মিটফোর্ড হাসপাতালের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেছে কমিশন।
Published : 18 Apr 2024, 01:09 AM
দেশে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্মদানের হার ‘অস্বাভাবিকভাবে’ বেড়ে যাওয়ার প্রকৃত কারণ খতিয়ে দেখার পাশাপাশি এ ধরনের অস্ত্রোপচারে বিধি-নিষেধ আরোপে দ্রুত রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ চেয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
বুধবার এক বিবৃতিতে কমিশন বলেছে, “অল্প সময়ের ব্যবধানে দেশে অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। প্রয়োজন ছাড়া শিশু জন্মে অস্ত্রোপচার করা মা ও নবজাতকের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।”
বিবৃতিতে বলা হয়, গত শনিবার এক বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদ প্রতিবেদন থেকে মানবাধিকার কমিশন জানতে পারে, মিটফোর্ড হাসপাতালে সন্তান প্রসব করাতে গিয়েছিলেন রাজধানীর শ্যামপুরের এক নারী। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাকে স্বাস্থকর্মী জানায় সব স্বাভাবিক রয়েছে। পরে দায়িত্বরত চিকিৎসক তার আর্থিক অবস্থা জানতে চান এবং অস্ত্রোপাচারের নির্দেশ দেন। কিন্তু ওই নারী তার আগের দুই সন্তান স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে জানিয়ে অস্ত্রোপাচারে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
“এতে চিকিৎসক ক্ষিপ্ত হয়ে রোগীর উপর নানা প্রকার মানসিক চাপ তৈরি করেন। চিকিৎসক আপত্তিকর মন্তব্যসহ হয়রানিমূলক কথা বলার অভিযোগ উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে মুগদা নবস্বাস্থ্য নামের এক সরকারি হাসপাতালে ওই নারীর স্বাভাবিক প্রসব হয়।”
মানবাধিকার কমিশন বলছে, “যেখানে স্বাস্থ্য খাতে প্রতি বছর সরকার বিপুল পরিমাণে অর্থ ভর্তুকি দেয়, সেখানে মিটফোর্ডের (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) মত একটি স্বনামধন্য হাসপাতালে চিকিৎসক কর্তৃক সিজার করতে চাপ প্রয়োগ করার বিষয়টি কমিশনের নিকট বোধগম্য নয়।
“এরূপ সিজারিয়ান প্রসবের হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার প্রকৃত কারণ কী তা খতিয়ে দেখা এবং সিজারিয়ান প্রসবের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন মর্মে কমিশন মনে করে।”
এ অবস্থায় ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে অবহিত করতে হাসপাতালটির পরিচালককে নির্দেশনা দিয়েছে মানবাধিকার কমিশন।
এছাড়া সন্তান প্রসবে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বন্ধসহ নারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো এবং অস্ত্রোপচারে প্রসবের হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির পেছনে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবকে।
মায়ের উদর ও জরায়ুতে অস্ত্রপচার করে শিশু জন্মদানের পদ্ধতিই হল সি-সেকশন, যা সিজারিয়ান নামেও পরিচিত।
যখন প্রাকৃতিক নিয়মে সন্তান প্রসব সম্ভব হয় না, অথবা মা বা শিশুর জীবন ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি হতে পারে– সেসব ক্ষেত্রে মা বা শিশুর জীবন বাঁচাতে অথবা ভ্রূণের অস্বাভাবিকতার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা। কিন্তু গত কয়েক দশকে দেশে সি-সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ রয়েছে নানা মহলে।
২০২২ সালের বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে সিজারিয়ান বা সি- সেকশনের মাধ্যমে শিশু জন্মহার ২০১৭ সালের ৩৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৪৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।
২০২২ সালে ১২ লাখ ৬২ হাজার ৩২৪টি শিশুর জন্ম হয় বাড়িতে। সরকারি হাসপাতালে ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৪৩৮টি, বেসরকারি হাসপাতালে ১৬ লাখ ৩১ হাজার ২৫৫টি এবং বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে ৬১ হাজার ৪৮৯টি শিশুর জন্ম হয়।
এর মধ্যে ১৬ লাখ ৯ হাজার ১৫৬টি শিশুর জন্ম হয়েছে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে; সবচেয়ে বেশি ১৩ লাখ ৫৩ হাজার ৯৪২টি শিশুর জন্ম হয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে (মোট সি-সেকশনের ৮৪ শতাংশ)।
এছাড়া ২ লাখ ৩৩ হাজার ৩০টি শিশু সরকারি হাসপাতালে এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ২২ হাজার ১৩৬টি শিশু সি-সেকশনের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, সি-সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার প্রতি বছরেই বাড়ছে। ২০১১ সালে এ হার ছিল ১৮ শতাংশ, ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয় ২৪ শতাংশ, ২০১৭-১৮ সালে ৩৪ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৪৫ শতাংশে পৌঁছায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো ধরনের নিয়মনীতি না থাকায় সি-সেকশন অস্ত্রোপচার বাড়ছে। এতে নারীদের দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
জনস হপকিন্স প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন ইন গাইনোকোলজি অ্যান্ড অবস্ট্যাট্রিকস এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. সেতারা গত বছর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, সিজারিয়ান সেকশনের কারণে নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও অনেক বেড়ে যাচ্ছে। সিজারিয়ান পরবর্তী জটিলতা, হার্নিয়া, বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের হারও বেশি হচ্ছে।
তিনি বলেন, “মানুষ ভালো সেবা পেতে বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেখানেও সিজার করে দিচ্ছে। সিজারিয়ান অপারেশনের পর ইনফেকশন হচ্ছে, পুঁজ হচ্ছে। আর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের মধ্যে তাদেরকে সঠিকভাবে কাউন্সেলিং না করায় তারা ভারি জিনিসপত্র তুলছে, ফলে প্রোলাপস হচ্ছে। এছাড়া ঠিকমত খাওয়াদাওয়া না করায় আয়রন ডেফিসিয়েন্সি অ্যামিনিয়া, ক্যালসিয়াম ডেফিসিয়েন্সি হচ্ছে।”
আওয়ামী লীগের গত সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও সি সেকশন বাড়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন সময়ে।
গতবছর জানুয়ারিতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “নন-স্লাম (বস্তি নয়) এরিয়ায় সি-সেকশন ৭৭ শতাংশ, যা খুবই বেশি। কিন্তু এত বেশি হওয়ার কারণ কী? এটা হয়েছে প্রাইভেট হসপিটাল বা ক্লিনিকের জন্য। কারণ সেখানে আর্থিক বিষয় রয়েছে। কই, সরকারি হাসপাতালে তো প্রয়োজন ছাড়া সি-সেকশন করে না! সেখানে এটা ২০ শতাংশের আশপাশে।”
পুরনো খবর...
দেশে সিজারে শিশুর জন্ম ৪৫%, বেসরকারি হাসপাতালেই ৮৪%
সি-সেকশন বেশি হওয়ার কারণ কী, প্রশ্ন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর