“বাসে বহুবার মৌখিক ও শারীরিক হয়রানির শিকার হয়েছি। মেট্রোর নারী কোচ আমার কাছে খুবই নিরাপদ পরিবহন”, বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কানিজ ফাতেমা।
Published : 22 Jan 2024, 10:40 PM
রোববার সকাল ১০টা। বিজয় সরণির মেট্রো স্টেশনে টিকেটের জন্য দাঁড়িয়ে আনু আক্তার। তার বাসা মোহাম্মদপুরে, শাহবাগ যাবেন বলে সোজা চলে আসেন সেখানে।
ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সকাল থেকে রাত অবধি মেট্রোরেল এই পথের পাশাপাশি আশপাশের এলাকার মানুষের যাতায়াতের অভ্যাস কীভাবে পাল্টেছে, তার উদাহরণ হতে পারেন আনু।
তিনি আগে মোহাম্মদপুর থেকে বাসে বা অন্য কোনো বাহনে শাহবাগ যেতেন। বাসা থেকে বের হতেন অফিস সময়ের বেশ আগে। এখন চলে আসেন বিজয় সরণির মেট্রো স্টেশনে। ট্রেনে চেপে ১০ মিনিটের কম সময়ে চলে যান শাহবাগে। আগের মতো হাতে এত সময় নিয়েও বের হতে হয় না।
টিকেট হাতে পেয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আনু বললেন, “মেট্রো চালুর আগে দুই ঘণ্টার বেশি সময় হাতে নিয়ে বের হতাম। এরপরও যানজটের কারণে ঠিক সময়ে অফিসে ঢুকতে পারতাম না। এখন ১১টার অফিসে আগেও পৌঁছে যেতে পারি।“
কেবল যানজটমুক্ত যাতায়াতই নয়, নারীদের জন্য যাতায়াতে ‘নিরাপত্তাহীনতার বোধ’ বা ‘অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের’ বিড়ম্বনা, সেই বিষয়গুলোও নেই মেট্রোতে।
প্রতিটি ট্রেনের ছয়টি কোচের মধ্যে একটি নারীদের জন্য সংরক্ষিত। তবে অন্য কোচে উঠতেও নেই নিষেধ। এখন পর্যন্ত নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোচে পুরুষ যাত্রীদের উঠে পড়ার সমস্যা দেখা যায়নি।
নারীদের কোচে উঠতে হলে নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়াতে হয়। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে সেটিও আলাদা করে নির্দিষ্ট করা। ফলে ওঠানামার ক্ষেত্রে নারীরা বেশ স্বস্তিতেই থাকেন।
রাজধানীতে চলাচলের ক্ষেত্রে নারীদের যে বিড়ম্বনা, ভোগান্তি আর নিরাপত্তাহীনতা নতুন কিছু না। বাসে তাদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তা মানা হয় না বললেই চলে। পুরুষরা বসে থাকে হরদম, কথা বলতে গেলে অনেকে তেড়েফুঁড়ে আসে, কটাক্ষ, অপমানসূচক কথা শুনতে হয় নিয়মিত।
মিনিবাসে সংরক্ষিত আসনগুলো থাকে সাধারণত ইঞ্জিনের পাশে, যেখানে গ্রীষ্মে থাকে তীব্র গরম। আর যেসব মিনিবাসের দরজা সামনে থাকে, সেগুলোতে সংরক্ষিত আসন থাকেও না সব সময়। বাসের ভেতরে ভিড় থাকলে শ্রমিকরা নারী যাত্রীদের তুলতেও চান না।
গণপরিবহনে সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে এই যখন অবস্থা, তখন মেট্রোরেল নারী যাত্রীদের চলাচলের অভিজ্ঞতাই পাল্টে গেছে।
আনুর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ট্রেন থামল কাওরান বাজার স্টেশনে। এই স্টেশনের যাত্রী কানিজ ফাতেমার গন্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তার বাসা মগবাজার। বাংলামোটর হয়ে সড়ক পথে না গিয়ে তিনি চলে এসেছেন এই স্টেশনে।
তিনি বলেন, “বাসে যাতায়াত করতে সব সময়েই অস্বস্তি লাগত। রাত হলে ভয়ে থাকতাম। বাসে যাত্রী কমে গেলে আগেই নেমে যেতাম।
“বাসে বহুবার মৌখিক ও শারীরিক হয়রানির শিকার হয়েছি। মেট্রোর নারী কোচ আমার কাছে খুবই নিরাপদ পরিবহন।“
একই গল্প শিরিন মুনতাহার। তিনি একজন শিক্ষানবিশ গণমাধ্যমকর্মী। মিরপুর থেকে নিয়মিত আসতে হয় বাংলামোটর। সুবিধা মতো কারওয়ান বাজার বা শাহবাগ নামেন।
তিনি বলেন, “যানজট ও গণপরিবহনে অনিরাপত্তার কারণে চাকরির সুযোগ আসলে করতে পারিনি। রাত হয়ে গেলে পরিবার থেকে চিন্তা করত। আর এখন দিনের মধ্যেই বাসায় পৌঁছে যেতে পারি।
“মেট্রো চালুর আগে অনলাইনে করা যায় এমন চাকরিই করতে চাইতাম। তবে এখন যাতায়াত অনেক নিরাপদ মনে হয়।“
নারী যাত্রী কত?
মেট্রোরেলের প্রতিটি কোচে বসার জন্য আসন আছে ৪৫টি। তবে সব মিলিয়ে এক সঙ্গে ৩০০ জনের বেশি যাতায়াত করতে পারেন।
সকাল থেকে রাত অবধি অন্য কোচগুলোতে ঠাসাঠাসি ভিড় থাকলেও নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোচে সকাল অফিস সময়ে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এবং বিকেল ছুটির সময় ৫টা থেকে রাত ৭টা পর্যন্ত ভিড় বেশি থাকে। বাকি সময়ে মোটামুটি নির্বিঘ্নেই ওঠানামা করা যায়।
তবে নারীরা কেবল সংরক্ষিত কোচ ব্যবহার করেন এমন না, সঙ্গী থাকলে তারা অন্য কোচেও উঠে থাকেন।
মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) ইফতিখার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ”মেট্রো চালুর পর থেকে নারীদের দারুণ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে রাতে মতিঝিল পর্যন্ত চলাচল করায় তাদের সংখ্যা বেড়েছে। গত ২ দিন ধরে দিনে প্রায় আড়াই লাখ যাত্রী মেট্রো রেল ব্যবহার করেছেন। এদের প্রায় ১৬ শতাংশ ছিল নারী।”
তিনি বলেন, “অফিস সময় ছাড়াও অনেক নারী পরিবারসহ ঘুরতে বের হন। বিকেলের দিকে ভিড় থাকে উত্তরা উত্তরে। মিরপুর ১০, ১১, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয় স্টেশনগুলোতেও নারীদের অনেক বেশি ভিড় হয়।”
দিনে-রাতে উত্তরা টু মতিঝিল, ভিড় ঠেলেও মেট্রোরেলে যাত্রা