সি-সেকশন বেশি হওয়ার কারণ কী, প্রশ্ন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

নিপোর্টের জরিপে দেখা গেছে, শহরের নন-স্লাম (বস্তি নয়) এলাকায় সি-সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার ৭৭ শতাংশ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Jan 2023, 03:51 PM
Updated : 3 Jan 2023, 03:51 PM

দেশে শহরাঞ্চলে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে ‘সিজারিয়ান সেকশন’ বা সি-সেকশনের উচ্চহার নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এর জন্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ‘ব্যবসায়িক’ মনোভাবকে দায়ী করেছেন।

মায়ের উদর ও জরায়ুতে অস্ত্রপচার করে শিশু জন্মদানের পদ্ধতিই হল সি-সেকশন। যখন প্রাকৃতিক নিয়মে সন্তান প্রসব সম্ভব হয় না, অথবা মা বা শিশুর জীবন ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি হতে পারে– সেসব ক্ষেত্রে মা বা শিশুর জীবন বাঁচাতে অথবা ভ্রূণের অস্বাভাবিকতার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা। কিন্তু গত কয়েক দশকে দেশে সি-সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ রয়েছে নানা মহলে। 

মঙ্গলবার সিরডাপ মিলনায়তনে এক সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “নন-স্লাম (বস্তি নয়) এরিয়ায় সি-সেকশন ৭৭ শতাংশ, যা খুবই বেশি। কিন্তু এত বেশি হওয়ার কারণ কী? এটা হয়েছে প্রাইভেট হসপিটাল বা ক্লিনিকের জন্য। কারণ সেখানে আর্থিক বিষয় রয়েছে। কই, সরকারি হাসপাতালে তো প্রয়োজন ছাড়া সি-সেকশন করে না! সেখানে এটা ২০ শতাংশের আশপাশে।”

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ আরবান সার্ভে (বিইউএইচএস) - ২০২১’ প্রকাশ উপলক্ষে এ সেমিনার আয়োজন করা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “ডব্লিউএইচও যেখানে সি-সেকশন সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে রাখতে বলে, সেখানে ২০২১ এর এই জরিপ অনুযায়ী, স্লাম এরিয়াও (বস্তি এলাকায়) সি-সেকশনের হার ৫৮ শতাংশ। এছাড়া শহরের অন্যান্য অঞ্চলে এই হার ৭৫ শতাংশ।”

এর আগে ২০০৬ ও ২০১৩ সালেও ‘আরবান হেলথ সার্ভে’ বা শহরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা জরিপ করে নিপোর্ট। তখনকার জরিপের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, ২০২১ সালে ‘টিনএজ প্রেগন্যান্সি’ (কিশোরীদের গর্ভধারণ) এবং মাতৃত্বের হার বস্তি এলাকায় ২২ শতাংশ, নন-স্লাম এলাকায় এই হার ২০ শতাংশ এবং শহরের অন্যান্য জায়গায় তা ১১ শতাংশ।

২০১৩ ও ২০০৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, যথাক্রমে বস্তিতে এই হার ২১ ও ২১ শতাংশ, নন-স্লামে ১৩ ও ১১ শতাংশ এবং অন্যান্য অঞ্চলে ১৯ ও ১৬ শতাংশ ছিল।

২০২১ এর জানুয়ারি থেকে ১০ জুন পর্যন্ত দেশের ১১টি সিটি করপোরেশনের বস্তিতে এবং বস্তির বাইরে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত এই জরিপে দেখা গেছে, শুধু সি-সেকশনই বাড়েনি, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অনুসরণ করার প্রবণতাও বেড়েছে।

জরিপ অনুযায়ী, ২০২১ সালে শহরের বস্তি এলাকায় ‘কন্ট্রাসেপটিভ প্রিভ্যালেন্স রেট’ (সিপিআর) ছিলো ৭২ শতাংশ এবং শহরের অন্যান্য এলাকায় ছিলো ৬৮ শতাংশ।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অনুসরণ করার প্রবণতা বাড়ায় সন্তোষ জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “দরিদ্র জনগোষ্ঠীও আজকাল সজাগ হচ্ছে। যারা ভরণ-পোষণ এফোর্ড করতে পারে, তাদের জনসংখ্যা বেশি হলেও সরকারের ওপর চাপ পড়ে না। কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠী বাড়লে সমস্যা, কারণ তারা সরকারের ভর্তুকির ওপর নির্ভরশীল।

“জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিতে ধনী-গরীব প্রায় কাছাকাছি চলে আসছে, যা ভালো লক্ষণ। বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যাপারেও এগিয়েছি। যারা বস্তিতে থাকে তারা ৯৭ শতাংশ আর অন্যরা ৯৮ শতাংশ, প্রায় সমান সংখ্যক মানুষ বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও একই সমতা মেইনটেইন করেছি। সরকার দিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু প্রপার স্যানিটেশনে আমরা পিছিয়ে আছি। কারণ সরকার তো ঘরবাড়ি করে দেয় না।”

মন্ত্রী বলেন, “বিগত বছরের তুলনায় অনেককিছু ভালো হয়েছে। ২০০৬, ২০১৩ এবং ২০২১ সাল তুলনা করলে দেখা যায়, সবক্ষেত্রে ইমপ্রুভমেন্ট হয়েছে সেটা সরকারের সফলতা। আসলে অপজিশন সমালোচনা করতে পারে, কিন্তু পরিসংখ্যান তো মিথ্যা হতে পারে না।”

এ ধরনের জরিপের গুরুত্ব তুলে ধরে জাহিদ মালেক জানান, “যে কোনো জরিপই খুব প্রয়োজন। জরিপের পর ডেটা আসে, যা একটা চিত্র তুলে ধরে যে কতটুকু কাজ করেছি, কতটুকু করতে পারিনি। তখন চিত্র ধরে আমরা পদক্ষেপ নিতে পারি, স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে পারি।”

জীবিকার সন্ধানে গ্রাম থেকে ঢাকায় পাড়ি জমানো মানুষদের ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, “মাইগ্রেশন আরেক সমস্যা। ঢাকা শহরে পা ফেলার জায়গা থাকে না। সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা গ্রামকে শহর বানাব। সেজন্য গ্রামে ধীরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্পায়ন সব হচ্ছে। সেজন্যই আজ ২০ শতাংশের কাছাকাছি মাইগ্রেশান কমে গেছে। বস্তিতে তো প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে।”

অন্যদের মধ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর একেএম নুরুন্নবী, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. টিটু মিয়া, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মেডিকেল এডুকেশন ও ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ডিভিশনের সচিব মো. সাইফুল হাসান বাদল, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, নিপোর্ট-এর পরিচালক জেনারেল মো. শাহজাহান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।

আরও পড়ুন

অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশন বন্ধ হবে কবে?

একজন মায়ের মনের জোর আর স্বাভাবিক প্রসবের গল্প

'স্বাভাবিক প্রসব কি ইতিহাস হতে যাচ্ছে'

‘সিজারিয়ান’ কমাতে ছয় মাসের মধ্যে নীতিমালা চায় হাই কোর্ট