বছরের পর বছর আন্দোলন করলেও কেউ শুনছে না রানা প্লাজা ধসে আহতদের কথা।
Published : 24 Apr 2025, 11:39 AM
সাভারের রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক হতাহতের এক যুগ পেরোলেও জড়িতদের শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ওই ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করা শিলা বেগম।
সেদিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেছেন, “২৩ তারিখ বিল্ডিংয়ে ফাটল দেখা দেয়। একজন ইঞ্জিনিয়ার এসে বলেন, ‘ভবন ঝুঁকিপূর্ণ’। ব্যানার, তালা লাগিয়ে যায়। কিন্তু রানা এবং গার্মেন্টস মালিকরা জোর করে কাজে আসার জন্য। না আসলে দুই মাসের বেতন আটকে রাখবে বলে হুমকি দেয়।
“ভয় দেখিয়ে ২৪ এপ্রিল সকাল ৮ টার আমাদের কাজে ঢুকায়। তাদের কারণে এতোগুলো মানুষ প্রাণ হারাল, আর এতোগুলো মানুষ পঙ্গু হয়ে গেল। অথচ তাদের শাস্তি হয়নি। তাদের সাজা হোক যত দ্রুত সম্ভব।”
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আটতলা রানা প্লাজা ধসে নিহত হন এক হাজার ১৩৫ জন; প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় আরও হাজারখানেক তৈরি পোশাক শ্রমিককে। তদের মধ্যে পঙ্গুত্ব বরণ করেন ৭৮ জন, যাদের একজন শিলা।
বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া সেই ঘটনার সময় এ শ্রমিক কাজ করছিলেন রানা প্লাজার ষষ্ঠ তলায়, ইথার টেক্সটাইল গার্মেন্টসে।
নিজের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে শিলা জানালেন, তার দাম্পত্য জীবন ভালোই কাটছিল। হঠাৎ করে এক সড়ক দুর্ঘটনা তার জীবন ওলট পালট করে দেয়। ওই দুর্ঘটনায় স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই বছরের মেয়েসহ শিলাকে বাড়িছাড়া করে শ্বশুড়বাড়ির লোকজন।
এরপর তিনি চলে আসেন বাবার বাড়িতে। জীবিকার তাগিদে ২০১০ সালে বরিশাল সদর থেকে পাড়ি জমান ঢাকার সাভারে। রানা প্লাজা ধসের ১৮ ঘণ্টা পর গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তাকে।
শিলা বলছিলেন, “ডান হাতের রগ কেটে আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছি। পেটে বিম পড়ে নাড়িভুড়ি বের হয়ে গেছে। মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। সাপোর্ট নিয়ে চলতে হয়। এতো যন্ত্রণা নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি।”
একদিকে নিজে কর্মক্ষমতা হারানো আর অন্যদিকে মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কঠিন দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে সাভারে অবস্থানরত শিলার।
“শ্বশুরবাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর উঠি বাবার বাড়ি। অনেক ভাই-বোন। অভাবের সংসার। ঢাকা চলে আসি বোনের সাথে। মেয়েটা গ্রামে থাকে। ফাইভে, এইটে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। এসএসসি পরীক্ষার সময় অসুস্থ ছিল, ৪.৫০ পায়। ইন্টারে জিপিএ-৫ পেয়েছে। টাকার অভাবে কোথাও ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াতে পারিনি। বরিশাল মহিলা কলেজে পড়তো।
“অনার্স ফাস্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার শেষ করছে। থার্ড ইয়ারের বই-খাতা কিনে দিতে পারিনি। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে আছে।”
সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, “নিজে তো চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পড়ে আছি। খেয়ে না খেয়ে সময় যাচ্ছে।
“কেউ সহযোগিতা করলে মেয়েটাকে ঢাকা ট্রান্সফার করে নিয়ে আসতাম। মেয়েটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো, বড় অফিসার হবে- তা তো শেষ হয়ে গেল।”
এতো বছরেও সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাননি দাবি করে শিলা বলেন, “আমাদের এক জীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। আজীবন সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। আর ভবনটা পড়ে আছে।
“সেখানে শ্রমিকদের পুনর্বাসন করে কিছু করে খাওয়ার মত সুযোগ করে দিক সরকার। আর যদি কোনো পদক্ষেপ না নেয়, ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আমরণ অনশনে বসব।”
‘আন্দোলন করে যাচ্ছি, কেউ কথা শোনে না’
রানা প্লাজা ধসে যে ৭৮ জন পঙ্গুত্ব বরণ করেন, তাদের একজন ইয়ানুর। ঘটনার সময় তার বয়স ছিল ১৩ বছর।
ভবন ধসে ইয়ানুর প্রাণে বেঁচে গেলেও হাঁটার শক্তি হারিয়েছেন। ইচ্ছে হলেও নিজের ছেলেকে কোলে নিতে পারেন না। সহযোগিতা করতে পারেন না স্বামীকেও।
এমন দশা নিয়ে আক্ষেপ থেকে তিনি বললেন, “আল্লাহ ক্যান যে সেদিন বাঁচায় রাখছে, মরে গেলেই ভালো হতো!”
কিশোর বয়সেই ইয়ানুর কেন গার্মেন্টে কাজ করছিলেন? তাছাড়া যে আর উপায় ছিল না। অভাবের সংসারে তিন ভাই আর তিন বোনের মধ্যে তিনি বড়। বাবার চটপটি-ফুচকা বিক্রির টাকায় সংসার চলত না। বাধ্য হয়ে মা আনোয়ারা কাজ শুরু করেন গার্মেন্টে। তাতেও না কুলায় ইয়ানুরও মায়ের পথ ধরেন।
সেদিনের কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “আমার অফিস ছিল ছয়তলায়, আর মায়েরটা সাততলায়। ২৪ এপ্রিল একসাথে যাই। এরপর তো ভবনটা ধসে পড়ে। চাকরি নেওয়ার চার মাস পর এ ঘটনা ঘটে। রাত ৩টার দিকে সেনাবাহিনী আমাকে উদ্ধার করে সিএমএইচে নিয়ে যায়।
“সেখানে একটা অপারেশন করিয়ে ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেয়। একটু জ্ঞান ছিল। সেনাবাহিনী পরিবারের নাম্বার চায়। বাবার নাম্বারের ১০টা বলতে পারছিলাম। বাকি একটা ডিজিট যোগ করে তারা আমার পরিবারকে খবর জানায়। পরে হাসপাতালে আত্মীয়-স্বজনরা যায়।”
ঘটনার দিন কয়েক পর চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেছিল জানিয়ে ইয়ানুর বলেন, “সাত দিন পর আমাকে মৃত ঘোষণা করে। কিন্তু আল্লাহ হায়াত রাখার কারণে রেসপন্স করি। আমার বাবা হাতের একটা আঙ্গুল নড়তে দেখেন।
“পরে অ্যাপোলো হাসপাতালে আড়াই মাস চিকিৎসা নিই। দুই পায়ে ছয়টা অপারেশন। ক্রাস ছাড়া হাঁটতে পারি না। পরে জানতে পারি মা মারা গেছে।”
তিনি বলেন, “মা মারা যাওয়ার পর আমরা এতিম হয়ে যাই। আমার বিয়ে হয়। বাবার বয়স হয়েছে। অসুস্থ, প্যারালাইজড। ঘরে পড়ে আছি। খুবই খারাপ অবস্থায় আছি।”
বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলা রানা প্লাজা ধসের এক যুগ পার হলেও হত্যা ও ইমারত বিধির মামলার বিচার শেষ হয়নি এক যুগেও।
রানা প্লাজা ধসের পরপর বেশ কয়েকটি মামলা হলেও এ দুটিই মূল মামলা। দুই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা কারাগারে থাকলে অধিকাংশ আসামি জামিনে বা পলাতক রয়েছেন।
এতোদিনেও বিচার না হওয়ায় খেদ প্রকাশ করে ইয়ানুর বলেন, “যাদের কারণে এতোগুলো মানুষের ক্ষতি হলো, তারা তো বুক ফুঁলিয়ে হাঁটছে। আমরা তো বিচার পেলাম না। সহযোগিতাও পেলাম না। কয়েক মাস আগে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ আমাদের ডেকে নিয়ে কথা বলেন।
“আমরা এক জীবন পরিমাণ ক্ষতিপূরণ ৪৫ লাখ টাকা দাবি করি। এরপর আর কোনো খোঁজ নাই। ১২ বছর ধরে এর জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের কথা কেউ শোনে না। আমরা আর্থিক সহযোগিতা, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন চাই।”
‘সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলায় ক্ষমতাসীনরা হামলা চালায়’
ধসে পড়া রানা প্লাজায় আটকা পড়ে মেরুদণ্ড, বুকের পাজর ভেঙে যায় শ্রমিক মাহমুদুল হাসান হৃদয়ের। তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। ১৭ দিন জ্ঞান না ফেরায় পরিবার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই হাসানকে ছেড়ে চলে যায় তার স্ত্রী।
এক যুগ আগের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “গরিব ঘরের সন্তান। এইচএসসি শেষ করেছি। বাবার একার আয়ে সংসার চলছিল না। বাধ্য হয়ে ২০১৩ সালে চাকরি নিই। রানা প্লাজার ৮ তলায় নিউ ওয়েভ টেক্সটাইলে ১০ এপ্রিল চাকরি নেয়। ২৪ এপ্রিল তো ভবনটা ভেঙে পড়ে।
“২২ ঘণ্টা আটকে ছিলাম। আমাকে সেনাবাহিনী উদ্ধার করে। মেরুদণ্ড, বুকের পাজর ভেঙে যায়। ১৭ দিন জ্ঞান ফেরেনি। বাঁচব কি না কেউ জানতো না। প্রথম স্ত্রী সেই অবস্থায় আমাকে রেখে চলে যায়। আলাদা সংসার করতেছে।”
চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার পর ২০১৬ সালে আবার বিয়ে করেন হৃদয়। তাদের সংসারে দুই ছেলে রয়েছে। ঘুরে দাঁড়াতে সাভারের ছায়াবীথি আইসক্রিম কারখানার পাশে দেন ওষুধের দোকান; সেখানেও ঘটে অঘটন।
হৃদয় বলেন, “সুস্থ হয়ে শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলি। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলি। একারণে সেখান এমপি ডা. এনাম যুবলীগ-ছাত্রলীগকে দিয়ে আমার ওপর হামলা চালায়। ২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর আমার ফার্মেসিতে গিয়ে হামলা করে। তারা আমার দুই পায়ের রগ কেটে দেয়।
“আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলেছি। দুই বছর চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসা করাতে ১৫/১৬ লাখ টাকা লেগেছে। ফার্মেমি বিক্রি করে, ধারদেনা করে চিকিৎসা করিয়েছি।”
সাবেক প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান কারাবন্দি থাকায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, “এখন আর কাজ করতে পারি না। ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর চলে এসেছি। ৯০ বছর বয়সী বাবার ওপর চেপে বসেছি। তার আর ছোট ভাইয়ের আয়ের ওপর বসে বসে খাচ্ছি।”