Published : 08 Jun 2022, 09:43 PM
মানুষের সুন্দর করে বেঁচে থাকার জন্য পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হয়। নারীদের মৌলিক চাহিদা একটি বেশি। কেবল স্বাস্থ্য দিয়ে যা প্রকাশ হয় না; আর তা হল পিরিয়ড বা মাসিক সামাল দেওয়া উপকরনের নিত্য যোগান।
কিন্তু সামাজিক ট্যাবু বা বাধা তাকে সেই অধিকার আদায় থেকে বঞ্চিত রাখে। যদিও আজকাল বিভিন্ন সংস্থা এই ট্যাবু বা বাধা ভাঙ্গার জন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে তা সবই স্যানিটারি প্যাড কেন্দ্রিক। স্যানিটারি প্যাড কতটা আরামদায়ক আর স্বাস্থ্যকর, এটা বিকিকিনিতে বা পিরিয়ড নিয়ে যেন কোনো দ্বন্দ বা সংস্কার না থাকে সেসব নিয়ে অনেক গঠনমূলক বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়, যা খুবই আশাব্যবঞ্জক। মুশকিল হলো, এসব জ্ঞানগর্ভ আলোচনার পাশে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টা আড়ালে থেকে যায়। আড়ালে থেকে যায় খরচের কথা আর ব্যবহৃত প্যাড থেকে পরিবেশ দূষণের কথা।
স্যানিটারি প্যাডকে আপনার কাছে আকর্ষণীয় করতে বলা হয় এটি কত হালকা, কতটা লম্বা, কতটা সময় ব্যবহার করা যায়, কত তাড়াতাড়ি এটি রক্ত শুষে নিতে পারে বা কতটা সুগন্ধ ছড়ায় ইত্যাদি বিশেষণ। আর এগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে অনেকগুলো স্বাস্থ্যঝুঁকি।
স্যানিটারি প্যাড যেন লিকপ্রুফ হয় আর বেশি আর্দ্রতা শোষণ করতে পারে সেজন্য প্রাকৃতিক তুলার বদলে এগুলিতে সিনথেটিক ফাইবার বা রেয়ন ব্যবহার করা হয়। রেয়ন বা প্রাকৃতিক তুলাকে সাদা করার জন্য ব্লিচ করা হয়। আর ব্লিচ করলেই ডাইঅক্সিন তৈরি হয়। স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে শরীরের কিছু কিছু জায়গায় র্যাশ হয়, চুলকায় আর সে জায়গাটা কালো হয়ে যায়। এসবই হয় ডাইঅক্সিনের কারনে।
যদিও স্যানিটারি প্যাডের মাধ্যমে ডাইঅক্সিনের সংস্পর্শকে পণ্য নির্মাতারা তুচ্ছ বলে মনে করেন। তারপরও ডাইঅক্সিনযুক্ত প্যাড বছরের পর বছর ব্যবহার করলে তা আপনার ভ্যাজাইনা, সার্ভিক্স এরিয়ায় জমে থাকতে পারে আর সার্ভিকাল ক্যান্সার এবং ওভারিয়ান ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
বেশিরভাগ স্যানিটারি প্যাড যে প্লাস্টিকে তৈরি হয় তা বিপিএ যুক্ত এবং রয়েছে সিনথেটিক লাইনিং, যা পিরিয়ড রক্তের আর্দ্রতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যাকটেরিয়া এবং ইস্ট তৈরির প্রজননক্ষেত্র তৈরি করে। আর্দ্র পরিবেশ যেকোন জীবাণুকে দ্রুত বংশবিস্তারে সাহায্য করে এবং যোনিতে সংক্রমণ ঘটায়।
প্যাডে জমা হওয়া রক্তের গন্ধ কারোরই পছন্দ নয়। প্যাড নির্মাতা কোম্পানিও তা জানে। সেজন্য তারা এই গন্ধ দূর করতে একধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, সাথে ব্যবহৃত হয় বাড়তি মিষ্টি গন্ধ যা প্যাকেট খুললেই টের পাওয়া যায়। এই সুগন্ধির রাসায়নিক উপাদানগুলি মারাত্মক জ্বালা এবং অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে।
স্যানিটারি প্যাড বাছাই করার সময় আপনার বিবেচনায় থাকে, এটি কত দ্রুত মাসিকের রক্ত শুষে নিতে পারবে আর কতটা নিতে পারবে! তাই নির্মাতা কোম্পানিও সেই প্রত্যাশিত শব্দ জুড়ে দিয়ে বলে সেকেন্ডেই শুষে নিতে সক্ষম। আদতে স্যানিটারি প্যাডে ব্যবহৃত রক্ত শোষণকারী পলিমারগুলি বেশিরভাগ পেট্রোলিয়াম জাত পণ্য যা তাদের ওজনের ত্রিশ গুণ রক্ত শোষণের দাবি করে আর তাই তা হয় ভীষণই পাতলা।
স্যানিটারি প্যাডের এই গুণটিই সবার জন্য জরুরি হয়ে ওঠে। কারণ পিরিয়ডের ভেজা ভাব অনুভব করতে ভালো লাগে না কারো। আবার খুব জলদি সেটা পাল্টাতেও চাননা খরচের কথা ভেবে।
প্যাডের এই বিশেষত্বই ডেকে আনতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যেঝুঁকি। এটি যৌন অংগে ফুসকুড়ি, অ্যালার্জি, প্রজনন সমস্যা এবং টক্সিক শক সিনড্রোমের কারণ হতে পারে। পিরিয়ড শেষে বা মাঝামাঝিতে বেশিরভাগ মেয়ে যৌনাঙ্গে প্রচন্ড চুলকানি ও জ্বলুনি হয়, সাথে গা গরমও হয়। এগুলোই টক্সিক শক সিনড্রোম। যা দিনের পর দিন অবহেলা করে চলেন অধিকাংশ নারী।
একটা ভালো মানের প্যাড চারটি বড় আকারের পলিব্যাগের সমান প্লাস্টিক ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। যা একবার ব্যবহার করার পর ফেলে দিতে হয় প্রতিদিনের ময়লার ঝুড়িতে বা এখানে সেখানে অন্যান্য সাধারন ময়লার সাথে। কিন্তু এগুলাকে মেডিকেল বর্জ্য হিসাবে তুলনা করা উচিৎ এবং এর ব্যবস্থাপনাও তেমনই হবার কথা।
এই এক একটি প্যাড সাড়ে পাঁচশ থেকে আটশ বছর সময় নেয় পৃথিবীর মাটি বা পানির সাথে মিশতে। পাশাপাশি এতে ব্যবহার করা কেমিকেল আরাম দেওয়ার নামে নারীস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে; একই ভাবে ক্ষতি করছে পৃথিবীর মাটি, পানি, বাতাস আর অন্যান্য জীবজন্তুকে।
এক পরিসংখ্যানে প্রকাশিত হয়েছে, স্যানিটারি প্যাডের কারণে প্রতি বছর প্রায় ৮২ লাখ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয় বাংলাদেশে।
স্যানিটারি প্যাডের পেছনে খরচের খাতও একটা বিরাট ভাবনার বিষয়। নিম্মবিত্ত তো বটেই, এমনকি মধ্যবিত্ত্ব পরিবারেও এই ব্যয় বহন করা অনেকের জন্য বিলাসিতা। প্রতি মাসে দুইশ থেকে ছয়শ টাকার স্যানিটারি প্যাড লাগে প্রতিটা মেয়ের। আর যদি ব্যবহারকারী দুই বা ততোধিক হয় তাহলে খরচও বাড়ে গানিতিক হারে। কেবল স্যানিটারি প্যাডই নয়, এরসাথে যুক্ত হয় মাসিকের অন্তর্বাস, পানি আর সাবানের খরচও।
আর্থিক ও স্বাস্থ্য সঙ্কট থেকে রক্ষা করতে পারে মেন্সট্রুয়াল কাপ বা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বা বায়ো ডিগ্রেডেবল স্যানিটারি প্যাড। পরিবেশ বান্ধব স্যানিটারি প্যাড স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ। তবে প্যাডের অস্বস্তিকর অনুভূতি থেকে রেহাই পেতে ও ব্যবস্থাপনার জটিলতা এড়াতে মেন্সট্রুয়াল কাপের কোনো বিকল্প হয় না। সাথে মুক্তি পাওয়া যায় পিরিয়ডের স্যাঁতস্যাঁতে অনুভুতি থেকে।
দৈনন্দিন চলাফেরা, ঘুম, খেলাধুলায় মনোনিবেশ করা, সাঁতার কাটা এমনকি পিরিয়ডের দিনগুলোতে কর্মক্ষম থাকা যায় যদি মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা হয়। একটা মেন্সট্রুয়াল কাপ টানা ব্যবহার করা যায় পাঁচ বছরের বেশি সময়।
একজন নারী প্রজনন বয়সসীমায় যদি মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করে, তাহলে সর্বোচ্চ চারটা কাপ লাগবে যার বর্তমান বাজার দাম দুই হাজার টাকার কাছাকাছি। বাংলাদেশের বাজারে এটি পুরোটাই আমদানী নির্ভর, তাই মেন্সট্রুয়াল কাপ এখনো সাধারনের ক্রয় সীমার বাইরে। মেন্সট্রুয়াল কাপের বিকিকিনি এখনো কেবল অনলাইন ভিত্তিক ওয়েব সাইট বা সোস্যাল মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ। আর আনাও হয় সীমিত পরিসরে। তাই দাম এতটা বেশি। দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারে তৈরি করা হলে এর দাম চলে আসতে পারে চারশ-পাঁচশ টাকার মধ্যে।
তাহলে মাত্র দুই হাজার টাকাতেই একটা মেয়ের পুরো জীবনের মাসিকের খরচ চলে যেতে পারে।
দিনে দিনে আধুনিক প্রযুক্তির দিকে যাচ্ছি আমরা, সবকিছুতেই স্মার্টনেস খুঁজি। স্মার্ট ফোন আর স্মার্ট টিভি না হলে আমাদের চলে না। কেবল এই মাসিক বা পিরিয়ড নিয়ে আমরা পুরাতন প্রযুক্তি থেকে বের হতে পারিনা কেবল ভয় আর ট্যাবুর জন্য। নিজেকে কত কত চ্যালেঞ্জ দিয়েই তো জিতে যাই, বাচ্চা হবার সময় জীবন-মৃত্যুর সাথে ফিফটি ফিফটি চান্স নিতেও ভয় নেই আমাদের। কেবল ভয় এই ছোট্ট, কয়েক সেন্টিমিটার লম্বা-চওড়া একটা নিরাপদ মেডিকেল গ্রেডেড সিলিকন কাপকে। ভয়কে পাশ কাটিয়ে এই মেন্সট্রুয়াল কাপকে বন্ধু বানাতে পারলে রেহাই পাওয়া যায় ঝুঁকিপূর্ণ শারিরীক সমস্যা থেকে, মাসে মাসে পিরিয়ড ব্যয় থেকে। আর পৃথিবীকে বাঁচাতে পারি কোটি কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে। মেয়েদের মাসিক হোক নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর।