
মিরপুর ১১ এর বিসমিল্লাহ রাইস এজেন্সির স্বত্ত্বধিকারী মো. আলী আকবর রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি ময়মনসিংহ, শেরপুর ও জামালপুরসহ বেশ কয়েকটি মোকাম থেকে চাল কিনি। গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে বিশেষ করে মোটা চালের দাম প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় ২০০ টাকা বেড়ে গেছে। এছাড়াও মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে।
তিনি বলেন, এক সপ্তাহ আগে শেরপুর মোকাম থেকে মোটা চাল কিনেছি প্রতিবস্তা মান ভেদে ২০৫০ থেকে ২১০০ টাকায়। ৫০ কেজির এ বস্তা এখন কিনতে হচ্ছে প্রায় ২২৫০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতিকেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে।
এখন মিনিকেট কিনতে হচ্ছে প্রতিবস্তা প্রায় ৩১০০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এটা ৫০ টাকা কম ছিল।
নাজির শাইল প্রতিবস্তা আগে কিনতাম ২৯০০ টাকায়। এখন কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকা বেশি দামে। এ কারণে আগের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে, বলেন তিনি।
পাইকারি ব্যবসায়ী আলী আকবর রনি বলেন, শেরপুরের মোকাম থেকে তাকে জানানো হয়েছে যে, এখনও দেশে বোরো মৌসুমের চাল বাজারজাত হচ্ছে। তবে সেই ধান এখন মজুদদারদের কাছে শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু নতুন মৌসুম আমনের ফসল কাটতে আরও ২০ দিন মতো লাগবে।
এ সুযোগে মজুদদাররা ধানের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর প্রভাবে চালের দাম বেড়েছে, যোগ করেন তিনি।
মিরপুর ১১ এর খুচরা ব্যবসায়ী হৃদয় হোসেন জানান, তিনি মোটা চাল স্বর্ণা ৫০ টাকায় ও বিআর ২৮ প্রতিকেজি ৫৩ টাকায় বিক্রি করছেন। মোটা চাল হিসেবে পরিচিত এ চালের প্রতিকেজি গত সপ্তাহে ৪ টাকা কমে বিক্রি করেছেন।
তিনি জানান, মিনিকেট ২ টাকা বাড়িয়ে মানভেদে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা এবং নাজিরশাইলের প্রতিকেজি অন্তত ১ টাকা বাড়িয়ে ৬৮ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি করছেন।
মিরপুর ১১ এর পাইকারি বাজার থেকে চাল এনে বিক্রি করেন এ বিক্রেতা। পাইকারি বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত এ দামে বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালেও প্রতিকেজিতে ১ থেকে ২ টাকা বেড়েছে বলে জানান তিনি।
মহাখালী বাজারে চাল কিনতে আসা ক্রেতা রুহুল আমিন বলেন, “গত দশ বছর ধরে আমরা চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই চালের দাম কোনওভাবেই আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সম্পর্কিত নয়। আবার দেশেই যথেষ্ট মজুদ আছে বলে বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলাও হয়েছে। তাহলে কোনও কারণ ছাড়াই দেশে কেন চালের দাম বাড়বে?”
সরকারি এই কর্মচারীর দাবি, আসলে আমাদের দেশে অন্যান্য দেশের মতো বাজারের ওপর কঠোর নজরদারি নেই। তদারকির মাধ্যমে অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকত।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সম্প্রতি বেশ কয়েকটি পণ্য নিয়েই আমাদের টানা অভিযান পরিচালনা করতে হচ্ছে। ডিম পেঁয়াজসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য নিয়ে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি।”
“এরমধ্যে আমরা খবর পাচ্ছি এখন চালের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে ব্যবসায়ীরা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করব”, যোগ করেন তিনি।