স্যানিটারি ন্যাপকিন: কর্মজীবী নারীরা আরও ভালো কিছু চান

মাসিকের দিনগুলোতে বাজারে প্রচলিত শোষক জেল ও সুগন্ধি সমৃদ্ধ স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে অনেকের ‘অস্বস্তি’ হওয়ায় আরও ভালো কোনো বিকল্প খোঁজার কথা বলছেন কর্মজীবী নারীদের কেউ কেউ।

আইরিন সুলতানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 June 2020, 07:26 AM
Updated : 22 June 2020, 07:26 AM

তারা বলছেন, নারীর কর্ম পরিসর বিস্তৃত হওয়ায় মাসিক ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যসম্মত, টেকসই ও সুলভ উপকরণ বের করতে বিশদ গবেষণার প্রয়োজন।

স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কি না এবিষয়ে বাংলাদেশে কোনো কার্যকর গবেষণা নেই। বিদেশের গবেষণায় স্বাস্থ্যগত ক্ষতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না মিললেও এতে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদানে স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা এসেছে।

নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরাম নামে একটি বেসরকারি সংগঠনের আহ্বায়ক মারজিয়া প্রভা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাজারে যেসব স্যানিটারি প্যাড মেলে, তাতে শরীরের জন্য ক্ষতিকর শোষক জেল ও সুগন্ধি রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে।”

মিরপুরে এক সুপার স্টোরে স্যানিটারি প্যাড কিনতে আসা এক কর্মজীবী নারীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি সাধারণত বিদেশি একটি ব্র্যান্ডের তুলার স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন। কিন্তু মহামারীর কারণে সরবরাহ না থাকায় তাকে দেশি ব্র্যান্ড ব্যবহার করতে হচ্ছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “দেশি স্যানিটারি প্যাডে জেল ও আঠালো উপাদানের কারণে খুব অস্বস্তি বোধ করি। কিছু কিছু দেশি ব্র্যান্ড প্যাডে এমন উগ্র সুগন্ধি ব্যবহার করে যে তাতে খুব খারাপ লাগে।” 

পাঁচ টাকার কয়েন দিয়ে স্যানিটারি প্যাড কেনার সুবিধা দিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি অনুষদ ও শেখ হাসিনা হলে গত ফেব্রুয়ারিতে ভেন্ডিং মেশিন বসানো হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফৌজিয়া আহমেদ পল্লী বলেন, “এর শোষণ ক্ষমতা তিন-চার ঘণ্টার জন্য ঠিক আছে। লং টার্মের জন্য এই প্যাড কার্যকরী না।”

বাংলাদেশের পণ্যের মান নির্ধারণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই বলছে, দেশের বাজারে প্রচলিত স্যানিটারি ন্যাপকিনের মান নিয়ে কোনো সমস্যা এখনও তারা পাননি।

প্রতিষ্ঠানটির উপ-পরিচালক (পাট ও বস্ত্র) নিলুফা হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বিএসটিআইয়ে স্যানিটারি প্যাডের জন্য একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে; তাতে কী কী উপাদান ব্যবহার করা যায় উল্লেখ আছে। আমাদের কাছে এসে কেউ অভিযোগ করেনি যে, কোনো শারীরিক সমস্যা হচ্ছে।”

স্বাস্থ্যসম্মত মাসিক ব্যবস্থাপনায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের কোনো ক্ষতিকর দিক আছে কিনা জানতে চাইলে সরাসরি উত্তর দিতে পারেননি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা) ডা. মোহাম্মদ শরীফও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা সরকারিভাবে এটাইতো (স্যানিটারি প্যাড) আগে দিতে পারিনি। এখন শুরু করেছি।

“এখন হাইজিন মেইনটেইন করতে গিয়ে যদি অন্য কোনো শারীরিক অসুবিধা হয়, তাহলে সেটাও নজরে আনা দরকার। আধুনিক অপশন থাকলে সেগুলো আমরা অবশ্যই দেখব আমাদের প্রোগামে।”

তবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ফ্যামিলি প্ল্যানিং- ফিল্ড সার্ভিস ডেলিভারি বিভাগের ন্যাশনাল কো-অরডিনেটর খালেদা ইয়াসমিন বলছেন, স্যানিটারি ন্যাপকিন ৬ ঘণ্টার বেশি পরে থাকা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।

বাংলাদেশের বাস্তবতা তুলে ধরে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশে ৩০-৪০ শতাংশ নারী স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করছে; বাকি নারীরা এখনও কাপড়ই ব্যবহার করছে।”

২০১৪ সালের বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেইজলাইন সার্ভে অনুযায়ী, স্কুলে পড়া মেয়েদের মাত্র ১০ শতাংশ স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে থাকে।

খালেদা ইয়াসমিন বলেন, যেসব উপাদান দিয়ে স্যানিটারি প্যাড বানানো হচ্ছে, তা অনুমোদিত হতে হবে। কোনটি কতটুকু উপযোগী বা ক্ষতিকর তা নিয়ে আরো গবেষণার জায়গা আছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর, বি) একদল বিজ্ঞানী স্কুলের মেয়েদের নিয়ে এ বিষয়ে কাজ করেছিলেন। তারা জানতে চেয়েছিলেন, কী ধরনের প্যাড মেয়েরা ব্যবহার করতে চায়।

ওই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন আইসিডিডিআর, বির এনভায়রনমেন্টাল ইন্টারভেনশন্স ইউনিটের সহকারী বিজ্ঞানি ফারহানা সুলতানা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “… স্যানিটারি প্যাড নিয়ে ওদের নেগেটিভ ফিডব্যাক ছিল, এটা র‌্যাশ-ইচিং করে।”

স্যানিটারি ন্যাপকিনের ‘বিকল্প’ হিসেবে সিলিকনের তৈরি ‘মেন্সট্রুয়াল কাপ’ ব্যবহারের জন্য প্রচার চালাচ্ছেন এনজিওকর্মী নাহিদ দিপা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, মেন্সট্রুয়াল কাপ পরে আমার পরিচিত একজন ২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়েছেন, প্যাড হলে এটা সহজে সম্ভব হয় না।

“আমি নিজেও এই লকডাউনে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে পারছি। পিরিয়ডের দিনেও… কাপ পরে সাঁতারও কেটেছি।”

বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যায় না বলে দিপা নিজে ছোট পরিসরে মেন্সট্রুয়াল কাপ আমদানি করছেন।

এনজিওকর্মী নাদিয়া সারওয়াত কাপ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পেশাগত কারণে ঘন ঘন ভ্রমণ করতে হয়। মেনস্ট্রুয়াল কাপ ভ্রমণের সময় স্বাচ্ছন্দ দেয়। … যারা বাইকার বা পাহাড়ে ওঠেন, তাদের জন্য মেনস্ট্রুয়াল কাপ সুবিধাজনক হবে।“

ধনী-গরিব মিলিয়ে বিভিন্ন দেশের ৩ হাজার ৩১৯ জন নারী ও কিশোরীর মতামত নিয়ে ৪৩টি গবেষণার ফল পর্যালোচনা করে গত বছরের জুলাই মাসে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে স্বাস্থ্য বিষয়ক জার্নাল ল্যানসেট পাবলিক হেলথ।

সেখানে বলা হয়, সিলিকনের তৈরি মেস্ট্রুয়াল কাপের স্বাস্থ্যগত সমস্যা তেমন নেই। স্যানিটারি ন্যাপকিন বা ট্যাম্পুনের মত রক্ত শুষে না নিয়ে মেনস্ট্রুয়াল কাপ তা জমিয়ে রাখে। একটি কাপ পরিষ্কার করে বার বার ব্যবহার করা যায়।