মেনস্ট্রুয়াল কাপে ‘স্বস্তির সঙ্গে সাশ্রয়’

টেম্পুন থেকে সরে এসে কাপ ব্যবহার শুরু করতেই পিরিয়ড নিয়ে ‘ধারণাই বদলে যায়’ সালোমি গোমেজ-উপেগির; সেই সঙ্গে খরচ বেঁচে যাওয়া তো রয়েছেই।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Sept 2020, 01:47 PM
Updated : 4 Sept 2020, 01:47 PM

কলম্বিয়ান-আমেরিকান এই লেখিকা তার মাসিকের দিনগুলোকে মেনস্ট্রুয়াল কাপ কীভাবে স্বতঃস্ফূর্ত করেছে, তার বিস্তারিত তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে।

তিনি লিখেছেন, কয়েক বছর আগে বান্ধবীদের সঙ্গে রাতের খাবার খাওয়ার সময় হঠাৎ একজন মেনস্ট্রুয়াল কাপের প্রসঙ্গ তোলেন। অনেক দিন ধরেই এই কাপ ব্যবহার করছিলেন তিনি। ছোট এই পণ্যটি কীভাবে তার জীবনকে ‘বদলে দিয়েছে’, সে কথা উচ্ছ্বাস নিয়ে বলছিলেন তিনি।

এর আগে মেনস্ট্রুয়াল কাপ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না সালোমি গোমেজ-উপেগির।

“কিন্তু ওর উৎসাহ আমাকেও আগ্রহী করে তুলল। একটা মেনস্ট্রুয়াল কাপ বার বার ব্যবহার করা যায়। মেডিকেল-গ্রেড সিলিকন দিয়ে তৈরি এই কাপ পিরিয়ডের রক্তকে ধারণ করে। আমার অবশ্য শুরুতে সংকোচ ছিল বেশ। কারণ অনেকের মত আমাকেও শেখানো হয়েছিল, পিরিয়ড খুবই নোংরা একটি বিষয়; এমনকি জঘন্যও। আমার বান্ধবী অবশ্য এর সাফাই গেয়েই চলছিল; আর তাতেই আমি উৎসাহ পাই।”

কিছু দিন অনলাইন ঘেঁটে নিজের জন্য কোন মাপের কাপ প্রয়োজন সে বিষয়ে ধারণা নেন সালোমি গোমেজ-উপেগি।

“আমি মাঝারি আকারের একটা কাপ কিনে আনি। ওটা ঠিকমতোই ভেতরে বসেছিল। কাপের ব্যবহারটা টেম্পুনের মতোই; তবে এটা শরীরের ভেতরে ঢোকানোর আগে ভাঁজ করে নিতে হয়। আমার কাপের অভিজ্ঞতা টেম্পুনের মতো ছিল না। পিরিয়ডের সময় ১২ ঘণ্টাও আমি এর কথা ভুলে থাকতে পারতাম। শুধু সকালে আর রাতে কাপ খালি করতে হত। মাসে একবার কাপটি বিশুদ্ধ করার জন্য সাবান আর গরম পানিই যথেষ্ট ছিল। এর মধ্যে চার বছর হয়ে গেছে, আমি ওই একটি কাপই ব্যবহার করে আসছি।”

তিনি লিখেছেন, মেনস্ট্রুয়াল কাপে অভ্যস্ত হওয়াটা তার ধারণার চেয়েও সহজ ছিল।

“আর এই সময়েই উপলব্ধি করলাম, বেশ খানিকটা খরচও বাঁচাতে পারছি আমি। পিরিয়ডকালে ব্যবহারে পণ্য কেনার জন্য খরচের বিষয়টা এর আগে এভাবে ভেবে দেখিনি। কারণ আমাকে প্রতি মাসে পিরিয়ডের পণ্য কিনতেই হত। এখন আধুনিক প্যাড-টেম্পুনের পাশাপাশি মেনস্ট্রুয়াল কাপও মিলছে। আমি কেন আরও আগে এই কাপ ব্যবহার করলাম না?”

নারী অধিকার কর্মী সালোমি গোমেজ-উপেগি বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে নারী স্বাস্থ্য খাতের বাণিজ্য ৩৭ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়ে যাবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই; কারণ প্রত্যেক নারীকে তার সারা জীবনে পাঁচ হাজার থেকে ১৫ হাজার মেনস্ট্রুয়াল প্যাড ও টেম্পুন ব্যবহার করতে হয়।

এসব পণ্যের কিছু সুবিধা অবশ্যই রয়েছে। এগুলো মেয়েদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব পণ্য নারীদের জন্য বিশাল স্বাধীনতাও এনেছে।

নারীর স্বাধীনতা ও উন্নয়নের জন্য গঠিত প্ল্যাটফর্ম ‘মাইন্ডফুল ফেমিনিজম’-এর প্রতিষ্ঠাতা সালোমি গোমেজ-উপেগি লিখেছেন, শত শত বছর ধরে নানা কিছু ব্যবহার করে মাসিকের দিনগুলো পার করেছেন নারীরা। কেউ কেউ পুরনো পাপোশের ব্যবহার করেছেন, অনেকে উল অথবা কাপড় ব্যবহার করেছেন। এই সব অতি সাধারণ ব্যবস্থার কারণে পিরিয়ডের দিনগুলোতে নারীরা সামাজিক জীবন থেকে নিজেদের সরিয়েই রাখতেন।

বিংশ শতাব্দির আগে এসবে একটু একটু করে পরিবর্তন আসা শুরু করে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় নার্সরা দেখলেন, ব্যান্ডেজের জন্য যে তুলা ব্যবহার করা হয় তা দিয়ে খুব ভালো স্যানিটারি ন্যাপকিন বানানো যায়। ১৯২১ সালে আমেরিকানদের আলমারির তাকে কোটেক্স ব্র্যান্ড দেখা যায়; স্যানিটারির প্যাডের ওটাই ছিল প্রথম বাণিজ্যিক পণ্য। এর এক দশক পর বাজারে ট্যামপ্যাক্স ব্র্যান্ড আসে। এরপর স্যানিটারি অ্যাপ্রোন, স্পঞ্জ ও মেনস্ট্রুয়াল কাপের মতো পণ্যও আসে, যেগুলো ততটা পরিচিত পায়নি। তবে পিরিয়ডের জন্য এই সব বাণিজ্যিক পণ্য নারীদের জীবনে মুক্তি ডেকে এনেছিল।

মেনস্ট্রুয়াল কাপের চেয়ে নারীদের কাছে টেম্পুনের ব্যবহার এগিয়ে থাকার পেছনে একটা কারণ ছিল বলে মনে করেন সালোমি গোমেজ-উপেগি।

“ব্র্যান্ডগুলো এটা বুঝিয়েছিল যে, পিরিয়ড গোপনীয় ও লজ্জাজনক একটি বিষয়। ‘ক্যাপিটালাইজিং অন দ্য কার্স: দ্য বিজনেস অফ মেনস্ট্রুয়েশন’ বইয়ে এর লেখক এলিজাবেথ কিসলিং লিখেছেন সেসব কথা, বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় পিরিয়ডের পণ্যগুলো যেন সহজে অন্য কারো কাছে বোঝা না যায়। এসব পণ্য ভাজহীন প্যাকেটে দেওয়া হয়, যেন নিঃশব্দে প্যাকেট খোলা যায়। মেনস্ট্রুয়াল কাপ শরীরের সঙ্গে অন্য রকম এক সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিসলিং বলেন, শরীরে ঢোকানোর সময় নারীকে তার জননাঙ্গ স্পর্শ করতে হয়; এমনকি নিজের পিরিয়ডের রক্তও।”

নিজের শরীরের সঙ্গে এই অন্তরঙ্গতা তার জন্যও শিক্ষনীয় ছিল জানিয়ে সালোমি গোমেজ-উপেগি লিখেছেন, “ফেলে দেওয়ার সময় পিরিয়ডের রক্তের রঙ আর পরিমাণ দেখে আমি নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক কিছুই বুঝতে শুরু করি; আগে এসব জানায় আমি গুরুত্ব দেইনি। তাছাড়া এর আগে যেসব পণ্য ব্যবহার করেছি তাতে এ ধারণা তৈরি হওয়ার সুযোগও ঘটেনি।

“আসলে নিজের শরীরের ভেতরের প্রক্রিয়াগুলোকে জানার মধ্যে কোনো ধরনের লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।”

মেনস্ট্রুয়াল কাপে অভ্যস্ত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত কত খরচ বাঁচিয়েছেন তারও একটি হিসাব দিয়েছেন লেখিকা।

চার বছর আগে যে কাপটা তিনি কিনেছিলেন সেটার দাম পড়েছিল ২৫ ডলার। তার আগে টক্সিক মুক্ত টেম্পুন আর প্যাড কিনতে প্রতি মাসে ২০ ডলার খরচ হত তার।

“এই খরচ আমার জন্য খুব বেশি ছিল। আবার এর থেকে সস্তা পণ্যও ছিল; তাতে ১০ ডলারের মত খরচ হত প্রতি মাসে। মেনস্ট্রুয়াল কাপ কিন্তু এর থেকে সস্তা পড়ছে আমার জন্য। 

“আমি অংক কষে দেখলাম, কাপের আয়ুকাল ১০ বছরে আমি নিশ্চিতভাবে এক হাজার ডলারেরও বেশি বাঁচাতে পারব।”

সালোমি গোমেজ-উপেগি লিখেছেন, নারী স্বাস্থ্যের পণ্য বিক্রি করা ব্র্যান্ডগুলো, বিশেষ করে যারা প্যাড ও টেম্পুন বিক্রি করে তারা এই বার্তার ওপর নির্ভর করে যে, পিরিয়ডে নারীরা শুধু তাদের পণ্যই ব্যবহার করবে; বিকল্প যা কিছু আছে তার সবগুলোই ‘অস্বস্তিকর’।

“আমি অবশ্য বুঝতে পেরেছি লজ্জা কাটিয়ে কী করে স্বস্তি আর মুক্তি খুঁজে পেতে পারি পিরিয়ডের দিনগুলোতেও।”