বিআরটি প্রকল্প: দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ, জীবনেরও ঝুঁকি

চার বছরের কাজ ১০ বছরেও শেষ না হওয়ায় বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন একের পর এক দুর্ঘটনা সড়কে চলাচলকারীদের মধ্যেও আতঙ্ক ধরিয়েছে।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2022, 09:46 AM
Updated : 16 August 2022, 09:46 AM

যানজট কমানোর আশা দেখিয়ে যে কাজ শুরু হয়েছিল, চার বছরের কাজ ১০ বছরেও শেষ না হওয়ায় সেই বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে চলাচলকারীদের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একের পর এক দুর্ঘটনায়ও আলোচনায় আসছে এই প্রকল্পটি; তার সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে সোমবার, যাতে একটি গার্ডার তোলার সময় তার নিচে চাপা পড়ে একটি প্রাইভেটকারের পাঁচজন আরোহী নিহত হন। এর আগেও এখানে গার্ডার দুর্ঘটনা ঘটেছিল দুটি, যাতে একজন নিহত হন।

গত এক দশকে এরকম বড় দুর্ঘটনা তিনটি ঘটলেও এ সড়কে দুর্ভোগ নিত্য দিনের সঙ্গী। চলাচলকারীরা বলছেন, এরকম দুর্ঘটনা দেখে পথ চলতে আতঙ্ক বোধ করছেন তারা।

এই প্রকল্পে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ রয়েছে শুরু থেকেই। মঙ্গলবার ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে বিআরটি প্রকল্পের সব ধরনের কাজ আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।

তিনি বলেছেন, এ প্রকল্পের কাজ চলার সময় নিরাপত্তার যেসব ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি।

“ফলে কিছু দিন পরপরই দুর্ঘটনা ঘটছে। জনদুর্ভোগ বাড়ছে। এভাবে উন্নয়ন কাজ চলতে দেওয়া যাবে না। আগে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।”

অন্যদিকে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন,দুর্ভোগ আর অব্যবস্থাপনার বিষয়টি সবারই জানা। কিন্তু প্রকল্পের মাঝপথে ঠিকাদার বাদ দিলে নতুন সমস্যা তৈরি হবে। এই যুক্তিতে তাদের দিয়েই কাজটি শেষ করতে চাইছে ঢাকা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি।

‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্পের (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) আওতায় প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে গাজীপুর থেকে শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ উত্তরা হাউজ বিল্ডিং হতে টঙ্গী চেরাগ আলী মার্কেট পর্যন্ত এলাকার সড়কের কাজ করছে। বাকিটা হচ্ছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে।

চীনের তিনটি এবং বাংলাদেশের একটি কোম্পানি এই প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে। এর মধ্যে উড়াল সড়ক ও নিচের সড়ক নির্মাণের কাজ পেয়েছে চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশন (সিজিজিসি), জিয়াংশু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ এবং ওয়েহেই ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো–পারেটিভ। আর গাজীপুরে বিআরটির ডিপো নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে দেশীয় কোম্পানি সেল-ইউডিসি।

সোমবার উত্তরার যে এলাকায় ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই অংশের বিআরটির কাজ করছে ঠিকাদার কোম্পানি সিজিজিসি। ওই ঘটনায় নিহতদের পরিবারের দায়ের করা মামলায় সিজিজিসি কর্তৃপক্ষকেও আসামি করা হয়েছে।

বিআরটি প্রকল্পের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বিআরটি বাস্তবায়িত হলে ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাসের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ২৫ হাজার মানুষ যাতায়াত করবে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট অনেকটাই কমে যাবে।

প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন হয় ২০১২ সালে। প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত পুরো প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৬৫ শতাংশের বেশি।

প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা যে উত্তরা, টঙ্গীর বাসিন্দা এবং গাজীপুর ও ময়মনসিংহগামীদের কতটা দুর্ভোগ দিচ্ছে, তা গত ১০ অগাস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের একটি বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট।

সেদিন, পুলিশের (ট্রাফিক) উত্তরা বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চলমান বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি প্রকল্পের কাজের কারণে কয়েকটি লেইনে গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে। রাস্তা সরু হয়ে যাওয়ায় সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

এ অবস্থায় বিমানবন্দরগামী যাত্রীদের ‘অতিরিক্ত সময় নিয়ে’ যাত্রা শুরুর অনুরোধ করে পুলিশ। এছাড়া খিলক্ষেত হয়ে উত্তরা ও গাজীপুরের যাত্রীদের পর্যাপ্ত সময় হাতে নিয়ে চলাচল করতে বলা হয়।

উত্তরার বাসিন্দা চিকিৎসক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ এই প্রকল্পের কারণে নিয়মিত ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর মতো এত বাজে প্রজেক্ট আর আছে কি না, আমার জানা নেই। রাস্তার মাঝখান দিয়ে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বানাচ্ছে, কিন্তু দুপাশের রাস্তা এত সরু করেছে যে অন্য যানবাহন চলতে পারে না। আগে কাজ চলছিল তখনও জ্যাম ছিল। এখন কাজ শেষের দিকে, জ্যাম যেন আরও বাড়ছে।”

উত্তরার বাউনিয়া থেকে প্রতিদিন ফার্মগেইট যাতায়াত করেন গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মেহের নিগার মাহজাবিন।

যাতায়াতে ভোগান্তি নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিআরটির কাজ চলার কারণে রাস্তার একদিকে বন্ধ থাকে। চলাচলের রাস্তা সংকীর্ণ, আর উঁচুনিচু, ফলে বাসগুলো চলাচলের সময় অনেকটাই হেলে যায়।

“অনেক সময় জ্যামে আটকা পড়লে বাসের ওই হেলান অবস্থাতেই থাকতে হয়। এটা খুবই বিপজ্জনক। কিছুদিন আগে এয়ারপোর্ট রোডেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। সেখানে কাজ চলছিল, হঠাৎ করেই একটা স্প্যানের অর্ধেক খুলে গিয়ে নিচে পড়েছিল। সেটা অল্পের জন্য আমাদের বাসের উপর পড়েনি।”

উত্তরা ইউনিভার্সিটির জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রদীপ্ত মোবারক নিয়মিত বনানী থেকে উত্তরায় যাওয়া-আসা করেন।

তিনি বলেন, বনানী থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ভালোভাবেই আসা যায়। এয়ারপোর্ট থেকে উত্তরা হাউজ পর্যন্ত একটা রাস্তার দুই পাশেই খুঁড়ে রেখেছে। ফলে ভোগান্তি হচ্ছে।

“আমি এতটুকু বলতে পারি, এখানে পরিকল্পনামাফিক কোনো কাজ হচ্ছে না। ঢাকার বাইরে অন্যান্য এলাকায় যেতে অনেক ক্ষেত্রে এই রাস্তাটাই একমাত্র ওয়ে। অথচ মানুষ প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই রাস্তাটা দিয়ে যাচ্ছে। কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই।”

উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা আফরিন সিদ্দিকী প্রতিদিন ঢাকায় মতিঝিলে আসেন চাকরির কারণে। তার ভাষায়, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ও এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মাণের কারণে উত্তরা থেকে ঢাকায় আসতে হয় ‘প্রাণটাকে হাতে নিয়ে’।

সোমবারের দুর্ঘটনা নিয়ে তিনি বলেন, “আজকের ওই দুর্ঘটনার পর আমি আপসেট। গত পরশু আমি নিজেই জসীম উদদীন সড়ক দিয়ে মতিঝিল যাওয়ার সময়ে দেখলাম ওই গার্ডারগুলো। রাস্তা দিয়ে একের পর এক গাড়ি চলছে। আবার অন্যদিকে গার্ডার তোলার দৃশ্য। ভয় লেগেছে দেখে।”

উত্তরার বাসিন্দা আনিতা শারমিন মিম সোমবার দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই সেই পথে বাসে এসেছিলেন।

আতঙ্কিত কণ্ঠে তিনি বলেন, “ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই আমি বাসে সেই রাস্তা দিয়ে এসেছি। বাসায় এসেই শুনলাম এই ঘটনা। এটা তো আমার সাথেও ঘটতে পারত। আমাদের জীবন কতটা অনিশ্চিত।”

এই প্রকল্পের কাজ চলার মধ্যে মানুষের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মুহা. শফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে পুলিশের কোনো ভূমিকা নেই।

“তবে পথ চলতে গিয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি যেন না হয়, সে বিষয়টি আমরা দেখে থাকি। পরামর্শ দেই, সহযোগিতা করি।”

বিআরটি প্রকল্পটিতে শুরু থেকেই নানা ‘অব্যবস্থাপনা’ ছিল বলেই এটি মানুষকে ভোগান্তি দিয়ে আসছে বলে মনে করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রকল্পের শুরুতেই অর্থায়ন করতে অনেক সময় লেগেছে, প্রাক-সমীক্ষা দুর্বল ছিল, ঢাকা এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে প্রকল্পের বিষয়ে কোনো পরামর্শ না করায় তাদের কাছ থেকেও সহায়তা পায়নি।

তিনি বলেন, “প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় পরিকল্পনা কমিশন জননিরাপত্তা এবং জনদুর্ভোগ মোকাবেলার জন্য আলাদা খরচ দেওয়ার পরও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নেওয়া হয়নি। একটা গার্ডার পরিবহন করার সময় পাশের যানবাহন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি।

“এর মানে হল আগে একজন নিরাপত্তাকর্মী মারা গেছেন, একজন দোকানকর্মী আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনাগুলোর কোনো শাস্তি হয়নি। ফলে তারা এত নির্লিপ্ত হয়েছে, এতটা অবহেলা করার সাহস করেছে। এই মৃত্যুটাকে আমি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড বলব।”

এত সব অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করলে কোম্পানির পরিচালক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী একেএম মনির হোসেন পাঠান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যেসব অনিয়ম হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে সব সময়ই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

“এসব বিষয় প্রকল্পের অর্থদাতা এডিবিও জানে, প্লানিং কমিশনও জানে। বিষয়টি সবাই জানে। তাদের সঙ্গে বহুবার মিটিং হয়েছে, এসব কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারকে টার্মিনেট করে নতুন করে কাজ শুরু করতে গেলে আরেকটা সমস্যার সৃষ্টি হবে। এজন্য তাদের দিয়েই কাজটা শেষ করার চিন্তা করা হয়েছিল।”

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে প্রকল্প পরিচালক মো. মহিরুল ইসলাম খানকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।