এক বিআরটিতেই বারবার গার্ডার দুর্ঘটনা

১০ বছর আগে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ঘটেছিল প্রথম গার্ডার দুর্ঘটনা। এরপর বিআরটি প্রকল্পেই ঘটে দুটি দুর্ঘটনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 August 2022, 04:59 PM
Updated : 15 August 2022, 04:59 PM

নির্মাণকাজে নিরাপত্তার অভাবে আর অবহেলায় এর আগেও বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। সর্বশেষ ঢাকার উত্তরায় বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের ক্রেন থেকে প্রাইভেটকারের উপর গার্ডার পড়ে নিহত হয়েছেন এক পরিবারের ৫ জন।

জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতার অভাবই এই ধরনের দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে মনে করেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই দুর্ঘটনা নতুন নয়। ২০১৯ থেকে বিভিন্ন সময়ে এখানে দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। তারপরেও নিয়োগ দেওয়া আন্তর্জাতিকমানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কোন দায়ভার নিতে হয়নি। কোনো জবাবদিহিতার মধ্যেও তারা আসেননি।”

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, “যে কোনো প্রকল্পে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ থাকে, কিন্তু বিআরটির প্রকল্পে ন্যূনতম কোনো স্ট্যান্ডার্ড মানা হয় কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে।”

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের বিআরটি প্রকল্পটিতে ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে চীনের চারটি প্রতিষ্ঠান।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, কোনো ভারী নির্মাণ সামগ্রী নিয়ন্ত্রণ করার প্রশ্ন আসে, সেখানে অবশ্যই কোনো না কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনির ব্যবস্থা থাকতে হয়।

”ক্রেইন থেকে গার্ডার পড়ে যেতেই পারে, এটা একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি যেন না ঘটে, সেই প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে নজরদারির যথেষ্ট অবহেলা ছিল বিধায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।”

উত্তরার ১০ বছর আগে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ঘটেছিল প্রথম গার্ডার দুর্ঘটনা। এরপর বিআরটি প্রকল্পেই ঘটে দুটি দুর্ঘটনা। উত্তরারটি মিলিয়ে তিনটি হল।

বিআরটি প্রকল্প, ১৪ মার্চ ২০২১

২০২১ সালের ১৪ মার্চ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় বিআরটি প্রকল্পের একটি গার্ডার লঞ্চার ভেঙে তিন চীনা কর্মীসহ ৬ জন আহত হন।

এরপর দুই মাসের বেশি সময় পড়ে থাকার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় ওই পথে চলাচলকারীদের। ওই বছরের ১৮ জুন ক্রেইনটি মেরামত করে সচল করার খবর দেয় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।

বিআরটি প্রকল্প, ১৫ জুলাই ২০২২

গত ১৫ জুলাই গাজীপুরে বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ‘লঞ্চিং গার্ডার’ চাপায় প্রকল্পটির এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। ওই ঘটনায় আরও আরেক শ্রমিক ও একজন পথচারী আহত হন।

ওইদিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে জেলার চান্দনা চৌরাস্তার কে চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি ফিলিং স্টেশনের সামনে এ ঘটনা ঘটে।

ওইসময় পুলিশ জানায়, লঞ্চিং গার্ডার দিয়ে গার্ডার টেইলার গাড়িতে উঠানো হচ্ছিল। এ সময় গার্ডারটি টেইলার থেকে কাত হয়ে নিরাপত্তাকর্মী জিয়াউর রহমানের উপর পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।

বিআরটি প্রকল্প, ১৫ অগাস্ট ২০২২

উত্তরায় এবার একটি গার্ডার ক্রেন দিয়ে ট্রেইলারে তোলার সময় তা কাত হয়ে পড়ে। তাতে চাপা পড়া প্রাইভেটকার থেকে এক পরিবারের পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। আহত অবস্থায় উদ্ধার হন দুজন। কোবেলকো ৭০৮০ মডেলের যে ক্রেইনটি গার্ডারটি উঠানো হচ্ছিল, তার সর্বোচ্চ উঁচু করার ক্ষমতা ৮০ টন। ক্রেইনটি ৫০ টন ওজনের প্রিকাস্ট সেগমেন্টাল বক্স গার্ডারের সরাচ্ছিল।

উত্তরায় গার্ডার চাপার ঘটনায় দায় কাদের, তা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বের করার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, “যেহেতু আমরা দেখেছি ক্রেইনটি একদিকে হেলে গিয়েছিল, এক্ষেত্রে যিনি এই ক্রেইনটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন, তার অভিজ্ঞতা কতটুকু এবং তার যথাযথ লাইসেন্স আছে কিনা, সেই বিষয়টিও তদন্ত করে দেখা উচিৎ।”

চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট

২০১২ সালে দুদফায় চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে পড়েছিল। প্রথমবার ওই বছরের ২৯ জুন সেখানে ১৩০ ফুট দীর্ঘ কংক্রিটের গার্ডার ভেঙে পড়ে একজন রিকশাচালক আহত হয়েছিলেন।

এরপর ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ওই ফ্লাইওভারেরই তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ে অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় আহত হয়েছিলেন আরও অনেকে।

কয়েক মাস আগে ছোট দুর্ঘটনার পরও যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান নেয়নি বলে তখন অভিযোগ উঠেছিল।

ওই সময় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী, নির্মাণকাজে জড়িত মীর আক্তার অ্যান্ড পারিশা ট্রেড সিস্টেমসের (যৌথ মালিকানা) কর্মকর্তাসহ মোট ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। তবে সেই মামলার বিচার এখনও শেষ হয়নি।

মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার

২০১৭ সালের ১২ মার্চ দিবাগত রাতে ঢাকার মালিবাগ রেলগেইট এলাকায় নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ৩৬ মিটার দীর্ঘ গার্ডার ভেঙে পড়ে।

রেললাইনের উপর ওই ঘটনায় একজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় আরও একটি করে পা হারান আরও ২ জন।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার প্রকল্পের নির্মাণের দায়িত্ব ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন। ওই দুর্ঘটনার পর হতাহতের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেছিল ‘চিলড্রেনস চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নামক মানবাধিকার সংগঠন।