ক্ষোভের সঙ্গে এক স্বজন বলছিলেন, আরও আগে গাড়ির ওপর থেকে গার্ডার সরাতে পারলে হয়ত সবাইকে মরতে হত না।
Published : 16 Aug 2022, 12:48 AM
সবে বিয়ে হয়েছিল হৃদয়-রিয়ার, উৎসবের আমেজেই ছিলেন সবাই। মেয়ে পক্ষের বাড়িতে যাওয়ার সময় উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার পড়ল গাড়িতে, দুটি পরিবারের উৎসব রূপ নিল শোকের মাতমে।
নব দম্পতি গুরুতর আহত হয়ে যখন উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে কাতরাচ্ছিলেন, তখনও তাদের পারবারের পাঁচ সদস্য চাপা পড়ে ছিলেন গার্ডারের নিচে চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়া গাড়ির ভেতর।
সোমবার বিকালে উত্তরার জসীম উদ্দীন বাসস্ট্যান্ডের কাছে প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনের সড়কে ওই দুর্ঘটনার তিন ঘণ্টা পর গার্ডার সরিয়ে ওই দম্পতির পাঁচ স্বজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
রিয়ার মামা শুভ ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, “দুর্ঘটনার পর যখন আসি, তখনও উপর থেকে গার্ডার সরাতে পারলে সবাইকে মরতে হত না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মত ওদের মরতে দেখলাম।“
হৃদয় ও রিয়ার বিয়ে হয় গত শনিবার। সেদিনই দক্ষিণখান থানার কাওলায় স্বামীর বাড়িতে আসেন তিনি। রীতি অনুযায়ী তাকে আশুলিয়ার খেজুরবাগান এলাকায় বাবার বাড়িতে নিয়ে যেতে ১২ জন এসেছিলেন হৃদয়দের বাড়িতে। সেখান থেকে দুটি গাড়িতে আশুলিয়ায় ফেরার পথে ঘটে দুর্ঘটনা।
শুভ জানান, নব দম্পতির সাথে আরও পাঁচজন ছিলেন প্রাইভেট কারে। আর অন্য আত্মীয়রা মাইক্রোবাসে যাচ্ছিলেন। প্রাইভেট কারটি যখন জসীম উদ্দীন এলাকায় দুর্ঘটনায় পড়ল, তখন তাদের মাইক্রোবাস বিমানবন্দরের কাছে।
“একজন ফোন দিয়ে জানাল, সামনের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছে। কিন্তু আমাদের গাড়ি এগোতে পারছিল না, দুর্ঘটনার কারণে সামনে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা তখন গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে চলে আসি।”
ওই এলাকার একটি ভবনের সিসিটিভি ভিডিওতে দেখা যায় রাস্তার মাঝখানে সারি দিয়ে রাখা বিআরটি প্রকল্পের কংক্রিটের গার্ডার ক্রেইন দিয়ে তোলা হচ্ছিল ট্রেইলারে। এর মধ্যে ভারসাম্য হারিয়ে ক্রেন একদিকে কাত হয়ে যায়।
তখন ক্রেইনে থাকা গার্ডারটি ওই ট্রেইলারের পাশ দিয়ে টঙ্গীমুখী সড়কে চলমান একটি প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে। ভারী ওই গার্ডারের চাপে মুহূর্তের মধ্যে চ্যাপ্ট হয়ে যায় গাড়িটি।
গাড়িতে থাকা সাত জনের মধ্যে হৃদয় (২৬) ও রিয়া মনি (২১) জানালার ধারে থাকায় তাদের টেনে বের করে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো সম্ভব হলেও দুই শিশুসহ বাকি পাঁচজন ভেতরেই আটকা পড়ে থাকেন।
ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা প্রথমে গাড়ি কেটে ভেতর থেকে যাত্রীদের বের করার চেষ্টা করেন। পরে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে আরেকটি বড় ক্রেন এনে সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে গার্ডার সরিয়ে নিলে হৃদয়ের বাবা রুবেল মিয়া (৬০), রিয়ার মা ফাহিমা (৪০), খালা ঝর্না (২৮) এবং ঝর্নার দুই সন্তান জান্নাত (৬) ও জাকারিয়ার (২) লাশ উদ্ধার করা হয়।
ততক্ষণে দুই পরিবারের অনেকেই ছুটে এসেছেন ঘটনাস্থলে। তাদের কেউ চিৎকার করে কাঁদছিলেন। রিয়ার মামা শুভও ক্ষোভ ধরে রাখতে পারছিলেন না।
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, “গার্ডার আগে সরানো গেলে দুয়েকজনকে অন্তত বাঁচানো যেত। এত উন্নয়ন, তাহলে এই গার্ডার সরাতে এত সময় লাগল কেন?”
শুভ জানান, প্রাইভেট কারটি চালাচ্ছিলেন হৃদয়ের বাবা রুবেল মিয়া, ছেলে তার পাশে ছিলেন।আর পেছনে বাঁ পাশে ছিলেনহৃদয়ের স্ত্রী রিয়া, তার পাশে তার মা, খালা আর খালাতো ভাইবোন।
হৃদয়ের খালাতো ভাই রাকিব হোসেন জানান, হৃদয় একটি দোকান চালান। আর তার বাবা রুবেল মিয়া পোশাক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে।
আর রিয়া মনির বাবা আব্দুর রাজ্জাক ইটালি প্রবাসী। তার স্ত্রী ফাহিমা বেগম, ছেলে ফাহাদ আর মেয়ে রিয়া আশুলিরয়ার বাড়িতে থাকতেন।
ঝরনার স্বামী জাহিদ ছিলেন তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুরে। দুর্ঘটনায় স্ত্রী আর দুই সন্তানের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি রওয়ানা হয়েছিলেন। কিন্তু রেল স্টেশনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। রাতে আবার তাকে বাড়িতে ফেরত নেওয়া হয় বলে জানান শুভ।
এক বিআরটিতেই বারবার গার্ডার দুর্ঘটনা
গাড়ির ভেতরে থেকে পাঁচজনকে বের করতে কেন এত সময় লাগল জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঘটনার পরপরই ফায়ারসার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। কিন্তু গার্ডার সরাতে সময় লেগে যায়।
“আমাদের কাছে গার্ডার সরানোর মত ক্রেন নেই। গার্ডারটি অনেক ওজন, তার পাশ দিয়ে কেটে কোনোক্রমে তিনজনের দেহ বের করা গেলেও পুলিশের সহায়তা নিয়ে গার্ডার সরানোর পর বাকি দুইজনের দেহ বের করা হয়।”
উত্তরা এলাকায় বিআরটি’র উড়াল সড়কের কাজ চলছে সড়কের মাঝ বরাবর। সেখানে নিরাপাত্তা বেষ্টনী দিয়েই গার্ডার উঠানো-নামানো হচ্ছিল বলে দাবি করেছেন বিআরটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “গার্ডারটি পড়েছিল নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে, সুতরাং এখানে ক্রেনের ত্রুটির কারণে না চালকের..... তা তদন্ত কমিটিই বলবে।”
তবে সিসিটিভি ভিডিওর তার বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়নি। কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী ওই ভিডিওতে দেখা যায়নি। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যেই ক্রেইনের পাশ দিয়ে নিয়মিত গাড়ি যাতায়াত করছিল।
দুর্ঘটনার প্রায় তিন ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৭টা ১৩ মিনিটে আরেকটি ক্রেন এনে যখন গার্ডার সরানো হলো, তখন পাঁচটি মৃতদেহ এলোমেলো হয়ে পড়েছিল।
উত্তরা ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বলেন, “প্রথমে পেছনের আসন থেকে একজন নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরক্ষণেই একটা শিশুর, তারপর আরেক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।”
চতুর্থ মরদেহ যখন উদ্ধার করা হয়, তখন আশপাশের মানুষের চোখেও পানি চলে আসে। শিশুটির পরনে ছিল মেয়েদের পোশাক। ঝর্নার ছয় বছর বয়সী মেয়ে সন্তানের দেহ ছিল সেটি। মনে হচ্ছিল সাজানো গোছানো একটি পুতুল বের করলেন উদ্ধারকর্মীরা।