স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে হেলাফেলায় ‘স্বাস্থ্যঝুঁকি’

ধীর গতিতে হলেও নারীর মাসিক বা পিরিয়ডে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামাঞ্চলেও। নারীর সুস্বাস্থ্যের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের গুরুত্ব যেমন রয়েছে তেমনি এর সঠিক ব্যবহার না জানলে ঘটতে পারে নানা বিপত্তি।

তৃপ্তি গমেজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2021, 06:09 PM
Updated : 7 March 2021, 06:09 PM

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিরিয়ডের সময় পরিচ্ছন্নতায় গাফিলতি থেকে নারীর জরায়ু মুখের ত্বকে নানা সমস্যা ছাড়াও হতে পারে জরায়ু সংক্রমণও।

বাড়ির বাইরে থাকলে পারিপার্শ্বিকতার কারণে স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড বদলে দেরি হয় বলে জানালেন একটি বেসরকারি টেলিকম সংস্থার কর্মী তিথি সরকার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পিরিয়ডের সময় বরাবরই নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করি। তবে পিরিয়ডের শেষের দিকে অনেক সময়ই প্যাড বদল করতে অবহেলা করি।

“তাছাড়া অনেক সময় এমন হয় যে, অফিসে আছি, সাথে অনেক কলিগ আছে, তাই হয়ত প্রয়োজন কম থাকায় ছয় ঘণ্টারও বেশিও প্যাড পরে থাকা হয়। অনেক সময় পিরিয়ড চলাকালে বাইরে কোথায় ঘুরতে গেলেও দেখা যায় এই ধরনের অবহেলা করা হয়।”

এক সময় ঘরের পুরনো কাপড়ে বানানো ন্যাপকিনেই অভ্যস্ত ছিলেন সাইদা খানম। শুরুতে মানিয়ে নিতে একটু সমস্যা হলেও স্যানিটারি ন্যাপকিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন পুরান ঢাকার এই গৃহবধূ। তবে শুরুর দিকে তিনিও জানতেন না প্যাডের ব্যবহার। 

“প্যাড ব্যবহারের সময় মাথায় থাকত এটার অনেক দাম তাই অপ্রয়োজনে নষ্ট করা যাবে না। পরে একবার ডাক্তার দেখাতে গিয়ে জানতে পারি যে প্যাড আসলে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। এরপর থেকে যতটা সম্ভব পরিচ্ছন্নতা মেনে চলার চেষ্টা করি। আর আমার দুই মেয়ে আছে, তাদেরকেও এই বিষয়ে উৎসাহ দেই,” বলেন তিনি।

কাপড় হোক বা স্যানিটারি প্যাড; অবশ্যই চার থেকে ছয় ঘণ্টা পর পর বদল করতে হবে বলে পরামর্শ দিয়েছেন সাভারের বিজিএমই হাসপাতালের ফ্যামিলি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লিন্ডা সমদ্দার।

তিনি বলেন, “অনেকেই রক্তপাত কম হওয়ার কারণে দীর্ঘক্ষণ একই প্যাড পরে থাকেন। অনেকে আবার খরচ কমাতে অনেকটা সময় একই প্যাড ব্যবহার করেন। কেউ কেউ আবার বাইরে থাকায় লজ্জাবোধ বা আলসেমি করেও প্যাড পরিবর্তন করেন না।

“কারণ যাই থাকুক না কেন, দীর্ঘক্ষণ প্যাড ব্যবহারের ফলাফল একই। অনেকক্ষণ একই প্যাড পরে থাকায় ঘাম ও রক্তের কারণে আবদ্ধ স্থানে ফাঙ্গাসের সৃষ্টি হয়, যা পরে ত্বকের সমস্যার পাশাপাশি জরায়ু, পায়ুপথেও সমস্যার সৃষ্টি করে। পরিচ্ছন্নতায় অবহেলা করার কারণে জরায়ুর সংক্রমণ সৃষ্টি হয়।”

ঢাকা মেডিকেল কলেজের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাসুদা খাতুন বলেন, “অনেকক্ষণ একই প্যাড পরে থাকলে দুর্গন্ধ হয়। রক্ত অনেকক্ষণ আবদ্ধ থাকায় পচনের সৃষ্টি হয় এবং এর থেকে সংক্রমণ দেখা দেয়। এই সংক্রমণ জরায়ু পর্যন্তও বিস্তৃত হয়।

“স্যানিটারি ন্যাপকিন খোলা রেখে দিলে অথবা ধুলামুক্তভাবে সংরক্ষণ না করা হলে পিরিয়ডে ওই ন্যাপকিন পরার পর অনেকেরই অস্বস্তি ও চুলকানি দেখা দিতে পারে,” বলেন তিনি।

অনেকেরই স্যানিটারি ন্যাপকিন পরে থাকায় দুই পায়ের মাঝে ও নিতম্বে ছিলে যাওয়া, র‌্যাশ এমনকি দাগও হতে পারে। উরুতে ঘামের কারণে ত্বকে দেখা দিতে পারে ফাঙ্গাল ইনফেকশন এবং চুলকানিও।

আঁটসাঁট ও সিন্থেটিক কাপড় না পরে এই সময়টা তাই কোমরে নরম ইলাস্টিকের পাতলা সুতি বা গেঞ্জি কাপড়ের পাজামা, সালোয়ার বা প্যান্ট পরার পরামর্শ দিলেন মাসুদা খাতুন।

“ত্বকে চুলকানি হলে প্রাথমিক পর্যায়ে নারিকেল তেল ও ভ্যাসলিন ব্যবহার করা যেতে পারে। বাজারে যেসব অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল ও অ্যান্টি ফাঙ্গাল ক্রিম পাওয়া যায় তাও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে অবস্থা খারাপের দিকে মনে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।”  

পিরিয়ডে কাপড় বাদ দিয়ে নানা বয়সী নারীর স্যানিটারি ন্যাপকিনে অভ্যস্ত হওয়ার কথা জানালেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের হবিগঞ্জের সদরের ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট (পরিবার কল্যাণ সহকারী) কনিকা রাণী বিশ্বাস।তবে ‘সঠিক উপায়ে’ প্যাড ব্যবহারে বিশেষ করে কিশোরীরা এখনও সচেতন নয় বলে মন্তব্য করেন  এই মাঠকর্মী। 

কনিকা রাণী বিশ্বাস বলেন, “আমরা তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেই এবং খোলামেলা কথা বলি। এমন কয়েকবার কথা বলার পরে তারা স্বাভাবিক হয় এবং কোনো সমস্যা হলে খোলামেলা কথা বলে।”

এসবে এলাকাবাসীর সহায়তা তো মেলেই, এছাড়াও বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনমাফিক পরামর্শ দেওয়া হয়, বলেন তিনি।

যাদের এখনও কাপড় ব্যবহার করতে হয় তাদের বেলায় চিকিৎসক লিন্ডার পরামর্শ, কাপড় কড়া রোদে শুকাতে হবে। এতে করে জীবাণু ধ্বংস হয়।

“নানী-দাদীরা যেভাবে কাপড় ব্যবহার করতেন সেরকম করে কোনোভাবেই কাপড় ব্যবহার করা যাবে না।”

টিস্যু ও তুলা দিয়ে নিজেরা ন্যাপকিন বানালে তা কোনো ল্যাব পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে না গেলে এসব প্যাড ব্যবহারেও স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখছেন লিন্ডা সমদ্দর।  

এছাড়াও কেউ যদি মেনসট্রুয়াল কাপ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রেও তাকে যথাযথ পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে হবে।   

অনেকে অতিরিক্ত রক্তপাত ঠেকাতে একসঙ্গে একাধিক প্যাড ব্যবহার করে থাকেন; যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানালেন বিজিএমই হাসপাতালের ফ্যামিলি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ লিন্ডা।  

“এক সঙ্গে একাধিক প্যাড ব্যবহার সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই একাধিক প্যাড ব্যবহার না করে প্রয়োজন হলে দুতিন ঘণ্টা পর পর প্যাড পরিবর্তন করতে হবে।”

মাসিক চলাকালে পেটে ব্যাথা হওয়ার একটি কারণ হতে পারে সংক্রমণও।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের অধ্যাপক শিখা গাঙ্গুলী বলেন, পিরিয়ডে নির্দিষ্ট সময় পর পর প্যাড বদল না করা হলে জীবাণু যোনিপথে উপরের দিকে উঠে যেতে পারে।  সাথে সাথেই কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা না দিলেও ধীরে ধীরে তা প্রকাশ পায়। অনেকের দীর্ঘ মেয়াদী তলপেট ব্যথা হয়ে থাকে।”

এ ধরনের সংক্রমণে নারীর গর্ভধারণ ঝুঁকিতে পড়বে এমনটা না বলা গেলেও এই শঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে জানাচ্ছেন শিখা গাঙ্গুলী।

“সাধারণত এটা তেমন সমস্যা করে না। তবে দুয়েকজনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটে। সংক্রমণের কারণে কারও কারও টিউমার হয়ে সন্তান ধারণে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। পিরিয়ডের সময় অপরিচ্ছন্ন থাকলে অধিকাংশ নারীরই বেশি বয়সে তলপেট ব্যথার সমস্যা দেখা দেয়।”